রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের দ্বিতীয় দিনে প্রধান আসামি কারাগারে বন্দি সোহেল রানাকে আদালতে হাজির না করার কারণ দর্শাতে বলেছেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কারা কর্তৃপক্ষকে৷
বিজ্ঞাপন
বিচারক এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূইয়া বুধবার সোহেল রানাকে আদালতে হাজির না করার কারণ জানানোর নিদেশ দেন বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিমল সমাদ্দার ডয়চেভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন৷
গত ৩১ জানুয়ারি মামলাটির বাদী সিআইডির ওয়ালী আশরাফ ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেন৷ বিমল সমাদ্দার বলেন, ‘‘বুধবার বাদী আদালতে হাজির থাকলেও সোহেল রানাকে হাজিরে ব্যর্থতায় বিচারক আজ সাক্ষ্য নিতে পারেননি৷ আইন অনুযায়ী আসামিদের সামনে সাক্ষ্য করার নিয়ম রয়েছে৷’’ এর আগের সাক্ষ্য নেওয়ার সময় সোহেল রানাকে কারাগার থেকে আনতে না পারায় তার সঙ্গে কারাগারে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করা হয়৷
আদালত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টায়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আগামী ১৬ মার্চ সাক্ষী (বাদী) ওয়ালী আশরাফ, আরও দুই সাক্ষী মো. ইকরামুল হক, মোসা. শিউলি আক্তারকে আদালতে হাজির হতে সমন পাঠানোর আদেশ দেওয়া হযেছে৷
জামিনে থাকা আসামি জান্নাতুল ফেরদৌস, আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, মো. জামশেদুর রহমান, মো. ইউসুফ আলী, উত্তম কুমার রায়, নয়ন মিয়া, মো. বেলায়েত হোসেন, মো. আমিনুল ইসলাম, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ, মো. মধু, মো. রকিবুল হাসান রাসেল, মো. রফিকুল ইসলাম, মাহমুদুর রহমান তাপস, মো. আওলাদ হোসেন বুধবার আদালতে হাজিরা দেন৷ জামিনে থাকা মর্জিনা বেগম, মো. সারোয়ার কামাল, অনিল দাসের পক্ষে তাদের আইনজীবীরা আদালতে হাজির থাকতে পারেননি বলে সময় চেয়েছেন৷
এ মামলার আসামি রানার বাবা মো. আব্দুল খালেক ওরফে খালেক কুলু ও আতাউর রহমান মারা গেছেন৷ আসামি রেফাত উল্লাহর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রমে হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ ছিল৷
আসামি মাহবুবুর রহমান, ফারজানা ইসলাম, মো. শফিকুর ইসলাম ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, রেজাউল ইসলাম, রেজাউল ইসলাম, নান্টু কনট্রাকটর, আবু বকর সিদ্দিক, মো. আবুল হাসান, মোহাম্মদ আলী খান, বজলুল সামাদ পলাতক৷ রাষ্ট্রপক্ষের আরেক আইনজীবী মিজানুর রহমান বিডিনিউজকে জানান, অভিযোগ গঠনের পরপরই আটজন আসামি উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি স্থগিতের আবেদন করলে তাদের ছয়জনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে ৷ দুই আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রেফাত উল্লাহ এবং সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষের আবেদন নিষ্পত্তি হয়নি৷
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আটতলা রানা প্লাজা ধসে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন; প্রাণে বেঁচে গেলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় হাজারখানেক পোশাক শ্রমিককে৷
বিশ্বকে নাড়া দেওয়া সেই ঘটনার দিনই সাভার থানায় দুটি মামলা হয়৷ পরের বছর আরেকটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন৷ প্রথমটিতে হতাহতের ঘটনা উল্লেখ করে ভবন ও কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন সাভার মডেল থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ৷
‘অবহেলা ও অবহেলাজনিত হত্যার' অভিযোগে মামলা দায়ের করার দুই বছর পর ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন৷ মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে৷
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই৷
এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
২০১৯ সালের ছবিঘরটি দেখুন
রানা প্লাজা ধসের ৬ বছর পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত
৬ বছর আগে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে মৃত্যু হয় ১,১৩৪ জন শ্রমিকের৷ বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এ দুর্ঘটনার পর বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতটিকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Abdullah
অনিয়মের ভবন
আট তলা একটি ভবন, যার চার তলাই নির্মাণ করা হয়েছে অনুমোদন ছাড়া৷ ভবনটির নকশা করা হয়েছিল দোকান আর অফিসের জন্য, কিন্তু সেখানে গড়ে ওঠে একাধিক কারখানা৷ ভারি যন্ত্রপাতি আর সেগুলোর কম্পন বহন করার সক্ষমতা ছিল না ভবনটির৷ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ছিলেন স্থানীয় যুবলীগের সদস্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Abdullah
দুর্ঘটনা, না হত্যা?
২৩ এপ্রিল, ২০১৩ সাল৷ ফাটল দেখা দেয়ায় ভবনটি খালি করে দেয়া হয়৷ বন্ধ করে দেয়া হয় নীচ তলার দোকান আর ব্যাংকের কার্যালয়৷ স্থানীয় গণমাধ্যমে সোহেল রানা তখন দাবি করেন, ভবনটি সম্পূর্ণ নিরাপদ৷ বেতন কাটার হূমকি দিয়ে পরের দিন জোর করে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হয় শ্রমিকদের৷ সেদিন সকালেই ধসে পড়ে রানা প্লাজা৷
ছবি: Reuters
মৃত্যুর মিছিল
২৪ এপ্রিল, ২০১৩ সাল৷ ৩১২২ জন শ্রমিক রানা প্লাজায় ব্যস্ত ছিলেন পোশাক তৈরিতে৷ তাঁদের নিয়েই ধসে পড়ে বিশাল ভবনটি৷ প্রাণ হারান ১১৩৪ জন শ্রমিক৷ বাকিরা বেঁচে গেলেও, অনেকেই পঙ্গু হয়ে যান৷ অনেকে আজও ভুগছেন মানসিক যাতনায়৷
ছবি: Imago/Xinhua
ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া
আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য রানা প্লাজা ধসের ৬ মাস পর জেনেভায় একটি উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও৷ পরবর্তীতে সরকার, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডসহ বিভিন্ন পক্ষকে নিয়ে গঠিত হয় ‘রানা প্লাজা কো অর্ডিনেশন কমিটি’, যার মাধ্যমে ২০১৫ সালে এসে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হয়৷ মোট ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেয়া হয়েছে নিহতদের পরিবার ও আহতদের৷
ছবি: DW/C. Meyer
চাপে ব্র্যান্ড
রানা প্লাজায় যে ৫ টি কারখানা ছিল, সেগুলোর ক্রেতাদের মধ্যে ছিল ওয়ালমার্ট, সিঅ্যান্ডএ, কিক-এর মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড৷ পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ নিয়ে এ সময় তারা ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়ে৷ ইউরোপ, অ্যামেরিকার সাধারণ ক্রেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন এসব ব্র্যান্ডের স্টোরের সামনে বিক্ষোভ করেন৷
ছবি: DW/A. Chakraborty
সংস্কারের উদ্যোগ
সমালোচনার মুখে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও বিভিন্ন সংগঠন৷ ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলোর নেতৃত্বে গঠিত হয় অ্যাকর্ড আর অ্যামেরিকার ব্র্যান্ডগুলোর প্রাধান্যে গড়ে ওঠে অ্যালায়েন্স৷ যেসব কারখানা থেকে ব্র্যান্ডগুলো পোশাক কেনে, সেগুলোর ত্রুটি বের করে সংস্কারের নির্দেশনা দেয় এই দুটি জোট৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press
নিরাপদ কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের অধীনে আছে ২২৫৪ টি কারখানা৷ ৫ বছরে তারা ত্রুটির প্রায় ৯০ ভাগই সারিয়েছে৷ যেসব কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছে সরকার৷ সংস্কার না করায় ১৯৪ টি কারখানাকে ব্যবসার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে৷ ৬২৫ টি কারখানা প্রাথমিক সংস্কারের কাজ পুরোপুরি শেষ করেছে৷
ছবি: DW/C. Meyer
অ্যাকর্ড নিয়ে জটিলতা
সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী গত বছর পর্যন্ত কাজের মেয়াদ ছিল অ্যাকর্ড ও অ্যলায়েন্সের৷ এর মধ্যে অ্যালায়েন্স নিজেদের গুটিয়ে নিলেও মে ২০২১ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে অ্যাকর্ড, যার বিরোধিতা করে আসছেন কারখানা মালিকরা৷ মামলাও করেছে একটি প্রতিষ্ঠান৷ কয়েক দফা পেছানোর পর ১৯ মে যার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে সুপ্রিম কোর্ট৷
ছবি: Getty Images/AFP
শক্তিশালী রপ্তানি প্রবৃদ্ধি
রানা প্লাজা ধসের পর অনেকেই মনে করেছিলেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এর বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ তেমনটা না হলেও পোশাক কারখানা সংস্কারের উদ্যোগ আর অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমে যায়৷ তবে গত দুই বছরে তার গতি আবার বেড়েছে৷ চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ১২ ভাগের বেশি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/M. Hasan
এখনো ভুগছেন তাঁরা
আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড সম্প্রতি একটি জরিপ করেছে৷ তাদের জরিপ অনুযায়ী রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিকদের ৫১ ভাগ এখনো বেকার৷ ৭৪ ভাগ শারীরিক কারণে আর ২৭ ভাগ মানসিক দুর্বলতার কারণে এখনো কাজ করতে পারছেন না৷ আহতদের সাড়ে দশভাগ এখন ট্রমায় রয়েছেন৷