বার্ন ইউনিটে বাড়ছে মানুষের আহাজারি৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে আহজারির রেশ৷ অথচ যাঁরা আগুন নেভাতে পারেন, তাঁরা আগুনের দায় একে অপরের ঘাড়ে চাপাতেই এখনো ব্যস্ত৷
বিজ্ঞাপন
বিএনপি জোটের টানা অবরোধ থামার কোনো ইঙ্গিত নেই, বরং যোগ হচ্ছে টানা হরতাল কর্মসূচি৷ অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহিংসতা থামাতে পুলিশকে সবকিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন, ঘোষণা দিয়েছেন দায় বহনের৷ পুলিশের প্রতি তাঁর এই বক্তব্যে নিয়মনীতি ভাঙার ইঙ্গিত স্পষ্ট৷ অন্তত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সেরকমই ভাবছে৷ বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানিয়েছে, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ পুলিশকে ইচ্ছামত কাজ করার অধিকার দিয়ে কার্যত চলমান সহিংস পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তোলার ঝুঁকি নিচ্ছে৷
অ্যামনেস্টি মনে করছে, পুলিশকে মাত্রাতারিক্ত ক্ষমতা দেয়া ভয়ংকর পেট্রোল বোমা হামলার জবাব হতে পারে না৷ সংস্থাটি একইসঙ্গে জানিয়েছে যে, বিএনপির উচিত সহিংস কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের নেতাকর্মীদের বিরত রাখা৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এমন বক্তব্য কার্যত কোনো পক্ষই আমলে নিচ্ছে না৷ বরং দুই পক্ষের কঠোর অবস্থানে ক্ষতির শিকার সাধারণ মানুষ৷ পুলিশ পারছে না পেট্রোল বোমা রুখতে, ফলে পুড়ছে সাধারণ জনতা৷ ভিড় বাড়ছে বার্ন ইউনিটে৷
সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন অনেকে৷ গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম কর্মী মাহমুদুল হক মুন্সি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘মানুষ পুড়িয়ে রাজনীতি নয়, পোড়া লাশের গণতন্ত্র আমার নয়! শহীদ মিনারে #হোকপ্রতিবাদ৷''
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি নিয়ে সৃষ্ট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারও নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন অবরোধের আগুন থেকে মানুষকে রক্ষা করতে৷ সহিংসতার বিপক্ষে জনসচেতনতা গড়তে তৎপর ইমরান শুক্রবার ‘‘সন্ত্রাসবিরোধী প্রতিবাদী গণস্বাক্ষর ও সমাবেশ'' শীর্ষক এক ইভেন্টের আয়োজন করেন৷
পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মানবতা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
বিএনপি জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচির সমালোচনা করে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘শুধু মানুষকে বিপদে না ফেলে রাস্তায় নামেন, পুলিশের মার খান....শুধু জনগণকে মারবেন কেন, মারের ব্যবস্থা করে দেবেন কেন?''
বলাবাহুল্য, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর প্রায় এক বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ শান্ত ছিল৷ বিশেষ করে বিএনপি কোনো কঠোর রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেনি৷ কিন্তু সেসময় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী দলটির আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই হাস্যরস শুরু করে৷ নানারকম উসকানিমূলক বক্তব্য দেন৷
গোলাম মোর্তোজা সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে লিখেছেন, ‘‘মন্ত্রী শাহজাহান খান এত বড় শ্রমিক-মালিক নেতা, নিজেদের মালিকানার বাস রাস্তায় চালাচ্ছেন না কেন? কাজ না করে এত উসকানিমূলক হুংকার কেন? মানুষকে বিপদে ফেলে সুবিধা নিতে চায় বিএনপি৷ সরকারও মানুষের বিপদ পূঁজি করে বিএনপি নির্মূল করে সুবিধা নিতে চায়৷ মানুষ যে কি চায়, তা ভাবে না কেউ!''