1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাজা হওয়ার নীতি নয়, নীতির রাজা

প্রভাষ আমিন
১০ ডিসেম্বর ২০২১

অনেকে রাজনীতিকে পেশা মনে করেন৷ কিন্তু রাজনীতি মোটেই পেশা নয়৷ রাজনীতি বৃহত্তর পরিসরে মহত্তর কাজ৷ রাজনীতি হলো, ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, দেশ, তথা বিশ্বের কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা৷

ফাইল ছবিছবি: DW/M. Mamun

রাজনীতিবিদদের থাকার কথা মানুষ হিসেবে উৎকর্ষের শীর্ষে৷ কারণ, তারাই দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা, তারাই নীতিনির্ধারণ করবেন, জনগণ ভোট দিয়ে রাজনীতিবিদদের তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন৷ সাধারণ মানুষের নৈতিক স্খলনও অপরাধ৷ তবে রাজনীতিবিদদের স্খলন বড় অপরাধ৷ কারণ, তারা মানুষের নেতা, সাধারণ মানুষ তাদের অনুসরণ করবে৷ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষের যৌন হয়রানি আর রাজনীতিবিদদের যৌন হয়রানিকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখা হয়৷ রাজনীতিবিদদের হতে হবে নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী৷ অনেক ক্ষেত্রে ‘ছোট অভিযোগে’ অনেক বড় নেতার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়৷ কিন্তু বাংলাদেশে আর সবকিছুর মতো রাজনীতিবিদদের নীতি-নৈতিকতারও অবনমন ঘটছে৷

একসময় দেশের বাম দলগুলোতে ‘ফুলটাইমার’ ছিলেন৷ তারা পার্টির জন্য, তথা দেশের জন্য নিজের গোটা জীবন উৎসর্গ করতেন৷ ‘ফুলটাইমাররা’ পার্টির কাজ ছাড়া আর কিছুই করতেন না৷ পার্টিই তার জীবনধারনের মতো ন্যূনতম অর্থ দিতো৷ সেই দিন এখন সুদূর অতীত কাল৷ রাজনীতি এখন সবচেয়ে লাভজনক পেশা৷ রাজনীতি মানেই অর্থ, ক্ষমতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ৷ জনগণ ভোট দিয়ে রাজনীতিবিদদের নানা দায়িত্ব দেয়৷ কিন্তু দায়িত্ব পেয়েই রাজনীতিবিদরা সেটাকে ক্ষমতায় বদলে নেন৷ যার দায়িত্ব যত বেশি, তার ক্ষমতার দাপট যেন তত বেশি৷ আর ক্ষমতার দাপটে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেন৷ ভুলে যান জনগণকে, তাদের দায়িত্বকে৷

বাংলাদেশে রাজনীতি অনেকদিন ধরেই রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ রাজনীতিতে এখন ব্যবসায়ী আর সাবেক আমলাদের আধিক্য৷ আর এই অনুপ্রবেশের পথ ধরে রাজনীতির মানেরও অবনমন ঘটছে অনেকদিন ধরেই৷ তবে ডা. মুরাদ হাসান সব সীমা ছাড়িয়ে রাজনীতিবিদদের পতনের নিম্ন সীমা নির্ধারণ করে দিলেন৷

একটি গণতান্ত্রিক দেশে বহু দল থাকবে, মত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে, ঝগড়া থাকবে, তর্ক থাকবে, আদর্শের ভিন্নতা থাকবে, আদর্শিক লড়াই থাকবে৷ কিন্তু যুদ্ধের

যেমন কিছু নিয়ম আছে, রাজনীতিরও কিছু প্রথা আছে৷ যেমন, সংসদের ভাষা আর পল্টন ময়দানের ভাষা এক হবে না৷ সংসদে কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অভিযোগও আনা যায় না, বলতে হয় তিনি ‘অসত্য?’ বলেছেন৷ সংসদে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কোনো কথা বলা যায় না৷ মাঠের রাজনীতি হয়ত সংসদের মতো অতটা পিউরিটান নয়৷ কিন্তু তা-ও অলিখিত একটা সীমা আছে৷ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আপনি অবশ্যই তার বিরুদ্ধে বলবেন, যুক্তি দিয়ে তাকে কাবু করবেন৷ কিন্তু বাংলাদেশে অনেক আগেই সংসদ আর পল্টন ময়দানের ফারাক ঘুচে গেছে৷ সংসদেও অশ্লীলতার চর্চা আমরা দেখেছি৷ আর রাজনীতি তো রাজপথ থেকে বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই৷ রাজনীতি চর্চার সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম এখন ভার্চুয়াল জগত- ফেসবুক, ইউটিউব৷

সংসদ, রাজপথ, ভার্চুয়াল- প্ল্যাটফর্ম যাই হোক; রাজনীতির একটা নিয়ম আছে, বিরোধিতার একটা সীমা আছে৷ অতীতে কেউ কেউ সেই সীমা টুকটাক লঙ্ঘন করেছেন এবং তুমুল সমালোচিতও হয়েছেন৷ কিন্তু ডা. মুরাদ হাসান সকল নিয়ম, নীতি, নৈতিকতা, সীমা ভেঙ্গেচুড়ে একাকার করে দিয়েছেন৷

রাজনীতিতে ভিন্নমত, ভিন্ন দল, বিরোধিতা সবসময়ই ছিল৷ কিন্তু আগে পাশাপাশি সৌহার্দ্যও ছিল৷ স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের ভাঙন থেকে সৃষ্টি হয় দেশের প্রথম বিরোধী দল জাসদ৷ সেই জাসদ নানারকমের নাশকতা চালিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পথে বারবার বাধার সৃষ্টি করেছে৷ জাসদের সাথে সরকারের নানা সময় লড়াই হয়েছে৷ জাসদ নেতা-কর্মীরা তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের দমনপীড়নের শিকার হয়েছেন৷ কিন্তু সেই জাসদের আদর্শিক গুরু সিরাজুল আলম খানের গায়ে কখনো টোকাটিও লাগেনি৷ কারণ, বঙ্গবন্ধু তাকে স্নেহ করতেন৷ এমনকি জাসদ বানিয়ে তার ঘুম হারাম করলেও বঙ্গবন্ধু কখনো সিরাজুল আলম খানের ওপর থেকে তার স্নেহছায়া সরিয়ে নেননি৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষ হয়ে নানা যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার দায়ে স্বাধীনতার পর অনেক রাজনৈতিক নেতাকে আটক করা হয়৷ আটক নেতাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যারা স্বাধীনতার আগে রাজনীতির মাঠে বঙ্গবন্ধুর সাথে হেঁটেছেন, পক্ষে হোক বা বিপক্ষে৷ আইনের দৃষ্টিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হলেও বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে তাদের পরিবারের খবর রেখেছেন বলে শুনেছি৷ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল এবং বামদের ৫ দলীয় জোট রাজপথে যুগপত আন্দোলন করেছে৷ তখনও তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল৷ এমনকি স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পরের অন্তত দুটি সংসদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানদের অ্যাকাডেমিক বিতর্ক আমরা দেখেছি৷ তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীদের প্রাণবন্ত বিতর্কে সরগরম থাকতো সংসদ৷ কিন্তু সংসদের বাইরে তাদের বন্ধুত্বের খবর কারো অজানা নয়৷ কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, রাজনীতি থেকে সৌহার্দ্য বিষয়টাই হারিয়ে যাচ্ছে৷ তার জায়গা নিচ্ছে তীব্র ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, অশ্লীল গালাগাল আর কুরুচি৷

স্বাধীনতার পর তখন বিরোধী দলে থাকা মতিয়া চৌধুরী, আ স ম আব্দুর রবরা কট্টর ভাষায় বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করেছেন৷ কিন্তু তারপরও তাদের রাজনীতি করতে কোনো অসুবিধা হয়নি৷ মতিয়া চৌধুরী এখন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক৷ আ স ম আব্দুর রবও প্রথম দফায় শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন৷ একসময়কার প্রবল প্রতিপক্ষ জাসদ এখন আওয়ামী লীগের মিত্র৷ কারণ, বিরোধিতার সময়ও তারা রাজনীতির নিয়মটা ভাঙেননি৷

কথা বলে বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিতে অনেকেই ঝড় তুলেছেন৷ এরশাদের মন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের ‘দুই নারীর মিলনে কিছুই উৎপন্ন হয় না' বা ‘পদত্যাগপত্র কি জিরো পয়েন্টে উড়িয়ে দেবো’ তাকে হাস্যকর করে তুলেছিল৷ স্বৈরাচার পতনের পরও কখনো সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, কখনো ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা মতিন চৌধুরী, এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ চৌধুরী, মহিউদ্দিন খান আলমগীরদের অনেক কথা রাজনীতিতে আলোচিত হয়েছে৷

প্রভাষ আমিন, সাংবাদিক ও লেখকছবি: DW

শাহ মোয়াজ্জেমের পর রাজনীতিতে অশ্লীলতা আনার দায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর৷ যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার কথার কারণে অনেক ঘৃণা কুড়িয়েছেন৷ কিন্তু ডা. মুরাদ হাসানের বক্তব্য শোনার পর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আর অতটা অশালীন মনে হচ্ছে না৷ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অশ্লীলতায় একটা কৌশলের প্রলেপ ছিল, কিছুটা ইঙ্গিত ছিল৷ কিন্তু ডা. মুরাদ হাসান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ১০০-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছেন৷ শাহ মোয়াজ্জেম হোন আর সাকা চৌধুরী; তাদের অশ্লীল বক্তব্যও পত্রিকায় ছাপার মাত্রার ‘অশ্লীল' ছিল৷ কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান বা জাইমা রহমানকে নিয়ে মুরাদ হাসানের

বক্তব্য কোনো পত্রিকাই ছাপার যোগ্য মনে করেনি৷ আর চিত্রনায়িকা মাহিকে দেয়া মুরাদ হাসানের হুমকির ভাষা শুধু পর্নো ছবিতেই হয়ত চলে৷

আগেই যেমন বলেছি, যত দিন যাচ্ছে; বাংলাদেশে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের মানের অবনমন ঘটছে৷ ডা. মুরাদ হাসান সেই অবনমনের একটা মান ঠিক করে দিলেন৷ বাংলাদেশের রাজনীতি কতটা খারাপ? এই প্রশ্নের জবাবে সবাই এখন মুরাদ হাসানকে দেখিয়ে দেবে৷ তবে ঘটনা যতই খারাপ হোক, আমি তা থেকে একটা ভালো কিছু খুজেঁ নেয়ার চেষ্টা করি৷ বিজ্ঞাপনের সেই ভাষার মতো ‘দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু ঘটে, তবে তো দাগই ভালো'৷ মুরাদ হাসানের ঘটনায় একটা বিষয় প্রমাণিত- জাইমা রহমান, তারেক রহমান, খালেদা জিয়াকে অশালীন ভাষায় গাল দিলে; এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হলেও তাকে পদত্যাগ করতে হয়৷ তার মানে যতটা খারাপ ভাবছি, রাজনীতি এখনো ততটা খারাপ হয়নি৷ মুরাদ হাসান একটা ব্যতিক্রম মাত্র৷ আর যদি মুরাদ হাসানকেই রাজনীতির পতনের মানদণ্ড ধরে নেই, তাহলেও বলতে হয়, পতনের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে রাজনীতি৷ আর নামার সুযোগ নেই৷ এখন ঘুরে দাঁড়াতেই হবে৷ মুরাদ হাসান থেকে যদি অন্য রাজনীতিবিদরা শিক্ষা নেন, নিজেদের স্বার্থেই যদি রাজনীতিকে নিয়মের মধ্যে আনেন, যদি সব অশ্লীলতা দূর করেন; তবে সবার জন্যই মঙ্গল৷ছেলেবেলায় বাংলা ব্যাকরণে শিখেছিলাম রাজহাঁস মানে রাজার হাঁস নয়, হাঁসের রাজা৷ তেমনি রাজনীতি মানে কিন্তু রাজা হওয়ার নীতি নয়, নীতির রাজা৷ এই নীতির রাজা যারা ধারণ করবেন; সেই রাজনীতিবিদরা যেন থাকেন স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন৷ তাদের দেখে যেন আমরা সবাই শিখতে পারি, তাদের নেতৃত্ব যেন আমাদের লজ্জিত নয়, গর্বিত করে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ