যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের আগে উপাচার্যকে সরিয়ে দেন রাজ্যপাল। শিক্ষা দপ্তর তাকে বহাল করে। সমাবর্তন হয়।
বিজ্ঞাপন
রাজভবন মনে করছে, সমাবর্তন বেআইনি। তাহলে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের কী হবে?
রাজ্য সরকার বনাম রাজ্যপাল বিরোধের জেরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরপড়ুয়ারা রীতিমতো বিপাকে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনের একদিন আগে রাজ্যপাল অস্থায়ী উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউকে পদ থেকে সরিয়ে দেন। তিনিই বুদ্ধদেবকে নিয়োগ করেছিলেন। তারপরই রাজ্য শিক্ষা দপ্তর বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেয়, উপাচার্য হিসাবে এই সমাবর্তন করতে পারবেন বুদ্ধদেব সাউ।
উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা চলছে। সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছে, রাজ্যপাল কোনো অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করতে পারবেন না। রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে সেই কথাও আছে।
উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউ সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি রাজভবন ও রাজ্য সরকারের কাছ থেকে দুইটি চিঠি পেয়েছিলেন। তিনি বিষয়টি বিশ্ববিদ্য়ালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক সংস্থা ইউনিভার্সিটি কোর্টকে দেন। কোর্ট তাকে সমাবর্তন করতে বলে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নবিদ্ধ ছাত্র মৃত্যু
শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয় হলো যাদবপুর। ছাত্র মৃত্যুর পর এখন তা সবচেয়ে বিতর্কিত বিশ্ববিদ্যালয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়াবহ ঘটনা
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকায় দেশের পাঁচ নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ঘটে যাওয়া এক মৃত্যু নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে তোলপাড় রাজ্য। পুলিশ সূত্রে খবর, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের ‘এ’ ব্লকের তৃতীয় তলার বারান্দা থেকে ‘কোনও ভাবে’ পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় এক পড়ুয়ার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পড়ুয়াদের দাবি
হস্টেলের অন্য পড়ুয়াদের দাবি, ৯ অগস্ট, বুধবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিট নাগাদ তারা ওপর থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ পান। তারা দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন এক ছাত্র। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিকটবর্তী এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ মৃত্যু হয় ওই ছাত্রের।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ঘনিয়ে উঠেছে রহস্য
এর পর ধীরে ধীরে এই মৃত্যু ঘিরে ঘনিয়ে উঠেছে রহস্য। মৃত ছাত্র হস্টেলের বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, না কি নেপথ্যে অন্য কারণ রয়েছে? তদন্তে নেমে খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
গেটে তালা
পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, বুধবার রাতে মৃত্যুর আগে ওই ছাত্রের আচরণ স্বাভাবিক ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে তেমনটাই জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা। ওই ছাত্র নাকি বার বার বলছিলেন, ‘‘আমি সমকামী নই।” ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর একটা গেটে তালা পড়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
‘প্রাক্তনীদের মৌরসীপাট্টা’
এরপর পরিবারের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়ে যাদবপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই গোটা ঘটনায় আরও একটি বিষয় সামনে এসেছে। আঙুল উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ‘বেআইনিভাবে’ থেকে যাওয়া প্রাক্তনীদের দিকে। ছাত্রদের একাংশের দাবি, হোস্টেলে ‘র্যাগিং’-এর নেপথ্যে রয়েছেন মূলত তারাই।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ডায়রির পাতা
পড়ুয়া্দের অনেকেই জানিয়েছেন, এই প্রাক্তনীরা প্রায়ই হস্টেলে মত্ত অবস্থায় ঝামেলা করেন। র্যাগিং করেন। আশঙ্কা, ছাত্রের রহস্যমৃত্যুর নেপথ্যেও প্রাক্তনীদের হাত থাকতে পারে। এরই মধ্যে সামনে এসেছে মৃত ছাত্রের ডায়েরিতে লেখা একটি চিঠি। সন্দেহ করা হচ্ছে তার মৃত্যু রহস্যের মোড় অন্যপথে চালিত করতেই এই চিঠির অবতারণা। পুলিশি জেরায় চিঠি লেখার কথা স্বীকার করেছেন ধৃত পড়ুয়া দীপশেখর দত্ত।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নয়জন গ্রেপ্তার
পড়ুয়া মৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তথা হস্টেলের আবাসিক সৌরভ চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। এর পর রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুই পড়ুয়া মনোতোষ ঘোষ এবং দীপশেখর দত্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। বুধবার আরও ছয়জন পড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
‘র্যাগিং নতুন কিছু নয়’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ঘটা করে তৈরি হয় ‘অ্যান্টি-র্যাগিং’ কমিটিও। এই মর্মে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখান ছাত্রছাত্রীদের একাংশ। বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই এই ঘটনায় কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল তুলেছে। বিবৃতি প্রকাশ করে তাঁদের প্রশ্ন, হস্টেলের সুপারের উপস্থিতিতে কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল। যাদবপুর থানার সামনে বিক্ষোভ দেখায় এআইডিএসও।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পকসো
যাদবপুরের ছাত্রের মৃত্যু মামলায় তদন্তকারী পুলিশ জানিয়েছে তারা পকসো আইনের ধারা জুড়তে পারে। কারণ যাদবপুরের মৃত ছাত্রের বয়স মৃত্যুর সময় ১৮ পূর্ণ হয়নি বলে পরিবার সূত্রে খবর। সে ক্ষেত্রে ওই ছাত্র নাবালক। এবং তার বিরুদ্ধে হওয়া অত্যাচারের অভিযোগে নাবালকের বিরুদ্ধে অপরাধ দমনের আইন পকসো জুড়বে বলেই পুলিশ সূত্রে খবর।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কেঁদেই ফেলেন রেজিস্ট্রার
ঘটনার চার দিন পর অবশেষে সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু। তিনি ক্যাম্পাসে আসতেই তাকে প্রশ্ন করা হয়, এতদিন কোথায় ছিলেন? ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না কেন? সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েই কেঁদে ফেলেন রেজিস্ট্রার।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কমিশনের নোটিস
সোমবারই ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে নোটিস পাঠায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। স্বতঃপ্রণোদিত এই নোটিসে কমিশন জানায়, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ঘটনার আগে ডিনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন মৃত ছাত্রের সহ-আবাসিকেরা। কিন্তু তাদের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সাবেক উপাচার্যের মত
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী এক সংবাদপত্রে কলম ধরেছেন। লিখেছেন, “আমি ইস্তফা দেওয়ার পরেই যাদবপুরে অরাজকতার কালো দিনের সূচনা। আমার মনে হয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় খাপ পঞ্চায়েতের আদলে চলে। সেখানে ‘জিবি মিটিং’ এবং নিজ নিজ শক্তি প্রদর্শনের খাতিরে আধিকারিক ও উপাচার্যকে ‘ঘেরাও’ করা দু’টি প্রচলিত ‘রীতি’।”
ছবি: Subrata Goswami/DW
রেজিস্ট্রারকে তলব
যাদবপুরকাণ্ডে বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু এবং ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়কে ডেকে পাঠানো হয় লালবাজারে। সেই মতো রেজিস্ট্রার বিকেলে হাজিরা দিলেও যাননি ডিন। পুলিশ সূত্রে খবর, পড়ুয়ারা ‘ঘেরাও’ করে রাখার কারণে তিনি লালবাজারে যেতে পারেননি বলে জানিয়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
উত্তাপ বাড়ছে
বুধবার উত্তপ্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। তৃণমূল ছাত্রপরিষদের সঙ্গে বচসা এবং হাতাহাতি হয় এআইডিএসও-র সমর্থকদের। মৃত ছাত্রের এলাকা বগুলা থেকেও বহু মানুষের প্রতিবাদ মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
14 ছবি1 | 14
সমাবর্তনও নির্ধারিত দিনে হয়। তবে রাজ্যপাল সেখানে যাননি। প্রধান অতিথি হিসাবে থাকার কথা ছিল ইউজিসির চেয়ারম্যান এম জগদেশ কুমারের। তিনিও সমাবর্তনে আসেননি। মঞ্চে ছিলেন বিতর্কিত উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউ। তিনি সমাবর্তন শুরু ও শেষের ঘোষণা দেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের কথা মেনে তিনি পড়ুয়াদের ডিগ্রি সার্টিফিকেট দেননি। সেটা দিয়েছেন সহ-উপাচার্য অমিতাভ দত্ত। কিন্তু সেই সার্টিফিকেটে বুদ্ধদেবের সই আছে। সাড়ে চার হাজার পড়ুয়া এই সার্টিফিকেট নেন।
আর এখানেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। রাজভবন মনে করছে, এই সার্টিফিকেট বৈধ হয়। কারণ, রাজ্যপাল সমাবর্তনের আগে উপাচার্যকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তাই তিনি এই সার্টিফিকেটে সই করতে পারেন না। ফলে ওই সার্টিফিকেট আইনত বৈধ নয়। কিন্তু শিক্ষা দপ্তর বলছে, যেহেতু তারা আবার উপাচার্যকে পদে বহাল করেছিল, তাই এতে আইনি কোনো বাধ নেই।
সূত্র জানাচ্ছে, রাজভবন এখন আইনি পরামর্শ নিচ্ছে। দরকার হলে, রাজ্যপাল আদালতে যেতে পারেন।
প্রচুর পড়ুয়া ও অবিভাবকরা ইতিমধ্যেই রাজভবনে ফোন করে জানতে চেয়েছেন, এই সার্টিফিকেট বৈধ কি না। এই সার্টিফিকেট ব্যবহার করে তারা বিপদে পড়বেন কিনা। রাজ্যপাল একটি কমিটি করে দিয়েছেন বিষয়টা দেখার জন্য।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, কে ঠিক, রাজ্যপাল না রাজ্য সরকার? সমাবর্তনের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের কী ভূমিকা আছে? রাজ্যপাল উপাচার্যকে অপসারিত করার পর তারা কি তাকে আবার পদে বসাতে পারে? সমাবর্তন হয়ে যাওয়ার পর রাজ্যপাল কি আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন? রাজ্য সরকার ও রাজ্যপালের মধ্যে লড়াইয়ে যে এত পড়ুয়া বিপাকে পড়েছে, তার দায় কে নেবে?
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
যাদবপুরের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু বলেছেন, ''পড়ুয়াদের ভবিষ্যতে যাতে কোনো অসুবিধায় পড়তে না হয়, সেজন্যই কোর্ট বলেছিল সহ উপাচার্য সার্টিফিকেট দেবেন। সেইমতো তিনিই সার্টিফিকেট দিয়েছেন।''
উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউ বলেছেন, ''পরে কী হবে তা বলা যায় না। হাইকোর্ট আছে, সুপ্রিম কোর্ট আছে। তাই যা হওয়ার হবে। আইন অনুযায়ী হবে।''
কেন এই সংঘাত?
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''এই সংঘাত শুধু পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে না, ভারতে অনেকগুলি বিরোধী শাসিত রাজ্যে হচ্ছে। কেরালা, তামিলনাড়ুতেও এই সংঘাত তীব্র হয়েছে। পাঞ্জাবেও হচ্ছে। এই রাজ্যগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটা সংঘাত হচ্ছে এবং অন্য বিষয় নিয়েও রাজ্য সরকার রাজ্যপালের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে।''
শুভাশিসের মতে, ''দেখে মনে হচ্ছে, বিজেপি বিস্ববিদ্যালয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কিন্তু রাজ্য সরকারগুলি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছে। তাদের কথা না শুনে রাজ্যপাল কি একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? এ নিয়ে অনেক মামলাই সুপ্রিম কোর্টে আছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে। তবে এখন যা হচ্ছে, তাতে প্রচুর প্রশ্ন উঠছে। পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।''
শুভাশিস জানিয়েছেন, ''সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বিদেশে পড়ুয়াদের যাওয়া অনেক বেড়ে গেছে। এরকম হতে থাকলে তা আরো বাড়তে পারে। এই প্রবণতা কিন্তু সবসময় ভালো নয়।''