অবশেষে চূড়ান্ত হচ্ছে একাত্তরে ভাতা পাওয়া রাজাকারদের তালিকা৷ পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে, তালিকা চূড়ান্ত করতে গিয়ে জেলা প্রশাসকরা অনেক বাধার সন্মুখীন হতে হয়েছিলেন৷ সেগুলো কতটা অতিক্রম করা গেছে তা দেখার বিষয়৷
বিজ্ঞাপন
এক দশক আগে যখন একাত্তরে মানবতাবিরোধীদের বিচার শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে, তখন থেকেই রাজাকারের তালিকা তৈরির দাবি উঠতে থাকে৷ রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের এ বছরের মাঝামাঝি জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ কিন্তু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তালিকা প্রস্তুত করতে গিয়ে জেলা প্রশাসকরা সে সময় বেশ কয়েক রকমের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন৷
চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি ছিল ৪৮ বছর আগের ঘটনার যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না৷ দ্বিতীয়ত, সে সময়কার বাংলাদেশের বিশটি জেলার প্রশাসকের কার্যালয়ে পাকিস্তান সরকারের ভাতা নেয়াদের তালিকাও পুরোপুরি মিলছে না৷ তৃতীয়ত, দেশ স্বাধীন হবার পর যাদের বিরুদ্ধে দালাল আইনে মামলা হয়েছে, সে সংখ্যাও খুব বেশি নয় (যুগান্তর, অক্টোবর ২০১৯)৷
যেমন করে রাজাকার নামটি ঘৃণিত হলো
রাজাকার বাংলাদেশে এখন এক ঘৃণিত শব্দ৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে এই বাহিনী গঠন করেছিল পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার৷ পরবর্তীতে তারা হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷
ছবি: DW/M. Mamun
শব্দটি যেভাবে এল
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী রাজাকার ফারসি শব্দ৷ যার অর্থ স্বেচ্ছাসেবী৷ ১৯৪০ এর দশকে ভারতের হায়দ্রাবাদের নিজাম ওসমান আলী খানের শাসনামলে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন কাসেম রিজভী৷ এই বাহিনীর নাম দেয়া হয়েছিল রাজাকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Desfor
পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনী
হায়দ্রাবাদের সেই সশস্ত্র বাহিনীর অনুকরণেই ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার৷ মে মাসে খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন কর্মী নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়৷ ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মো. ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়৷ শুরুতে ১০টি জেলায় ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাদের রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
শান্তি কমিটি থেকে সেনাবাহিনী
বাংলাপিডিয়া বলছে, ‘‘প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন৷ ১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন৷ এর নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে৷ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত অধ্যাদেশে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনী সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়৷’’
ছবি: AP
প্রশিক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন৷ ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় এই বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়৷ ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে সাভারে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন জেনারেল এ.কে নিয়াজি৷ পরবর্তী পর্যায়ে এই বাহিনীকে একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদা দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
রাজাকারের সংখ্যা
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস এর গবেষণা অনুযায়ী রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো৷ জেনারেল নিয়াজী তার বইতে এই সংখ্যা উল্লেখ করেছেন৷ স্বাধীনতার পর রাজাকারদের বিচারে ৩৭ হাজার জনের একটি তালিকা করা হয় বলে জানা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
‘দুষ্কৃতকারী’ নিধন
পাকিস্তানপন্থী পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হত ভারতীয় চর, দুষ্কৃতকারী হিসেবে৷ ‘রাজাকররা ৭০ জন দুষ্কৃতকারী হত্যা করেছে’, ‘ভারতীয় চরকে নির্মূল করেছে’, এমন শিরোনামে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় গ্রামে-গঞ্জে অত্যাচার, নির্যাতন এবং সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী পথপ্রদর্শক৷’’
ছবি: Adnan Sadeque
আলবদরের সঙ্গে পার্থক্য
সেপ্টেম্বরে নিয়াজী গড়ে তোলেন আরেকটি আধা সামরিক বাহিনী আলবদর৷ বাংলাপিডিয়ায় মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘‘রাজাকারদের কার্যকলাপের সঙ্গে খানিকটা পার্থক্য ছিল আল-বদর বাহিনীর৷ রাজাকাররা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতা করেছে৷ কিন্তু আল-বদর বাহিনীর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক হত্যার মাধ্যমে নিরীহ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা৷ পাকিস্তান বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করা ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য৷’’
ছবি: Journey/A. Hoque
‘তুই রাজাকার’
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক বহুব্রীহি৷ সেখানে একটি টিয়া পাখিকে ‘তুই রাজাকার’ বলতে শোনা যায়৷ এই সংলাপ পরবর্তীতে রূপ নেয় রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের স্লোগানে৷ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতেও ব্যবহার হয়েছে এই শব্দগুচ্ছ৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press
8 ছবি1 | 8
এর বাইরে জড়িতদের অনেকেই মারা গেছেন- এটিও একটি কারণ৷ আর যারা জীবিত রয়েছেন তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ কারও কারও মৃত্যুদণ্ডসহ নানা মেয়াদে শাস্তি হয়েছে৷ আবার কেউ কেউ ক্ষমতাসীন দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন৷
এছাড়া স্থানীয়ভাবে যাদের নাম পাওয়া যাচ্ছে, এর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণেও আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ এ অবস্থায় এসব বাধা ডিঙ্গিয়ে একটি সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা জরুরি৷
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই তালিকা হতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত৷ কারণ, এটা ইতিহাসের অংশ৷ আমরা দেখেছি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বার বার কাজ হয়েছে৷ কিন্তু আজও এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা সম্ভব হয়নি৷ তালিকায় শুধু বারবার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাই বেড়েছে৷ তারপরও পেশাগত কাজে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ আজও সনদ পাননি বা নেননি৷ তালিকায় ঠাঁই হয়েছে কি হয়নি তা জানেন না৷ তাই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার যেমন ঠাঁই হয়নি, সেটা যে কারণেই হোক না কেন, তেমনটি যেন এই তালিকার ক্ষেত্রে না হয়৷ রাজাকারদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা জরুরি৷ কেউ যেমন বাদ না পড়েন, তেমনি ভুল করে কারও নাম যেন চলে না আসে৷
আরেকটি বিষয় হলো, বেতনভুক্ত রাজাকার ছাড়াও আরো যারা একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে কী হবে? এ বিষয়টিও পরিষ্কার করা দরকার৷ কারণ, সাধারণভাবে রাজাকার বলতে একাত্তরে সাধারণভাবে যারা পাকবাহিনীকে সমর্থন করেছিল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত হয়েছিল, তাদের বোঝানো হয়ে থাকে৷
গেল মে মাসে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির যে বৈঠকটি হয়েছিল সেখানে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের আসনগুলো অবৈধভাগে শূন্য ঘোষণা করে তাদের জায়গায় যাদের সংসদ সদস্য করা হয়েছিল তাদের নামও তালিকায় যুক্ত করার কথা বলা হয়৷ এছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠনের নামও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে একটি কমিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল৷ চূড়ান্ত তালিকায় এসবও রাখা হবে কি না তা পরিষ্কার নয়৷ তবে সবচেয়ে বড় কথা এ তালিকা ইতিহাসের দায়মুক্তির তালিকা৷ এখানে ভুল গ্রহণযোগ্য নয়৷ তাই তাড়াহুড়ো করে তা প্রণয়ন করা ঠিক হবে না৷ প্রয়োজন হলে আরো সময় নেয়া যেতে পারে৷