ঢাকার অদূরে সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহত পরিচয়হীন ৩১৮ জনের ডিএনএ প্রোফাইলিং-এর কাজ শেষ হয়েছে৷ ডিএনএ ল্যাবের প্রধান অধ্যাপক ড. শরীফ আখতারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে জানান এখন শুধু ম্যাচিং-এর কাজ বাকি৷
বিজ্ঞাপন
গত ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১,১৩০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়৷ এরমধ্যে ৩১৮ জনের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় তাদের বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে৷ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডিএনএ ল্যাব দাফনের আগেই এই ৩১৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে৷ ডিএনএ ল্যাবের প্রধান অধ্যাপক ড. শরীফ আখতারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে জানান, তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য ৫৫৫ জন আত্মীয় স্বজনের ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে৷ এই দুই ধরনের ‘‘ডিএনএ প্রোফালিং'' শেষ হয়েছে৷ এখন অজ্ঞাত পরিচয়দের সঙ্গে আত্মীয় স্বজনের ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে৷
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
তিনি জানান, মিলিয়ে দেখার কাজে আর বেশি সময় লাগবেনা৷ বড়জোর এক সপ্তাহ৷ কারণ এই কাজ দ্রুত করার জন্য তারা এফবিআই'র সহযোগিতা নিয়েছেন৷ তারা সফটওয়্যার এবং কারিগরি সহায়তা দিয়েছে৷
অধ্যাপক আখতারুজ্জামান আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘বেওয়ারিশ হিসেবে যাদের দাফন করা হয়েছে তাদের সবার পরিচয়ই জানা যাবে৷ আর প্রত্যেকটি বেওয়ারিশ লাশের একটি কোড নাম্বার আছে৷ সেই নম্বার দেয়া আছে কবরেও৷ ফলে চিহ্নিত করতে কোন সমস্যা হবেনা৷''
তবে এই ৩১৮ জনের বাইরেও এখনো নিখোঁজ আছেন বেশ কয়েকজন৷ সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান মোল্লা ডয়চে ভেলেকে বলেন, তারা ৩২৯ জনকে নিখোঁজ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন৷ সেই হিসেবে আরো ১১ জনের কোন খোঁজ নেই এখনো৷ তবে তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান৷
এদিকে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত এবং নিহতদের পরিবার এখনো তেমন কোন ক্ষতিপূরণ পাননি৷ এখন পর্যন্ত নিহতদের পরবারের সদস্যদের ১ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে৷ আর আহতরা পেয়েছেন বিচ্ছিন্নভাবে৷ তবে নিখোঁজদের পরিবার কিছুই পায়নি৷ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, সবার পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় ক্ষতিপূরণ দেয়ায় দেরি হচ্ছে৷ প্রতারণা যাতে না হয় সেজন্যই দেরি করা হচ্ছে৷
কিন্তু ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা দাবি করছেন ক্ষতিপূরণের নানা আশ্বাস পাওয়া গেলেও তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি৷ পোশাক শিল্পের মালিকরা ৫০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের কথা বললেও তারা তা করেননি৷ ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল৷ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিদেশি ক্রেতারা৷ কিন্তু কোন প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন হয়নি৷ ‘‘ইন্ডাষ্ট্রিয়াল গ্লোবাল ইউনিয়নের'' বাংলাদেশ প্রতিনিধি রায় রমেশ চন্দ্র ডয়চে ভেলেকে জানান, তাদের দাবি নিহতদের প্রতি পরিবারকে ২৮ লাখ এবং আহতদের এর দেড়গুণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷
উল্লেখ্য, ২৪শে অক্টেবর রানা প্লাজা ধসের ৬ মাস হবে৷ এই সময়ের মধ্যে যদি সরকার, মালিক এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো এই ক্ষতিপূরণ না দেয় তাহলে তা আদায়ে শ্রমিকরা ‘‘ইন্ডাষ্ট্রিয়াল গ্লোবাল ইউনিয়নের'' মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা শুরু করবেন৷