1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাজা যথা, চাঁদাবাজি তথা!

১ আগস্ট ২০২৫

পুলিশ থেকে শুরু করে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোকে চাঁদা দিয়েই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের, হোক সে ক্ষুদ্র, মাঝারি কিংবা বড়, ব্যবসা করতে হয়।

শুধু কৃষক নয়, বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোতে এমন কোনো ফুটপাত নেই, এমন কোনো বিপণি বিতান নেই, যেখানকার ব্যবসায়ীদের চাঁদা বা মাসোহারা দিতে হয় না।ছবি: Mortuza Rashed/DW

আকবর আলি খানের একটি বই খুব জনপ্রিয়। বইটির নাম হলো ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি'। সেই বইয়ে তিনি সাধারণ মানুষের হয়ে লিখেছেন, "হুজুর, আমরা আপনার কাছে উপকার চাই না, শুধু মেহেরবানি করে আপনার শুয়োরের বাচ্চাদের সামলান।” এই হুজুর হলো সরকার মহাশয় বা ক্ষমতাসীনরা। আর শুয়োরের বাচ্চা হলো সরকার বা প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় যারা জনগণের রক্ত চুষে খায়। এরা কখনো সরকারী উর্দিতে, কখনো বা সরকার সমর্থক হয়ে বেসরকারি বাহিনী হিসেবে বর্গি বাহিনীর মতো কাজ করে। সাম্প্রতিক প্রবণতার দিকে খেয়াল রেখে এই রক্তচোষাদের বলতে পারি, এদের একটি রূপ হলো চাঁদাবাজ। বাংলাদেশে চাঁদাবাজি নতুন কিছু না। চাঁদাবাজরা আগেও ছিল, এখনো আছে। রাজনৈতিক পালাবদলে ক্ষমতাসীনদের পরিচয় পাল্টায়, কিন্তু শোষণের রং একই থাকে। কখনো কখনো তা আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। ক্ষমতার সূত্র ধরে চাঁদাবাজরাও ঘুরে ফিরে আসে। দু-চারটি ঘটনা যখন সংবাদমাধ্যমে, হাল-আমলের সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে জনসমক্ষে উঠে আসে, তখন সমাজে হা-হুতাশ দেখা যায়। এক সময় বুলবুলিতে ধান খেয়ে ফেলায় বর্গিদের অত্যাচারের কথা ভেবে বাংলার কৃষককে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হতো। এখন বর্গি না থাকলেও কৃষককে চাঁদা দিতে হয়। চলতি বছরের ২৫ মার্চ রাজশাহীর একটি দৈনিকের খবরের শিরোনাম ছিল ‘গভীর নলকূপের পানি নিয়ে কৃষকের সাথে চাঁদাবাজি'। শুধু কৃষক নয়, বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোতে এমন কোনো ফুটপাত নেই, এমন কোনো বিপণি বিতান নেই, যেখানকার ব্যবসায়ীদের চাঁদা বা মাসোহারা দিতে হয় না।

চাঁদাবাজির অর্থে চলে সোমালিয়ার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী

03:15

This browser does not support the video element.

পুলিশ থেকে শুরু করে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোকে চাঁদা দিয়েই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের, হোক সে ক্ষুদ্র, মাঝারি কিংবা বড়, ব্যবসা করতে হয়। কৃষি থেকে পরিবহণ, শিল্প থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব সেক্টরে চাঁদাবাজির জয় জয়কার। বিষয়টি হয়ে গেছে এমন – বাংলাদেশে চাঁদাবাজি একটা ব্যাধি, জনম-জনম ধরে বহন করতে হবে এমন একটি রোগ। যেটুকু শরগোল দেখা যায়, তার অর্থ হলো যতটুকু পারা যায় সহনশীল মাত্রায় রেখে এই রোগকে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টার জন্য এক ধরনের আরোপিত ব্যবস্থা তৈরি করা। কারণ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে যে শোরগোল বাংলাদেশে দেখা যায়, সেটি আসলে এই অপকর্মটির বিরুদ্ধে নয়, কিংবা এটিকে শক্তহাতে দমনের অভিপ্রায় থেকে নয়; বরং শোরগোলটি প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য তোলা হয়। সাম্প্রতিক সময়ের দুটি উদাহরণে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। মিটফোর্ড হাসপাতালে চাঁদাবাজির জন্য নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর এই মুহূর্তে মাঠে থাকা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারে নেমেছিল তার প্রতিপক্ষরা। তার কয়েকদিন পর ৫ সমন্বয়ক চাঁদাবাজি করতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তারের পর থেকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির বিরুদ্ধে একহাত নিতে দেখা যাচ্ছে। এই শোরগোলে চাঁদাবাজি যে মহামারি হয়ে গেছে, সেটি মূখ্য বিষয় নয়। বিষয় হলো এর বদৌলতে যে যার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চাচ্ছে। এটি আগেও হয়েছে। এ কারণে ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে আপেক্ষিকতার তত্ত্বে মানবাধিকার, সমঅধিকার, সুশাসন, ন্যায়পরায়ণতা – নতুন রূপে এসবের ব্যাখ্যা উঠে আসে। যখন যে ক্ষমতায় থাকে, সে তার মত করে এগুলোর জন্য ব্যাখ্যা দাঁড় করায়। কিন্তু বর্গি আর বুলবুলির আক্রমণ থেকে জনগণ কখনই নিজেদের রক্ষা করতে পারে না।

চাঁদাবাজি বাংলাদেশের জন্য কোনো নতুন সমস্যা নয়; এটি স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এক দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান।

ঢাকা শহরের ফুটপাথের দৃশ্য৷ছবি: Mortuza Rashed/DW

সময়ের সাথে সাথে এই সমস্যা কেবল বেড়েছেই। জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার পটপরিবর্তন বাংলাদেশের মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। সুশাসন ও জননিরাপত্তার নতুন দৃষ্টান্ত তৈরির প্রতিশ্রুতি দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সেটিকে কালো মেঘে ঢেকে ফেলার জন্য গত ১১ মাসে বাংলাদেশে অনেক কিছু হয়েছে। যার একটি হলো চাঁদাবাজির পুরোনো ভূত ফিরে আসা। চাঁদাবাজির সমস্যা কেবল ব্যক্তিগত বা বিচ্ছিন্ন অপরাধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটিকে একটি সুসংগঠিত চক্র বলা যেতে পারে, যা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে তার জাল বিস্তার করেছে। চাঁদাবাজরা হয় ক্ষমতাসীন হয়ে থাকেন, আর না হলে ক্ষমতাসীনদের বন্ধু হয়ে থাকেন। কেউ বর্গি, কেউ বুলবুলি – যাদের ভয়ে সাধারণ মানুষকে তটস্থই থাকতে হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারসহ সব সরকারের আমলেই একটা বিষয় পরিষ্কার, ক্ষমতাবানরাই এই চাঁদাবাজ হওয়ায় সরকারগুলো কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয় না। মাঝে মাঝে ভাইরাল হয়ে পড়লে বিষয়টি সাময়িক ধামাচাপা দিতে আটক-গ্রেপ্তার-রিমান্ড খেলা চলে। কিন্তু কাদের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি চলে তাদের স্বরূপ আর জানা যায় না। শুধু যেটি দেখা যায়, সেটি হলো – চাঁদাবাজির কৌশল সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়, কিন্তু এর মূল চরিত্র অপরিবর্তিতই থেকে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন, ‘‘রাজনৈতিক সমঝোতা করা খুব কঠিন কাজ, সে তুলনায় চাঁদাবাজির সমঝোতা অনেক সহজ।'' তিনি আরো বলেছেন, যখন চাঁদাবাজদের এক দল চলে যায়, তখন অন্য দল অনিবার্যভাবে ওই শূন্যস্থানে চলে আসে। এই পর্যবেক্ষণ একটি গভীরতর ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে চাঁদাবাজি কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং এটি রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখার একটি কৌশলগত হাতিয়ার। এর অর্থ হলো, রাজনৈতিক পালাবদলের পর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল, নতুন সরকার চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবে এবং একটি স্বচ্ছ ও সুশাসিত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চাঁদাবাজির চক্র এখনো সক্রিয়। কেবল এর চেহারা এবং নিয়ন্ত্রণকারীদের হাতবদল হয়েছে মাত্র। একটি চক্রের পতনের পর অন্য একটি চক্র সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে চাঁদাবাজি কেবল নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের সমস্যা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির একটি গভীর প্রোথিত কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য। এই ধারাবাহিকতা থেকে বোঝা যায়, চাঁদাবাজি কেবল বিচ্ছিন্ন অপরাধমূলক কাজ নয়, বরং এটি ক্ষমতা দখলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা রাজনৈতিক পরিবর্তনের মুখেও টিকে থাকে এবং নতুন অভিনেতারা দ্রুতই পুরোনো পদ্ধতি গ্রহণ করে। কথায় আছে, রাজা যথা, প্রজা তথা। কথাটির অর্থ হলো, রাজা যেমন হয়, প্রজারাও তেমনই হোন। বাংলাদেশের জন্য কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, রাজা যথা, চাঁদাবাজ তথা। মানে চাঁদাবাজির ধরন কেমন হবে সেটি শাসনব্যবস্থা কেমন তার ওপরই বেশি নির্ভর করে। যেমন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের ধরনে এটি স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সব ধরনের যৌক্তিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করা। সে সূত্র ধরে বর্তমান সময়ের চাঁদাবাজদের লক্ষ্য সাবেক ক্ষমতাসীনরা।

নবগঠিত এনসিপি, যা জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত, দল গঠনের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই চাঁদাবাজি ও তদবির বাণিজ্যের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মতো একটি জনমুখী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির ঘটনাগুলো দেখায় যে কীভাবে ক্ষমতার শূন্যতা এবং জনপ্রিয় আন্দোলনগুলো, যদি সঠিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও জবাবদিহিতার আওতায় না আসে, তাহলে দ্রুতই নতুন করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের পথ তৈরি করতে পারে, যা পুরোনো চক্রের মতোই কাজ করে। এটি প্রমাণ করে যে চাঁদাবাজির পদ্ধতি পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য এবং প্রভাব একই থাকে। আওয়ামী লীগ শাসনামলেও দেখা যেতো দলীয় ব্যানারে অসংখ্য ভূঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য।

বাংলাদেশে যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক চাঁদাবাজির ধারা বিদ্যমান সেটি মূলত একটি অদৃশ্য, কিন্তু ব্যাপকভিত্তিক 'ট্যাক্স' হিসেবে কাজ করে। পরিবহন খাত চাঁদাবাজির অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র, যেখানে 'ভয়াবহ চাঁদাবাজি' নতুন রেকর্ড ছুঁয়েছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরে ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল/স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন আনুমানিক ২.২১ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়, যা মাসিক ৬০-৮০ কোটি টাকায় পৌঁছায়। সারাদেশে বাস ও মিনিবাস খাত থেকে বছরে প্রায় ১,০৫৯ কোটি টাকা অবৈধভাবে আদায় করা হয়। হাট-বাজারের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজির শিকার হন, যার পেছনে স্থানীয় রাজনীতি ও তথাকথিত সংগঠনগুলোর ছত্রছায়া কাজ করে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে পণ্য সরবরাহ বন্ধ, ব্যবসা বন্ধের হুমকি বা সরাসরি হামলার মুখোমুখি হতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, টেন্ডার, নির্মাণ কাজ, জলমহাল ও বালুমহালের ইজারা—সবখানেই দলীয় ও প্রশাসনিক মদদপুষ্ট চাঁদাবাজ চক্র সক্রিয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্য অনুযায়ী, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি)-তে ২০০৯-২০২৩ সালের মধ্যে ১৩-২৪ বিলিয়ন ডলার (১.৬১-২.৮০ লাখ কোটি টাকা) দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির কারণে নষ্ট হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সীমান্ত অঞ্চলে সশস্ত্র চাঁদাবাজ চক্র বছরের পর বছর ধরে অবৈধ আদায়ে লিপ্ত।

৫ আগস্টের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাহীন বা ক্ষমতা যারা হারিয়েছেন কিংবা দুর্বলের ওপর মব তৈরি করে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। মবের ভয় দেখিয়ে কিংবা গ্রেপ্তার আতঙ্ক তৈরি করে কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের খবর ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে একের পর এক উঠে আসছে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আরো একটি বিষয় খুব দৃশ্যমান। সেটি হলো দুর্বল বা ক্ষমতাচ্যুতদের সব কিছু দখলে নেয়া। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিরো-সাম-গেম নীতি খুব প্রকট। যে জিতে সে সব লুটে নেয়, আর যে হারে তার সব কেড়ে নেয়া হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের কার্যালয়গুলো দখল বা ধ্বংসের শিকার হয়েছে। অনেক জেলায় আওয়ামী লীগ কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কোথাও আবার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু কার্যালয় বিএনপির দখলে চলে গেছে, আবার কিছুতে এনসিপি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল করেছে। এমনকি কিছু কার্যালয় ফলের দোকান বা গণশৌচাগারে পরিণত হয়েছে। জুলাইয়ের চেতনার নাম দিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল করার যে চেষ্টা সেটি ভবিষ্যতের জন্য একটি জঘন্য রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত তৈরি করা হচ্ছে। এটি দেখায় যে, ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে অবৈধ দখলদারিত্বের সুযোগও তৈরি হয়, যেখানে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ হাসিল করা হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দখল বাণিজ্য আর চাঁদাবাজির ব্যাপকতা চলতে থাকলেও ‘সরকারের জেগে জেগে ঘুমানোর নীতি' কার্যত পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। বিশেষ করে মবের ভয় দেখিয়ে যেখানে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে, সেখানে মবকে প্রেশার গ্রুপ আখ্যা দেয়ার সরকারী চেষ্টা এই প্রশ্ন উত্থাপন করে যে, ঘটনাগুলো সরকারের কিংবা সরকারের শক্ত পক্ষগুলোর প্রচ্ছন্ন সমর্থনে হচ্ছে কীনা? যদিও সরকার ঘুম পাড়ানি গানের মতো ‘জিরো টলারেন্স' নীতির কথা বলে থাকে। কিন্তু কার্যত এ নীতি ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতার মূলে রয়েছে প্রশাসন ও আইনের নীরবতা। এই নীরবতা কেবল নিষ্ক্রিয়তা নয়, বরং এটি একটি জটিল ব্যবস্থার ফল, যেখানে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক। এমনিক বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল একই নীতির কথা বলেছে। দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণাও দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে পুলিশ ও প্রশাসন প্রায়শই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। যারা চাঁদা দিতে অস্বীকার করে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হুমকি বা জেল-জুলুমের ঘটনাও ঘটে। মামলার তদন্ত প্রায়শই দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হয়। ‘তদন্ত চলছে' অজুহাতে প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যা এক বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে। চাঁদাবাজির শিকার বেশিরভাগ মানুষ অভিযোগ দায়ের করেন না।

সমস্যাটি বাংলাদেশের ‘রাজনৈতিক পচন'-এর মূলে নিহিত, যেখানে রাজনীতিকে দ্রুত অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে দেখা হয়। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও দুর্নীতি অব্যাহত আছে, এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই নেটওয়ার্কগুলো ভেঙে দিতে বা দুর্নীতির সংস্কৃতি সংস্কারে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স' নীতি একটি বৈপরীত্যের জন্ম দিয়েছে। মুখে এই নীতির প্রতি অঙ্গীকার থাকলেও, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, প্রাতিষ্ঠানিক যোগসাজশ এবং রাজনৈতিক টিকে থাকার জন্য অবৈধ অর্থের উপর নির্ভরতা প্রকৃত ও টেকসই প্রয়োগকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলে। এই নীতি জনসমক্ষে প্রদর্শিত একটি লোকদেখানো কার্যক্রমে পরিণত হয়, যা ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন আনার পরিবর্তে জনতুষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে, যেখানে দুর্বলরা আরও বেশি শোষিত হয়। এভাবে চলতে থাকলে ‘আশার বাতিঘর' হিসেবে যে জুলাই আন্দোলন এসেছিল, তার মূল চেতনাকে যদি এই চাঁদাবাজির বিষবৃক্ষ গ্রাস করে, তবে ‘নতুন বাংলাদেশ'-এর স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ