‘‘রাজনৈতিক চর্চা না থাকায় ভূঁইফোড় সংগঠন বিকশিত হচ্ছে’’
৩০ জুলাই ২০২১ডয়চে ভেলে : সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে চাকরিজীবী লীগ৷ সবগুলো রাজনৈতিক দলেই তো এমন অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন আছে৷ কী উদ্দেশ্যে এই ধরনের সংগঠন হয়?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অঙ্গ সংগঠনগুলো সাধারণত মতাদর্শগত কারণে তৈরি হয়৷ মূল রাজনৈতিক দলের মতাদর্শগত যে অবস্থান, অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের একই মতাদর্শ হবে৷ রাজনীতির আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে৷ এই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নানা ধরনের গণসংগঠন থাকে, শ্রেনি, ছাত্র, মহিলা বা শ্রমিক সংগঠন থাকে৷ আমার অভিজ্ঞতা বলে, নিয়ম এইটা৷ এই ক্ষেত্রে কী হয়েছে সেটা আরেকটা ব্যাপার৷ নিশ্চয়ই এক্ষেত্রে সেভাবে হয়নি৷ এখানে যেটা হয়েছে, আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য যতটা না, তার চেয়ে বেশি হয়েছে নিজেদের সুবিধা প্রতিষ্ঠার জন্য৷ যে কারণে মূল যে সংগঠন আওয়ামী লীগ এটা নজরে এনেছে এবং এর উদ্যোক্তাকে দল থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে৷
আমরা দেখেছি, শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করেই গড়ে উঠেছে প্রায় ১০০ সংগঠন৷,যারা নামের আগে-পরে ‘বঙ্গবন্ধু', ‘আওয়ামী' কিংবা ‘লীগ' শব্দ জুড়ে দিয়ে নতুন সংগঠন করছে৷ এরা তো বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানাও ব্যবহার করছে৷ নীতি নির্ধারকরা এটা জানেন না?
অবশ্যই জানার কথা৷ বোঝাই যাচ্ছে, এই ধরনের ভূঁইফোড় সংগঠন সুবিধার জন্য করা হয়েছে৷ এটা তো পরিস্কার মতাদর্শগত কারণে নয়, সুবিধার জন্য এটা করা হয়েছে৷ তাদের জানা উচিত এবং নিরুৎসাহিত করা উচিত৷ এগুলো তো যারা সরকারে আছে তাদের নাম ব্যবহার করছে৷ কাজেই তারা সুযোগ-সুবিধা নিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এটা করেছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে৷ এই কারণে এদিকে তাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার৷ এক্ষেত্রে যেটা তারা পরে দিয়েছেন৷
এই ধরনের ধান্ধাবাজি বন্ধ করতে না পারলে কি রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে না?
হ্যাঁ, অবশ্যই হবে৷ এটা তো রাজনীতি না৷ এই ধরনের সংগঠন সুবিধার জন্য তৈরি করা হয়৷ এখানে অবশ্যই রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে, কেননা, এদের কারণে যে বদনাম, সেটা তো মূল রাজনৈতিক দলের উপরই পড়বে৷ এগুলো এক ধরনের উৎপাতের মতো কাজ করে৷ তারা মূল যে সংগঠন তার কোনো উপকার করছে না৷ বরং তারা নিজেদের সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে৷ মূল রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তাকেও কমিয়ে আনছে৷
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস বা অন্যান্য বিশেষ দিবসে এরা তো অর্থ সংগ্রহে নামে৷ এতে করে কি মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে না?
অবশ্যই তারা এটা করে৷ দেখা যাচ্ছে পাড়া-মহল্লায় এগুলো যারা করে, তারা নিজেদের উদ্দেশ্যে করে৷ আদর্শগত কোনো বিষয় না৷ শুধুমাত্র নিজেদের সুবিধার জন্য৷ এটাকে আমরা খুব সরলভাবে বলতে পারি, এটা চাঁদাবাজি৷ এর ফলে অনেকেই চাঁদা দিতে বাধ্য হয়, তাদের উপর এক ধরনের অত্যাচার৷ এতে নিশ্চয় রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে৷ দলের জনপ্রিয়তার উপর নিশ্চয় একটা ছায়া ফেলছে৷
এই ধরনের তৎপরতা তো অনেকদিন ধরেই চলছে৷ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে এদের নিয়ন্ত্রণ কি অসম্ভব হয়ে পড়ছে?
মোটেই অসম্ভব হওয়ার কথা না৷ তারা তো বলে দিলেই হয়, এদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷ এদের নিষেধ করে দিলেই হয়৷ এদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ নেই বা এরা আমাদের কেউ না- এটা জানিয়ে দেওয়ার নানা ধরনের পদ্ধতি আছে৷ সেই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করলে নিশ্চয়ই এরা ঝড়ে পড়বে৷ তখন এরা আর তৎপর থাকতে পারবে না৷ রাজনৈতিক দলগুলোর অসহায় বোধ করার কোনো কারণ নেই৷ এটা তো একটা বিড়ম্বনা৷
ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন কিংবা নির্বাচনবিহীন পরিস্থিতি কি এই অবস্থার জন্য দায়ী?
হ্যাঁ, যেখানে রাজনীতির স্বচ্ছ বা জবাবদিহিমূলক ধারা নেই, গণতান্ত্রিক ধারার অভাব হয়, তখনই এগুলো হয়৷ রাজনীতির যদি নানান ধরনের তৎপরতা চলতে থাকে, গণতান্ত্রিক তৎপরতা চলতে থাকে, তাহলে এরা আসবে না৷ কারণ, এরা তখন সুবিধা করতে পারবে না৷ এরা তো ওই কাজে নেই, এদের কাজ তো সুবিধা আদায় করা৷ যেখানে অন্য দলের উপস্থিতি নেই, সেই সুযোগটা তারা নিচ্ছে৷ সঠিক রাজনৈতিক চর্চার সংস্কৃতি না থাকলে এগুলো বিকশিত হয়৷
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও জবাবদিহিতা না থাকায় কি এমন হচ্ছে?
যদি নিয়মিত নির্বাচন হয়, তাহলে জনগণও রাজনৈতিক দলের লোকজনকে চিনতে পারে কে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত৷ তখন মানুষ বুঝতে পারে এরা ওই রাজনৈতিক দলের নয়, ফলে তারা সুবিধা করতে পারবে না৷ তখন মানুষই বুঝতে পারে এরা অননুমোদিত সংগঠন৷
বর্তমান সংস্কৃতিতে রাজনীতিকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হচ্ছে? আসলে কি তাই?
মোটেই না৷ রাজনীতি তো বিনিয়োগ হতেই পারে না৷ এটা তো খুবই আপত্তিকর কথা৷ মুনাফা লিপ্সা আর রাজনীতি তো কখনোই একসঙ্গে যাবে না৷ রাজনীতি হচ্ছে রাষ্ট্রের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত৷ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, জনগণের কল্যাণ করা, নিরাপত্তা দেওয়া, সুবিধা-অসুবিধা দেখা৷ এই চিন্তা থাকলে তখন আর সুবিধাবাদিতা আসে না৷
দুর্নীতি থেকেই কি দুর্বৃত্তায়নের জন্ম হচ্ছে না?
হ্যাঁ, এটাও দুর্নীতির একটা অংশ বলা যেতে পারে৷ অঙ্গ সংগঠনের নাম করে সুবিধা আদায় করা, অবৈধ তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া বা ক্ষমতা প্রদর্শন করা এগুলো তো দুর্নীতির মধ্যেই পড়বে৷ আমাদের সমাজে যে দুর্নীতির ব্যাপকতা তারই একটা প্রতিফলন এটা বলতে পারেন৷ এখন মানুষ ন্যায়, অন্যায় বিবেচনার মধ্যে নেয় না, তারা শুধু মুনাফা দেখে৷ ফলে এখন যেগুলো হচ্ছে সেটা শুধুই মুনাফার জন্য৷ এই সংগঠনগুলোতে যারা আসে তারা শুধু মুনাফার জন্যই আসে৷ তারা আদর্শগত কারণে আসে না৷
দুর্নীতি দমন কমিশন কি এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা নিতে পারে?
আমার মনে হয়, অতদূর যাওয়ার দরকার নেই৷ এটা রাজনৈতিক দলেরই কর্তৃব্য৷ তারাই তো এদের অস্বীকার করতে পারে, বাদ দিয়ে দিতে পারে৷ দুর্নীতি দমন কমিশনের তো অনেক কাজ আছে৷ বড় বড় দুর্নীতিই তো তারা সামলাতে পারছে না৷ সেখানে এতটা প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না৷ দায়িত্বটা আসলে দলেরই৷ এক্ষেত্রে তো বোঝাই গেল, দল ইচ্ছে করলেই পারে এদের নিবৃত্ত করতে৷
কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ সম্ভব?
আমাদের বাংলাদেশে এখন যেটা দরকার সেটা হলো একটা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা৷ যেখানে মানুষ নিজেদের অধিকারের জন্য সংগঠিত হবে, সুবিধার জন্য নয়৷ সুবিধা মানে এই ধরনের আর্থিক সুবিধার জন্য নয়৷ নিজেদের একটা আদর্শগত অবস্থান থাকবে৷ তারা বলবে, আমরা দেশটাকে এইভাবে দেখতে চাই৷ আমরা আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্রটাকে এইভাবে গঠন করতে চাই৷ ওই রাজনীতি যখন থাকবে তখন এই সমস্ত উৎপাত আর থাকবে না৷