ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থেই জলবায়ু তহবিলের অর্থ বেশি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, টিআইবি৷
বিজ্ঞাপন
তাদের দাবি, তহবিল থেকে অর্থ পেয়েছে এমন এনজিওর ঠিকানাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড বা বিসিসিআরএফ থেকে অর্থ পাওয়া ৪০টি এনজিও পরিদর্শন করে টিআইবি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে৷ বুধবার প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু৷ তিনি এই প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করে বলেন, ‘‘অনেক সময় দেখা যায় প্রকল্পের জন্য টাকা নেয়া হয়, কিন্তু কাজ হয় না৷ বিষয়টি আমরা অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখছি৷'' তিনি বলেন তহবিলের অর্থ যেন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যায় সেজন্য তিনি সবসময় সচেষ্ট রয়েছেন৷ কাদের এই ফান্ড দেয়া হচ্ছে তাও নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী৷
বিনা দোষে ভুগছে বাংলাদেশ
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে বাংলাদেশের তেমন কোনো অবদান নেই৷ তবে এর ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ৷ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় ঘরবাড়ি হারাচ্ছে উপকূলের মানুষ৷ অসময়ে বন্যা, খরা ও লবণাক্ত পানি ফসলের ক্ষতি করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জলবায়ু পরিবর্তন
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ৷ উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে৷ ফলে উপকূলের মানুষ বাসস্থান হারাচ্ছেন৷ অসময়ের বন্যা, খরা ফসলের ক্ষতি করছে৷ মোটের উপর লবণাক্ত পানি চাষ উপযোগী জমির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে৷
ছবি: dapd
বাড়ছে পানি, বাড়ছে ভোগান্তি
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা অনুযায়ী, ২১০০ সাল নাগাদ যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বেড়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের তিন মিলিয়ন হেক্টর জমি প্লাবিত হতে পারে৷ সম্প্রতি সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলের পানি পরিমাপ করে গবেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
জলবায়ু উদ্বাস্তু
বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থী বিষয়ক সংগঠন এসিআর-এর মুহাম্মদ আবু মুসা চলতি বছর ডয়চে ভেলেকে জানান, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ৪৫ জনের মধ্যে ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে৷ আর বাংলাদেশে সংখ্যাটা হবে প্রতি সাতজনে একজন৷ দেশের ১৭ ভাগ এলাকা বিলীন হয়ে যাবে সমুদ্র গর্ভে৷ ইতোমধ্যে কুতুবদিয়া এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষ মূল ভূখণ্ড ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন৷
ছবি: Jewel Samad/AFP/Getty Images
লবণাক্ত পানি
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ত পানি সমতল ভূমির আরো ভেতরের দিকে চলে আসছে৷ ফলে লবণাক্ততা বাড়ছে৷ বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলে ইতিমধ্যে এ সমস্যা সনাক্ত করা হয়েছে৷ পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: DW
মাছের উৎপাদন কমছে
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মাছ উৎপাদনের উপর৷ মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা থেকে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে৷ এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে খাল, বিল, প্লাবনভূমিতে সময় মতো পানি না পৌঁছানোয় দেশীয় মাছের প্রজনন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
ক্ষতির শিকার সুন্দরবন
জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ শীর্ষক ইউনেস্কোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের নানা কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে৷ ইতোমধ্যে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের সবচেয়ে গহীনের ক্যাম্প মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্প সাগরে হারিয়ে গেছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
জার্মানির সহায়তা
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশকে প্রায় ১১ মিলিয়ন ইউরো বা ১১২ কোটি টাকার অর্থ সহায়তা দিতে গত বছর এক চুক্তি স্বাক্ষর করে জার্মানি৷ এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের তিনটি উপকূলীয় জেলায় দুর্যোগ সহনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ ২০১২-২০১৭ মেয়াদে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হবে৷ এসব প্রকল্পের মধ্যে আছে টেকসই রাস্তা-ঘাট, সেতু ও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ৷
ছবি: DW
জলবায়ু তহবিল
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অর্থ সহায়তা দিতে বিভিন্ন সম্মেলনে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক সমাজ৷ তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এসব সহায়তা পুরোপুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখনো বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে৷ একইসঙ্গে জলবায়ু তহবিল বণ্টনের ক্ষেত্রেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ সব মিলিয়ে এক্ষেত্রে আরো সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিসিসিআরএফ'এ দাখিলকৃত প্রকল্প প্রস্তাব কারিগরি কমিটির মূল্যায়নে অযোগ্য বিবেচিত হলেও বিসিসিআরএফ থেকে ওই প্রকল্প অনুমোদন পাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে৷ টিআইবি বিসিসিআরএফ তহবিল প্রাপ্ত ৪০টি এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কতগুলো চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে৷ চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আইনি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পর্ষদ রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত, পিকেএসএফ প্রদত্ত ঠিকানা অনুযায়ী এনজিওর অবস্থান খুঁজে না পাওয়া, রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে প্রকল্প প্রাপ্তি, বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প এলাকায় অফিস না থাকা, বসবাসরত বাসাকে লিঁয়াজো অফিস হিসেবে ব্যবহার এবং প্রাক্কলনের ২০ শতাংশ কমিশন হিসেবে গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার আরও ১৫ শতাংশ বাড়বে৷ এছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রের পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রার ঊর্ধ্বগতির কারণে ধান ও গমের উৎপাদন যথাক্রমে ৮ এবং ৩২ শতাংশ কমে যেতে পারে৷
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, জলবায়ু তহবিল ছাড়, প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী এবং অভিজ্ঞ ও স্বার্থের দ্বন্ধ বহির্ভূত বিশেষজ্ঞ বা নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে৷
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে অবস্থানকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের স্থান সবার উপরে৷ সরকারকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় স্বদিচ্ছার প্রমাণ দেখাতে হবে৷ বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় জলবায়ু অর্থায়ন সুশাসন প্রকল্পের (সিএফজিপি) আওতায় টিআইবির চলমান গবেষণার অংশ হিসেবে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে বলে জানান তিনি৷
গবেষণায় বৈশ্বিক এবং জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু তহবিল ছাড়, সমন্বয় ও বাস্তবায়নে সুশাসন নিশ্চিতের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করার বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া হয়৷