সাভার রানা প্লাজা ধসের একমাস পূর্ণ হলেও থামেনি স্বজনদের কান্না৷ এখনো অনেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাদের নিখোঁজ আত্মীয়-স্বজনকে৷ জানেন পাবেন না৷ তবুও আশা, যদি অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা লাশের ভিতরে তাদের স্বজনদের লাশ থেকে থাকে৷
বিজ্ঞাপন
এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখে সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে৷ শুক্রবার সেই মর্মান্তিক ঘটনার একমাস পূর্ণ হলেও এখনো শেষ হয়নি স্বজনহারাদের কান্না আর অপেক্ষা৷ রানা প্লাজার নিউ ওয়েভ গার্মেন্টস-এর কর্মী মমতাজ বেগমকে (২২) এখনো তার বাবা আবুল কালাম খুঁজে ফেরেন৷ ছবি হাতে নিয়ে শুক্রবারও তিনি যান ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে৷ মেয়ের লাশও পাননি৷ তাঁর প্রশ্ন, কোনদিন কি তিনি জানতেও পারবেন না যে তার মেয়ের লাশটি পাওয়া গিয়েছে কিনা৷ একই প্রশ্ন নুরুন্নাহার বেগমের৷ তিনি তার মেয়ে গার্মেন্ট কর্মী শরীফার কোন খোঁজ পাননি৷ কোনো দিন পাবেন কিনা তাও জানেন না৷
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় জীবিত এবং মৃত অবস্থায় মোট ৩,৫৫৩ জনকে উদ্ধার করা হয়৷ এর মধ্যে লাশ উদ্ধার করা হয় ১,১১৫টি৷ চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান আরো ১২ জন৷ মোট ১,১২৭টি লাশের মধ্যে ৮৩৬টি লাশ আত্মীয় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে৷ বাকি ২৯১টি লাশ সনাক্ত করা যায়নি৷ তাদের অজ্ঞাত হিসেবে ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে৷ জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন ডয়চে ভেলেকে জানান, অজ্ঞাত সব লাশেরই ডিএনএ নমুনা রাখা হয়েছে৷ এখন আত্মীয় স্বজনের ডিএনএ নিয়ে ডিএনএ প্রোফাইল মিলিয়ে লাশ সনাক্ত করা হবে৷ তিনি জানান, প্রতিটি কবরই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা আছে৷ তবে পরিচয় নিশ্চিত হতে বেশ সময় লাগবে৷
জেলা প্রশাসন বলছে অজ্ঞাত লাশ দাফন করা হয়েছে ২৯১টি৷ কিন্তু বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন দাবি করছে, তাদের কাছে নিখোঁজদের যে তালিকা রয়েছে তার সংখ্যা অজ্ঞাত লাশের চেয়ে বেশি, ৩৫০ জন৷ শ্রমিক নেত্রী আফরোজা বেগম ডয়চে ভেলেকে জানান, নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা আরো বাড়ছে৷ এদিকে সাভার থানায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন সাধারণ ডায়েরি বা জিডি করছেন৷ সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে জানান, তাঁরা শুক্রবার পর্যন্ত ৯০টি জিডি নিয়েছেন৷ তবে প্রতিদিনই লোক আসছেন জিডি করতে৷ নিখোঁজ ব্যক্তিদের কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন অবশ্য দাবি করেন, থানা জিডি নিতে চায়না সহজে৷ সে কারণেই জিডি-র সংখ্যা কম৷ তবে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন জিডির সঙ্গে তারা কিছু প্রমাণপত্র নেন৷ যেমন গার্মেন্টস-এর কর্মচারী হলে তাদের পরিচয়পত্রের ফটোকপি অথবা অন্য কোনো প্রমাণপত্র৷ কেউ যাতে অনুদানের টাকা নিয়ে প্রতারণা করতে না পারে সে জন্যই এই ব্যবস্থা৷
রানা প্লাজায় মোট ৫টি তৈরি পোশাক কারখানা ছিল৷ হিসাব অনুযায়ী সেখানে মোট ২,৪৩৮ জন শ্রমিক কর্মরত ছিলেন বলে ডয়চে ভেলেকে জানান বিজিএমই-র সহ সভাপতি শহীদুল আজিম৷ তাদের মধ্যে জীবিত এবং নিহতদের পরিবার মিলিয়ে দু'দফায় মোট ২,৩০০ শ্রমিককে বেতন দেয়া হয়েছে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে৷ তাদের হিসেবে ১৩৮ জন শ্রমিক এখনো নিখোঁজ৷ আর ভবনে মোট ৪,৫০০ লোক ছিল বলে প্রাথমিক তথ্য৷ উপজেলা প্রশাসন তাই নিখোঁজ ব্যক্তিদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে বলে জানান জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন৷ সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এখন আর নিখোঁজদের স্বজনরা যাননা৷ তারা ভিড় করছেন উপজেলা পরিষদ চত্তরে৷
এদিকে রানা প্লাজা ধসের একমাস পূর্তিতে শুক্রবার বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এবং নিহত, নিখোঁজ এবং আহতদের স্বজনরা ধসে যাওয়া ভবনের সামনে মিলিত হন৷ তারা সেখানে নিহতদের স্মরণে ইট দিয়ে একটি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন৷ তাদের দাবি, সেখানে যেন একটি স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়৷ তারা রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন৷ আর দাবি করেন দ্রুত নিহত, নিখোঁজ এবং আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে যেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়৷