রাজাকারের তালিকায় ভুল অনিচ্ছাকৃত উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক৷ সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম কিভাবে এসেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি৷
বিজ্ঞাপন
রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক৷ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন৷
বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘‘অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে এ তালিকায় বেশ কিছু নাম এসেছে, যারা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তিকমিটি বা স্বাধীনতাবিরোধী নন বরং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বা মুক্তিযোদ্ধা৷ এ ধরনের কোনো ব্যক্তির নাম তালিকায় কিভাবে এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷’’
প্রকাশিত তালিকায় ভুলভাবে কারও নাম এসে থাকলে আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই করে তা বাদ দেয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন মন্ত্রী৷ বলেন, ‘‘এই প্রকাশিত তালিকায় অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত৷’’
উল্লেখ্য, গত ১৫ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধীদের ১০ হাজার ৭৮৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়৷ পরে সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নাম থাকার অভিযোগ উঠে৷ বিবৃতিতে মোজাম্মেল হক জানান, ‘‘ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে নতুন কোনো তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে তালিকা যেভাবে পাওয়া গেছে সেভাবেই প্রকাশ করা হয়েছে৷’’
এফএস/কেএম
যেমন করে রাজাকার নামটি ঘৃণিত হলো
রাজাকার বাংলাদেশে এখন এক ঘৃণিত শব্দ৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে এই বাহিনী গঠন করেছিল পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার৷ পরবর্তীতে তারা হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷
ছবি: DW/M. Mamun
শব্দটি যেভাবে এল
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী রাজাকার ফারসি শব্দ৷ যার অর্থ স্বেচ্ছাসেবী৷ ১৯৪০ এর দশকে ভারতের হায়দ্রাবাদের নিজাম ওসমান আলী খানের শাসনামলে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন কাসেম রিজভী৷ এই বাহিনীর নাম দেয়া হয়েছিল রাজাকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Desfor
পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনী
হায়দ্রাবাদের সেই সশস্ত্র বাহিনীর অনুকরণেই ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার৷ মে মাসে খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন কর্মী নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়৷ ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মো. ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়৷ শুরুতে ১০টি জেলায় ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাদের রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
শান্তি কমিটি থেকে সেনাবাহিনী
বাংলাপিডিয়া বলছে, ‘‘প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন৷ ১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন৷ এর নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে৷ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত অধ্যাদেশে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনী সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়৷’’
ছবি: AP
প্রশিক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন৷ ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় এই বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়৷ ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে সাভারে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন জেনারেল এ.কে নিয়াজি৷ পরবর্তী পর্যায়ে এই বাহিনীকে একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদা দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
রাজাকারের সংখ্যা
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস এর গবেষণা অনুযায়ী রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো৷ জেনারেল নিয়াজী তার বইতে এই সংখ্যা উল্লেখ করেছেন৷ স্বাধীনতার পর রাজাকারদের বিচারে ৩৭ হাজার জনের একটি তালিকা করা হয় বলে জানা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
‘দুষ্কৃতকারী’ নিধন
পাকিস্তানপন্থী পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হত ভারতীয় চর, দুষ্কৃতকারী হিসেবে৷ ‘রাজাকররা ৭০ জন দুষ্কৃতকারী হত্যা করেছে’, ‘ভারতীয় চরকে নির্মূল করেছে’, এমন শিরোনামে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় গ্রামে-গঞ্জে অত্যাচার, নির্যাতন এবং সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী পথপ্রদর্শক৷’’
ছবি: Adnan Sadeque
আলবদরের সঙ্গে পার্থক্য
সেপ্টেম্বরে নিয়াজী গড়ে তোলেন আরেকটি আধা সামরিক বাহিনী আলবদর৷ বাংলাপিডিয়ায় মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘‘রাজাকারদের কার্যকলাপের সঙ্গে খানিকটা পার্থক্য ছিল আল-বদর বাহিনীর৷ রাজাকাররা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতা করেছে৷ কিন্তু আল-বদর বাহিনীর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক হত্যার মাধ্যমে নিরীহ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা৷ পাকিস্তান বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করা ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য৷’’
ছবি: Journey/A. Hoque
‘তুই রাজাকার’
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক বহুব্রীহি৷ সেখানে একটি টিয়া পাখিকে ‘তুই রাজাকার’ বলতে শোনা যায়৷ এই সংলাপ পরবর্তীতে রূপ নেয় রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের স্লোগানে৷ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতেও ব্যবহার হয়েছে এই শব্দগুচ্ছ৷