রাজ্য নির্বাচনে পপুলিস্টদের সাফল্যে নাড়া খেল জার্মান সরকার
২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
জার্মানির সাক্সনি এবং টুরিঙ্গিয়া রাজ্যে নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থি এএফডি দল বড় জয় পেয়েছে৷ তাদের এই জয় জার্মানির জোট সরকারের জন্য এক বিপর্যয়৷ জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব কী হতে পারে?
বিজ্ঞাপন
জার্মানির রাজ্য নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক৷ জাতীয় নির্বাচনে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে সেসম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায় আঞ্চলিক নির্বাচন দেখে৷ তাই, যদিও ১৬টি রাজ্যের মাত্র দুটো রাজ্যে পহেলা সেপ্টেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তাতে ভোটারের সংখ্যা ছিল ৫০ লাখের মতো, তারপরও এর ফলাফলের বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে৷
এই প্রথম কোনো রাজ্য নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশের বেশি ভোট পেয়েছে উগ্র ডানপন্থি ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি' বা সংক্ষেপে এএফডি দল৷ পাশাপাশি বামপন্থি সারা ভাগেনক্নেশটের নতুন পপুলিস্ট বিএসডাব্লিউ জোট প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে দুই অংকের ঘরে ভোট পেয়েছে৷ আর যে দলগুলো রাজধানী বার্লিনভিত্তিক কেন্দ্রীয় সরকারে রয়েছে সেগুলো আগে কখনো আঞ্চলিক ভোটে এত বাজে ফলাফল করেনি৷
জার্মান সংবিধানের ৭৫ বছর
১৯৪৯ সালে এই সংবিধান গ্রহণ করে পশ্চিম জার্মানি। এরপর এটি বহুবার সংশোধন করা হয়েছে, জার্মান সামরিক বাহিনী বুন্ডেসভেয়ার প্রতিষ্ঠার মতো কিছু বিতর্কিত সংযোজনও করা হয়েছে সংবিধানে।
ছবি: Maja Hitij/Getty Images
'মানুষের মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়'
আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মান সংবিধান পরিচিত বেসিক ল, বা মৌলিক আইন নামে। এর প্রথম অনুচ্ছেদ শুরু হয়েছে এই বাক্য দিয়ে - 'মানুষের মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়'। নাৎসি জার্মানির নজিরবিহীন অপরাধের প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই বাক্যটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকাস্টের জন্য দায়ী ছিল নাৎসি জার্মানি। জার্মানি এবং ইউরোপ জুড়ে ৬০ লাখ ইহুদি ছাড়াও আরো অনেককে হত্যা করেছিল নাৎসি বাহিনী।
ছবি: Maja Hitij/Getty Images
১৯৪৯: মৌলিক আইন গৃহীত হয়
মৌলিক আইন হিসাবে জার্মান সংবিধান গ্রহণ করা হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ মে। তখন অবশ্য এটি শুধুমাত্র পশ্চিম জার্মানির জন্যই প্রযোজ্য ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী পশ্চিমা শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স পশ্চিম জার্মানির তিনটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে একই বছরের ৭ অক্টোবর জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Ohde
১৯৫৬: জার্মান সামরিক বাহিনী
মৌলিক আইন কয়েক দশকে অন্তত ৭০ বার সংশোধন করা হয়েছে। সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা ছিল এসব পরিবর্তনের লক্ষ্য। এসব পরিবর্তনের মধ্যে বিশেষভাবে বিতর্কিত ছিল পুনঃসামরিকীকরণ। পশ্চিম জার্মানি ১৯৫৫ সালে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেয়ার পর জার্মান সশস্ত্র বাহিনী বা বুন্ডেসভেয়ার প্রতিষ্ঠা করে। বাহিনীকে সাংবিধানিক কাঠামো দেয়ার জন্য ১৯৫৬ সালে সংবিধান সংশোধন করা হয়।
ছবি: Nana Ehlers/Bundeswehr/dpa/picture alliance
১৯৬৮: জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকার সীমিত করা
১৯৬৮ সালে ‘জরুরি অবস্থা‘ সংশোধনীরও সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল। এই সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল সংকটময় পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিদ্রোহ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে রাষ্ট্রের কাজ করার ক্ষমতা নিশ্চিত করা। এই সংশোধনীর ফলে বুন্ডেসভেয়ারকে দেশের মধ্যে মোতায়েন, ব্যক্তিগত যোগাযোগে গোপন নজরদারি এবং জরুরি পরিস্থিতিতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সীমাবদ্ধ করারও সুযোগ তৈরি হয়।
ছবি: Monika Skolimowska/dpa/picture alliance
১৯৯১: একত্রীকরণের পরও একই সংবিধান
মৌলিক আইন যখন প্রণয়ন করা হয় তখন সেটিকে সাময়িক হিসাবেই বিবেচনা করা হয়েছিল। দুই জার্মানি এক হলে নতুন এবং স্থায়ী সংবিধান তৈরি করা হবে, এমনটাই ছিল চিন্তা। কিন্তু দুই জার্মানিকে আলাদা করা বার্লিন দেয়ালের পতন এবং ১৯৯১ সালে জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের পরও নতুন সংবিধান প্রণয়ন হয়নি, বরং মৌলিক আইনকেই পুরো জার্মানির জন্য প্রযোজ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
পুনরেকত্রীকরণের তিন বছর পর ১৯৯৩ সালে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদনের সংখ্যা ব্যাপক সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়। এর ফলে মৌলিক আইনে শরণার্থীদের আশ্রয়ের অধিকারটিকে সীমাবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই সংস্কারের ফলে জার্মানির নাগরিকত্ব না থাকা ব্যক্তিদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়। তবে এর আগে সেই দেশকে নিরাপদ দেশের তালিকায় তালিকাবদ্ধ করতে হয়। তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন জর্জিয়া।
ছবি: Lisi Niesner/REUTERS
২০০৯: ঋণ সীমিতকরণ
সরকারি ঋণ সীমিত রাখার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে মৌলিক আইনে ‘ডেট ব্রেক‘ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর্থিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবর্তিত এই ব্যবস্থাটি আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ঋণ গ্রহণে সীমা নির্ধারণ করে দেয়। তবে অপ্রত্যাশিত সংকটের ক্ষেত্রে ঋণ সীমা তুলে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে, যেমনটি কোভিড মহামারি চলাকালীন করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে অনেকে ২০২৪ সালেও ঋণ সীমা শিথিল করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
ছবি: Ralph Orlowski/Getty Images
7 ছবি1 | 7
আগামী ২২ সেপ্টেম্বর জার্মানির পূর্বাঞ্চলের আরেক রাজ্য ব্রান্ডেনবুর্গে আঞ্চলিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ সেখানেও জরিপে এগিয়ে রয়েছে এএফডি৷ তবে দলটির কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে ক্ষমতাসীন জোটে থাকা সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ সেখানে নির্বাচনে নিজেদের জয় ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করবে দলটি৷
প্রশ্ন উঠেছে রাজ্য নির্বাচনে হতাশাজনক ফলাফল হলে ক্ষমতাসীন সামাজিক গণতন্ত্রী এসপিডি, পরিবেশবান্ধব সবুজ এবং ব্যবসাবান্ধব এফডিপি দলের জোটের কী হবে? ইতোমধ্যে দলগুলোর মধ্য থেকে নিজেদের উপস্থিতি আরো বাড়ানোর এবং অবস্থান মজবুত করার ডাক এসেছে৷
এই জোটের মধ্যে ২০২৫ সালের বাজেট নিয়ে বিরোধ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ পাশাপাশি এটাও দেখার বিষয় রয়েছে যে জোট সরকার সম্প্রতি অভিবাসন নীতি আরো কড়া করার যে ঘোষণা দিয়েছে তা বাস্তবে রূপ দিতে পারে কিনা৷ কারণ এসপিডির বামপন্থি এবং সবুজ দলের কিছু নেতা এই উদ্যোগে সায় দেননি৷
এদিকে বর্তমানে বিরোধী দলে থাকা খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্র দল সিডিইউ এবং তাদের আঞ্চলিক মিত্র সিএসইউ আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের উপর কড়া অভিবাসন নীতি বাস্তবায়েন চাপ দিচ্ছে৷ শুধু তাই নয়, এই নীতি আরো কড়া করার পক্ষে অবস্থান তাদের৷