নির্বাচন কমিশন যা-ই বলুক, রাজনীতিকদের ভাষা ব্যবহারে এখনো কোনো বদল নেই। দিলীপ ঘোষ উদাহরণ মাত্র।
বিজ্ঞাপন
বর্ধমানে নিজের কেন্দ্রে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন বিজেপির সাবেক রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। মেদিনীপুর থেকে তাকে বর্ধমানে নিয়ে যাওয়ায় তিনি মোটেই খুশি নন বলে তার ঘনিষ্ঠ মহল বলছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই দিলীপ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চূড়ান্ত অপভাষা ব্যবহার করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতৃপরিচয় নিয়ে কার্যত প্রশ্ন তুলেছেন দিলীপ। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিসরে যা নিয়ে রীতিমতো আলোড়ন তৈরি হয়েছে। তৃণমূল নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছে। দিলীপের দল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সাবেক রাজ্য-সভাপতিকে শোকস নোটিস পাঠিয়েছে। দিলীপকে জানাতে হবে, কেন তিনি একথা বলেছেন। দিলীপের মন্তব্য থেকে দূরত্ব তৈরি করেছে বিজেপি। নোটিসে বলা হয়েছে, এধরনের ভাষা বিজেপি পছন্দ করছে না।
নির্বাচন কমিশনের অবস্থান
খেয়াল রাখা দরকার, সম্প্রতি লোকসভা ভোটের সময়সূচি জানানোর সময় নির্বাচন কমিশন দীর্ঘসময় ব্যয় করেছিল নির্বাচনি বিধির তালিকা জানাতে। আট দফা বিধির দুই নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রাজনীতিবিদেরা বিশেষ করে তারকা প্রার্থী এবং প্রচারকেরা নির্বাচনি বক্তৃতায় কোথাও কোনো ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে পারবেন না। সমালোচনা করতে হলে তার কাজের কথা বলতে হবে।
ওই একই নির্বাচনি বিধির পাঁচ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নারীর প্রতি অসম্মানজনক কথা বলা যাবে না। যদি বলা হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
লোকসভা ২০২৪: প্রচারে কী ধরনের চমক আনলেন নরেন্দ্র মোদী?
লোকসভা নির্বাচনের প্রচার কৌশল বদল করেছেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি এখন মোদী-পরিবার, মোদী-গ্যারান্টির কথা বলছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নতুন কৌশল
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন পুরোদমে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে নেমে পড়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি হয় জনসভা করছেন অথবা সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছেন মোদী। আর তিনি এবার প্রচারে নিয়ে এসেছেন নতুন বিষয়। নতুন কৌশল।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মোদীর গ্যারান্টি
কিছুদিন হলো মোদীর গ্যারান্টি নিয়ে ভরপুর প্রচার চলছে। এই গ্যারান্টি কি? গরিবদের আরো পাঁচ বছর বিনা পয়সায় সরকারি রেশন, পাঁচ লাখ পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিমা, কম দামে গ্যাসের সিলিন্ডার, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বিনা পয়সায় বাড়ি, নারী স্বনিযুক্ত গোষ্ঠীকে ১৫ হাজার টাকা, বয়স্কদের পেনশন, লাখপতি দিদির মতো একগুচ্ছ প্রকল্পই হলো মোদীর গ্যারান্টি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সরকারি প্রকল্প
এ সবই সরকারি প্রকল্প। রেডিও, টিভি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, খবরের কাগজ, পত্রিকা, পেট্রোল পাম্প সব জায়গাতে এর ভরপুর প্রচার চলছে। এই বিজ্ঞাপন কৌশল দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করতে চাইছেন মোদী। আগেরবার বলা হয়েছিল, 'মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়'। এবার বলা হচ্ছে, 'মোদী কা গ্যারান্টি হ্যায়'।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মোদী-পরিবার
পশ্চিমবঙ্গে এসে মোদী এই প্রচার শুরু করেছেন। মোদী-পরিবারের প্রচার। বারাসতের সভায় তিনি বলেছেন, তরুণ বয়সে শুধু একটা ঝোলা নিয়ে তিনি গহত্যাগ করেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যান। সেখানকার ভাষা জানতেন না। পকেটে পয়সা নেই। কিন্তু কোনো না কোনো পরিবার তাকে ঠিক খাবার দিয়েছে । মোদীর ঘোষণা, ভারতীয়রা সকলেই মোদীর পরিবার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মোদীর স্লোগান
জনসভায় মোদী বলতে থাকেন, 'আমি'। সামনে বসা মানুষ জবাব দেন 'মোদীর পরিবার'। এটাই মোদী তথা বিজেপি-র নতুন স্লোগান। বিজেপি বলছে, এটাই তাদের তুরুপের তাস হয়ে উঠতে চলেছে। জনতার সঙ্গে মোদীর একাত্মতার মোকাবিলা বিরোধীরা করতে পারবে না বলে বিজেপি নেতাদের দাবি।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মোদীর নারীশক্তি
আরো বেশি করে নারীদের ভোট পেতে উদ্যোগী হয়েছেন মোদী। সংসদে ও বিধানসভায় নারীদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের বিল পাস হয়েছে। সেই ব্যবস্থা কার্যকর হবে ২০২৯ থেকে। মোদী গরিব মেয়েদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশ্বকর্মা যোজনা, ছোট ব্যবসা করার জন্য স্বনিধি যোজনার কথা বলছেন। লাখপতি দিদি নিয়ে প্রচার চলছে। মেয়েদের বিনা সুদে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা বছরে এক লাখ টাকা রোজগার করতে পারেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নতুন ভোটারদের প্রভাবিত করতে
কিছুদিন আগেই বিজেপি নেতা ও কর্মীদের মোদী নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবার ১৮ বছর বয়সি যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাদের সকলের কাছে পৌঁছাতে হবে। মোদী এবার প্রচারে যুব ও প্রথমবারের ভোটদাতাদের মন পেতে তাদের জন্য তিনি কী করেছেন, তা বিস্তারিতভাবে বলবেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ধারণা তৈরির খেলা
এবার মোদীর আরেকটি স্লোগান হলো, আব কি বার, চারশ পার। অর্থাৎ, এবার চারশ পার করে যাবে এনডিএ। বিজেপি পাবে অন্তত ৩৭০টি আসন। এবার এনডিএ-র পরিধি বাড়ানো হয়েছে। চন্দ্রবাবু নাইডু আবার এনডিএ-তে ফিরেছেন। বিজু জনতা দলের নেতা নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করা নিয়ে বিজেপি-র আলোচনা অনেকদূর এগিয়েছে। মোদী একটা ধারণা তৈরি করতে চাইছেন, তিনি জিতবেনই।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মতুয়াদের সিএএ-উপহার
পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, মালদহ ও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষ আছেন। তারা সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আসা নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। বনগাঁও-সহ তিনটি লোকসভা কেন্দ্রে তারাই ভোটের ফল নির্ধারণ করেন। তাদের ভোটাধিকার থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিক স্বীকৃতি নেই। সিএএ চালু করে তাদের নাগরিক হওয়ার পথ সুগম করা হলো বলে বিজেপি প্রচারে নেমে গেছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কেন বারবার পশ্চিমবঙ্গে?
পশ্চিমবঙ্গে গত দুই সপ্তাহে তিনবার এসেছেন মোদী। জনসভা করেছেন আরামবাগ, বারাসত, শিলিগুড়িতে। মেট্রো রেল সম্প্রসারণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। পড়ুয়াদের সঙ্গে নিয়ে মেট্রো সফর করেছেন। সন্দেশখালির নারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। গতবার ১৮টি আসনে জিতেছিল বিজেপি। এবার সেই সংখ্যা ধরে রেখে একটা হলেও আসন বাড়াতে চায় তারা। তাই এত ঘনঘন মোদীর পশ্চিমবঙ্গ সফর।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নতুন মুখ নিয়ে আসা
মোদীর নির্বাচনী কৌশলের একটা অঙ্গ হলো, নতুনদের প্রার্থী করা। পুরনোদের মধ্যে যাদের জয় নিয়ে তিলমাত্র সন্দেহ আছে, তাদের বাদ দিয়ে দেয়া। এবারো সেই পথে হেঁটেছেন মোদী। দিল্লিতে পাঁচটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। চারটিতে নতুন প্রার্থীকে সুযোগ দেয়া হয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
11 ছবি1 | 11
কী শাস্তির কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন? বলা হয়েছে, যে কোনো দলের তারকা প্রার্থীরা যদি এমন আচরণ করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে তো বটেই তার দলের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেড়ে নেয়া হতে পারে দলীয় প্রতীকও। ভারতীয় সংবিধানের পরিসরে নির্বাচন কমিশন চাইলে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই পারে। সে এক্তিয়ার তাদের আছে। কমিশন জানিয়েছে, প্রত্যেক জেলায় একজন করে নোডাল অফিসার বসানো হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে হবে সেই জেলার জেলাশাসক। তার রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দিলীপের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, জেলাশাসকের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। রাজ্যের অফিসারের হাত ঘুরে তা কেন্দ্রীয় কমিশনের কাছে যাবে।
বাস্তবে কিছুই হয় না
এবারের নির্বাচনে নির্বাচনি বিধি নিয়ে একটু বেশিই সরব হয়েছে কমিশন। তবে প্রতি বারেই নির্বাচনী বিধি থাকে। এবং প্রতি বারেই রাজনীতিবিদেরা সেই বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অপভাষার বন্যা বইয়ে দেন। উদাহরণ দিতে গেলে নিউজ প্রিন্টের কালি শেষ হয়ে যাবে।
কিছু উদাহরণ
তবু কিছু ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কোমরে দড়ি পড়িয়ে ঘোরানোর কথা বলেছিলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যদিকে নানা সুরে 'দিদি' উচ্চারণ করে মমতাকে কার্যত ব্যক্তি আক্রমণের রাস্তাই নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। শরণার্থীদের উইপোকার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বিরোধীদের নিয়ে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ দিয়ে 'মণিমানিক্য' ঝড়েছে। এমন সব কথা তিনি বলেছেন, যা লেখারও অযোগ্য। অধুনা তিহারবন্দি অনুব্রত মন্ডলের মুখনিঃসৃত বাণী উবাচে পরিণত হয়েছে। তা সে পুলিশকে বোম মারাই হোক, বিরোধীকে গাঁজা কেস দেয়াই হোক অথবা চড়াম চড়াম ঢাক।
এক সময় বামেরাও এসব কথা কম বলেনি। কৃষকনেতা বিনয় কোঙার মেধা পটেকরকে নিয়ে যা বলেছিলেন, তা এখনো সিঙ্গুর মনে রেখেছে। দল থেকে বিতাড়িত সিপিএম নেতা অনিল বসু মমতার নামে ভয়ংকর সব শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন। এদিকে বিজেপির সাংসদ এবং এবারের ভোটেও প্রার্থী সুভাষ সরকার এই কিছুদিন আগেই বলে বসেছেন, ''মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ কি বন্দুকে নিরোধ পরিয়ে রেখেছে?'' এদিকে বিষ্ণুপুরে যুযুধান দুই প্রার্থী একদা স্বামী-স্ত্রী সৌমিত্র খান এবং সুজাতা মন্ডল। চলতি নির্বাচনে তাদের কথাবার্তাও খেউড়ে পরিণত হয়েছে।
গত আড়াই দশকে এটাই আসলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী নেতাদের উল্লেখ করতে গিয়ে 'তুই-তোকারি' করেন, সে রাজ্যে এটাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি হওয়ার কথা ছিল। ফলে দিলীপ ঘোষ কোনো ব্যতিক্রম নন। তিনি এই অপ-রাজনীতির অন্যতম ধারকবাহক। তার বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশন যেমন একথা জানে, তেমন জানেন দিলীপ এবং তার গোত্রীয় রাজনীতিবিদেরা। তারা জানেন, এসব কথা বললে বরং কিছু ফুটেজ বেশি পাওয়া যায়। ফলে বাংলার রাজনীতি যে চলছিল, তেমনই চলবে। একথা হলফ করে বলে দিতে কোনো দ্বিধা নেই। দ্বন্দ্বও নয়।