বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ গত কয়েক মাসে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অতীতে দায়ের হওয়া মামলায় একের পর এক রায় ও দণ্ড হওয়ায় এই অভিযোগ করছেন বিএনপি নেতারা৷
দেশে লাখ লাখ মামলা জট থাকলেও বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে৷
সাড়ে তিন মাসে বিএনপির ৮১৪ নেতা-কর্মীর সাজা
একইদিনে বিএনপির ৩০-৪০ জন নেতা-কর্মীর বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হচ্ছে৷ এই মামলাগুলোর অধিকাংশরই বাদী পুলিশ৷ মামলাগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে ভাঙচুর, আগুন, নাশকতা ও পুলিশের ওপর হামলার মামলা৷ গত সাড়ে তিন মাসে মোট ৫২টি মামলায় বিএনপির ৮১৪ জন নেতা-কর্মীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে৷
বুধবারও (৬ ডিসেম্বর) তিনটি মামলায় বিএনপির ৪৬ জন নেতা-কর্মীকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ যে তিনটি মামলায় সাজা হয়েছে তা ২০১৮ সালের মামলা৷
একটি মামলা ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ক্যান্টনমেন্ট থানায় দায়ের করা৷ ওই মামলার বাদী পুলিশ৷ মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ভাঙচুর ও পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছোড়া হয়৷ এতে চার পুলিশ সদস্য আহত হন৷
২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কোতয়ালী থানায় পুলিশের দায়ের করা আরেকটি মামলায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে যানবাহন ভাঙচুর এবং পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করা হয়৷ ওই সময়ে দুইজন পুলিশ সদস্য আহত হন৷
গত ৪ ডিসেম্বর বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের ১৫ জন নেতা-কর্মীকে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর সবুজবাগ থানায় দায়ের করা একটি মামলায় তিন বছর ছয়মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷ মামলার আইনজীবীদের অভিযোগ, ওই মামলাটির কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত থাকার পরও তা উপেক্ষা করে মামলার রায় দেওয়া হয়৷
এই মামলার আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মাসুদ মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘‘বিএনপির মিছিল, সমাবেশকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালে সবুজবাগ থানায় মামলাটি হয়৷ ১৫ জনকে আসামি করা হয়৷ ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট এই মামলার সকল কার্যক্রম স্থগিত করেন এবং রুল দেন৷ এখনো সেই অবস্থায় আছে৷ বিচার আদালতে হাইকোর্টের আদেশের সার্টিফায়েড কপিও দেয়া হয়েছে৷ রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কিছুদিন আগে বললেন বিএনপির বিরুদ্ধে সকল মামলার রায় দিতে হবে৷ তারপর আদালত সাক্ষী তলব করে মামলার রায় দেয়৷ ১৫ জনকে সাড়ে তিন বছর করে কারাদণ্ড দেয়৷ যা বেআইনি এবং অন্যায়৷''
২৮ অক্টোবরের পর কিছু আলোচিত ঘটনা
২৮ অক্টোবর বিএনপি ঢাকায় মহাসমাবেশ করেছিল৷ কিন্তু শেষ করতে পারেনি৷ এরপর ঐদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধী অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ সরকারের পক্ষে যেতে রাজি হওয়ায় জামিন পান বিএনপির এক নেতা৷ বাকিরা এখনও জেলে৷
ছবি: Kamol Das
ইটপাটকেল নিক্ষেপের মামলায় কারাগারে মির্জা ফখরুল
২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ সমাপ্ত হতে পারেনি৷ এর পরদিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনের ফটক ভেঙে ইটপাটকেল নিক্ষেপের মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ মির্জা ফখরুলের আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী আদালতকে বলেন, মির্জা ফখরুল ছিলেন পল্টন থানাধীন মহাসমাবেশের মূল মঞ্চে৷ রমনা থানাধীন প্রধান বিচারপতির বাসভবনের ফটক ভাঙচুর কিংবা ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় তিনি কোনোভাবে জড়িত নন৷
ছবি: Asif Ahasanul
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও শামসুজ্জামান, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ, বিএনপির মিডিয়া সেলের সমন্বয়ক জহির উদ্দিন স্বপন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হকসহ অনেকে৷
ছবি: Asif Ahasanul
জামিন পেয়ে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে শাহজাহান ওমর
২৮ অক্টোবরের পর গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপির অন্য শীর্ষ নেতারা জামিন না পেলেও বিএনপির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর ২৯ নভেম্বর জামিন পান৷ এরপর ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নও পেয়েছেন৷ এই ঘটনায় বিএনপি তাকে বহিষ্কার করেছে৷
ছবি: Dulal Saha
সবকিছু দ্রুততার সাথে সম্পন্ন
শাহজাহান ওমর জামিনে কারাগার থেকে বের হওয়ার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে তার মনোনয়নপত্র সংগ্রহ, ক্ষমতাসীন দলের তাকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়৷ এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘‘শাহজাহান ওমরের ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, সরকার কীভাবে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে৷’’
ছবি: Dulal Saha
বিএনপি, জামায়াতের যত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার
২৮ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৪৭৫টি মামলায় তাদের ১৮ হাজার ৯০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি৷ আর জামায়াত বলছে, ২৫ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১০৪টি মামলায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীর সংখ্যা দুই হাজার ৮৪৫ জন৷
ছবি: Kamol Das
গুম হওয়া ব্যক্তির কারাদণ্ড
ঢাকার বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হন বলে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে৷ সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠন গড়ে তুলেছেন৷ ২০১৩ সালের ২৫ মে একটি প্রাইভেট কারে আগুন দেওয়ার মামলায় গত ২০ নভেম্বর সুমনকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
মৃত ব্যক্তিকে পালিয়ে যেতে দেখেছে পুলিশ!
গাজীপুরের আমিন উদ্দিন মোল্লা দুই বছর ১০ মাস আগে মারা যান৷ অথচ তাকে ২৮ অক্টোবর রাতে পুলিশের একটি ‘টহল দলকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময়’ দেখতে পান কাপাসিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সালাউদ্দিন৷ মামলার এজাহার বলছে, ঘটনাটি ঘটেছিল রাতে সাড়ে ১১টার দিকে, তারগাঁও মেডিকেল মোড় এলাকায়৷ অন্ধকার রাতে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সন্দেহভাজনদের ‘স্পষ্ট’ দেখতে পেয়েছিলেন বলেও জানান সালাউদ্দিন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
উপস্থিত না থেকেও মোটরসাইকেল ভেঙেছেন!
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামায়াত সমর্থক আল আমিন সরকারসহ বিএনপি-জামায়াতের ৫৭ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৩০ অক্টোবর সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে কসবা পৌর এলাকায় ‘চারটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর, মারধর ও দুই লাখ ছিনিয়ে নেওয়ার’ অভিযোগে মামলা হয়৷ অথচ আল আমিনের ইমিগ্রেশনের কাগজপত্রে ডেইলি স্টার দেখতে পেয়েছে, তিনি ওমরাহ পালন শেষে ৩০ অক্টোবর সকাল ৬টায় ঢাকায় নামেন৷ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব সড়কপথে প্রায় ১২০ কিলোমিটার৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
8 ছবি1 | 8
তিনি বলেন, ‘‘শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার রায় দিতে হবে এই একটি মানসিকতা নিম্ন আদালতের বিচারকদের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে৷ এটি একটি রাজনৈতিক মামলা৷ বিচারক হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন৷ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং রায় প্রত্যাহার করা উচিত৷ আমরা এটা নিয়ে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেব৷''
মৃত ব্যক্তির সাজা!
মৃত ব্যক্তিকে দণ্ড বা মামলার আসামি করার একাধিক নজির আছে৷ নজির আছে গায়েবি মামলার৷ গত ৩ নভেম্বর গাজীপুরের কাপাসিয়ায় একটি নাশকতার মামলায় এক মৃত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়৷ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির ওই মামলায় স্থানীয় বিএনপির ২২ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়৷ তার মধ্যে ১৮ নাম্বার আসামি করা হয়েছে মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন মোল্লাকে৷ বয়স লেখা হয়েছে ৪৫ বছর৷ তিনি আসলে ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি মারা গেছেন৷
এদিকে ২৩ ও ২৯ নভেম্বর বিএনপির দুই মৃত ব্যক্তিকে সাজা দিয়েছেন আদালত৷ সবুজবাগ থানায় ২০১২ সালে করা এক মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ১৫ নেতাকর্মীকে ২৯ নভেম্বর দুই বছর ৬ মাস কারাদণ্ড দেন আদালত৷ এরমধ্যে ২০২১ সালের ১৩ জুলাই মারা যাওয়া ৭৩নং ওয়ার্ড বিএনপির নেতা সোহরাওয়ার্দী চেয়ারম্যানকেও সাজা দেয়া হয়েছে৷
আর ২০১৭ সালে করা পল্টন থানার এক মামলায় ২৩ নভেম্বর বিএনপির ৩৬ নেতাকর্মীকে চার বছরের কারাদণ্ড ও প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১৭ দিন কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷ এর মধ্যে রায়ের আদেশে উল্লিখিত ১২ নাম্বার আসামি তানভীর আদিল খান বাবু মারা গেছেন বলে জানান তার আইনজীবী আবু বক্কর৷
‘আগে এরকম দেখিনি'
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘আদালতকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মানুষ কথা বলছে৷ এটা তো এমনিতেই বলছেন না৷ হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে দ্রুত কিছু মামলার রায় হয়ে যাচ্ছে৷ ওই মামলাগুলোর আসামি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা৷ আবার কেউ বার বার জামিন চেয়েও পাচ্ছে না৷ কিন্তু কেউ আবার অল্প সময়ের মধ্যে জামিন পেয়ে দল পরিবর্তন করে নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন৷ ফলে আদালতকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের কথা উঠছে৷ আগে আমরা এরকম দেখিনি৷''
আইনে রাজনৈতিক মামলা বলে কিছু নেই: আইনজীবী মনজিল মোরসেদ
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আইনে রাজনৈতিক মামলা বলে কিছু নেই৷ তবে রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কোনো ভাঙচুর বা পুলিশের সঙ্গে মারামারি- এসব ঘটনা ঘটে৷ এই ঘটনায় মামলা হলে সেখানে রাজনৈতিক উপাদান থাকে বলে আমরা রাজনৈতিক মামলা বলি৷ রাজনৈতিক মামলা আজকের নয়৷ বহু বছর ধরেই হচ্ছে৷ এইসব মামলায় আসলে শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না৷ এরশাদ ও বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অনেক রাজনৈতিক মামলা হয়েছে৷ ওইসব মামলায় তো আমরা তেমন কিছু হতে দেখিনি৷ এখন হঠাৎ করে শাস্তি শুরু হওয়ার কারণে এটা নিয়ে কথা হচ্ছে৷''
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) গত ২৬ নভেম্বর বলেছে, ‘‘সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রতিযোগিতা দূর করতে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক ও সহিংস দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে এবং ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের দিন থেকে এপর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতাকর্মী৷ তাদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে বিচারিক ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে৷'' বিএনপির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এইচআরডাব্লিউ জানায়, দলটির প্রায় ৫০ লাখ সদস্যের অর্ধেকই বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিচারের সম্মুখীন৷
‘আদালতকে সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে তা স্পষ্ট‘
রাজনৈতিক বিবেচনায় কাজ
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘‘আদালতকে যে এই সরকার রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে তা নানা ঘটনায় স্পষ্ট৷ এটা শুধু আমরা বলছি না আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে৷ হঠাৎ করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা পুরনো মামলায় দণ্ড দেওয়া শুরু হয়েছে গত তিন-সাড়ে তিন মাস ধরে৷ যে মামলায় ৫০ জন সাক্ষী আছে সেই মামলায় চারজনের সাক্ষ্য নিয়ে রায় দিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ ফৌজদারি মামলার বিধান মতে আসামিদের এবং সাক্ষীদের কোনো সমন দেয়া হচ্ছে না৷ পলাতক থাকলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে না৷''
তার কথা, ‘‘মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে৷ আবার সেই মৃত ব্যক্তিকে শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে৷ হাইকোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করার পরও সেই মামলায় শাস্তি দিচ্ছে বিচার আদালত৷ তারা কোনো বিচারিক নিয়ম-নীতি অনুসরণ করছেন বলে মনে হচ্ছে না৷ তারা কাজ করছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়৷''
‘এখন সাক্ষীদের রিয়েলাইজেশন হয়েছে যে সাক্ষ্য দেয়া প্রয়োজন'
তবে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু এই সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলার রায় হচ্ছে না৷ এই সব মামলা অনেক পুরনো৷ দীর্ঘদিন ধরেই মামলার বিচারকাজ চলছিল৷ সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছিল৷ ধারাবাহিক প্রক্রিয়াই মামলার রায় হচ্ছে৷''
কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলার রায় হচ্ছে না: আব্দুল্লাহ আবু
হঠাৎ করে একের পর এক রায় কেন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এতদিন সাক্ষীরা আসেনি৷ এখন সাক্ষীদের মধ্যে রিয়েলাইজেশন হয়েছে যে সাক্ষ্য দেয়া প্রয়োজন তাই তারা আদালতে সাক্ষী দিতে আসছেন৷ মামলার রায় হচ্ছে৷ আমরা তো আর সাক্ষীদের ফিরিয়ে দিতে পারি না৷ আর যাদের বিরুদ্ধে রায় হচ্ছে তাদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তো রায় হচ্ছে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কোনো আসামি মারা গেলে তা তো আসামি পক্ষকে আদালতে জানাতে হবে৷ পুলিশও জানাতে পারে৷ না জানালে বিচারক জানবেন কীভাবে? এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি৷ আর উচ্চ আদালত কোনো মামলার বিচার স্থগিত করলে বিচার আদালতে তার রায় হতে পারে না৷ কিন্তু সেটাও তো আসামি পক্ষকে আদালতে জানাতে হবে৷ তারা জানায়নি৷ এটা আসামি পক্ষের দায়৷''
বাংলাদেশে রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের যত মন্তব্য
নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়৷ ২০০০ সালের পর থেকে এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা থাকছে ছবিঘরে৷
২০০০ সালের পর থেকে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোর প্রায় প্রত্যেকটির আগে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূতদের কথা বলতে দেখা গেছে৷ বিদেশি কূটনীতিকদের এমন আচরণকে সবসময় ক্ষমতাসীন দল ‘শিষ্টাচার লঙ্ঘন’ হিসেবে অভিহিত করে। আর ক্ষমতার বাইরে থাকলে তা ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার’ পদক্ষেপ৷
ছবি: AP
‘স্টুপিড রাষ্ট্রদূত’
চার দলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষের আগে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের তৎপরতা দেখা যায়৷ তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা বলেন, ‘‘কিছু কিছু দালাল রাষ্ট্রদূত মহাজোটকে (আওয়ামী লীগ ও তার জোট) সংবিধান ধ্বংসের উসকানি দিচ্ছেন৷ তাদের কর্থাবার্তা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরুপ৷’’ বাংলাদেশে মার্কিন ও ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে ‘স্টুপিড’ হিসেবে অভিহিত করেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
২০ বছর পর আওয়ামী লীগের মুখেও একই সুর
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে ভিসা নীতি। কথা বলছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকেরাও। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল বা বিতর্ক সৃষ্টি করে এমন বিষয় বা অনুষ্ঠান থেকে কূটনীতিবিদেরা বিরত থাকবেন বলে আশা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর৷
ছবি: DW
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ঢাকায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট
২০০১ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আগস্টে ঢাকায় আসেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ‘সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে সুসংহত‘ করতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসেন তিনি৷ ঢাকা ত্যাগের আগে সংবাদ সম্মেলনে কার্টার জানান, ১) সংসদ বর্জন নয় ২) হরতাল নয় ৩) সন্ত্রাস নয় ৪) ভোটকেন্দ্রে স্থানীয় পর্যবেক্ষক এবং ৫) কমপক্ষে ৬০জন নারী এমপি, এই পাঁচ প্রশ্নে একমত হয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি৷
ছবি: John Amis/REUTERS
‘বাংলাদেশ ট্রাবলসাম হয়ে উঠেছে’
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সারাদেশে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা, জঙ্গিবাদের উথ্থানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনায় আসে বাংলাদেশ৷ এমন প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পরররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসের এক বক্তব্য বেশ আলোড়ন তোলে৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ বেশ ট্রাবলসাম বা সমস্যাসংকুল হয়ে উঠেছে এবং এ ব্যাপারে আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত) কিছু করতে হবে।’’
ছবি: DW/O. Sawizky
বাংলাদেশ বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের চিঠি
সম্প্রতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে লেখা ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে৷ এমন ঘটনা নতুন নয়৷ ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ১৬ বা ১৮ জন মার্কিন কংগ্রেসম্যান-সিনেটর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইসকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশের কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংস জঙ্গিবাদের ব্যাপারটি উথ্থাপন করার অনুরোধ জানান৷
ছবি: Anna Moneymaker/Getty Images
এক-এগারো সরকার ও কূটনীতিকেরা
চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হবার আগেই বাংলাদেশে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইত্যাদি বিষয়ে সম্পূর্ণ দুই মেরুতে অবস্থান নেয় সেসময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপি ও প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগে থেকেই তৎপরতা শুরু করে কূটনীতিকেরা।
ছবি: DW
সরব পশ্চিমারা
চারদলীয় জোটের সময়কালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে বেশ তৎপরতা দেখা যায় পশ্চিমা কূটনীতিকদের৷ ২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে ফোন করেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি নিকোলাস বার্নসে৷ সব দল যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে সেই ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেন৷
ছবি: Jakub Porzycki/NurPhot/picture alliance
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের 'কফি গ্রুপ’
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকাস্থ পশ্চিমা কূটনীতিকেরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য নিজেদের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক করতেন। যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘কফি গ্রুপ’। এর সাথে সম্পৃক্ত ছিল অ্যামেরিকা, ব্রিটেন, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও জাতিসংঘের প্রতিনিধি। এই গ্রুপে জাপানকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। উইকিলিকসে প্রকাশিত তথ্য এমন ইঙ্গিত দেয়।
ছবি: DW
চাকরির নিশ্চয়তা চান সেনাপ্রধান
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ সেসময়ের ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির কাছে চাকরির নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত প্রণব মুখার্জি ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স’ এ জানান, মইন উ আহমেদের আশঙ্কা ছিল, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হবে। তার চাকরির দায়িত্ব প্রণব মুখার্জি ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন।
ছবি: DW / Samir Kumar Dey
সুজাতা সিংয়ের বিতর্কিত সফর
২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এমন অবস্থানে অনড়৷ সেবছরের পাঁচ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা নির্বাচন৷ ঠিক এক মাস আগে ঢাকা সফর করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। অনকের দাবি, সুজাতা সিং জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে আসতে অনুরোধ জানান৷ এর ফলে বিএনপিকে ছাড়া আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচন আয়োজন সহজ হয়৷
ছবি: DW
পুলিশ রাতে ব্যালট ভর্তি করেছে: জাপানের রাষ্ট্রদূত
দ্বাদশ নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই একাদশ নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করে আলোচনায় আসেন জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে গত নির্বাচনে (২০১৮ নির্বাচনে) পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার যে অভিযোগ উঠেছে, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে কখনোই এমনটা শুনিনি। আশা করি আগামী নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। জাপান আশা করে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে।’’
ছবি: U.S. Embassy Dhaka
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি
সম্প্রতি বাংলাদেশের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ ৷ ২৪ মে ঘোষিত ওই ভিসানীতিতে বলা হয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করলে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে৷ এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি চ্যানেল 24-কে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ইউরোপের বাজারে ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধার দুয়ার খুলতে পারে।
সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি সমুন্নত রাখার প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রতি চীনের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে বলে জানিয়েছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন। অবশ্য এক সপ্তাগ আগে গত শুত্রবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উপহারসামগ্রী পাঠিয়েছে ঢাকার চীনা দূতাবাস।