রানা প্লাজা ধসের পর সেই ভবনের যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগই গুরুতর ‘ট্রমায়’ আক্রান্ত৷ তাঁদের চিকিত্সার কোনো সমন্বিত ব্যবস্থা এখনও করা হয়নি৷ কিছু প্রতিষ্ঠান কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করলেও, তা পর্যাপ্ত নয়৷
বিজ্ঞাপন
আনিসুল ইসলাম (৩০) রানা প্লাজার ‘নিউ ওয়েভ বটম' নামের পোশাক কারখানার অপারেটরের কাজ করতেন৷ ভবস ধসের পরদিনই তাঁকে উদ্ধার করা হয়৷ তাঁর শারীরিক ক্ষতি তেমন না হলেও, তিনি এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত৷ আনিসুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘রানা প্লাজা ধসের কয়েক মাস পর আমি একটি পোশাক কারখানায় কাজ নিই৷ কিন্তু তিন দিন পর কাজ ছেড়ে দেই আমি৷ মেশিন ধরতে গেলেই আমার হাত-পা কাঁপে৷ বিদ্যুৎ চলে গেলে প্রচণ্ড ভয় লাগে আমার৷'' এই একইরকম অবস্থা রহিমা এবং সালেহা বেগমসহ আরো অনেকের৷
সাভারে ‘রানা প্লাজা’ ধসে বহু হতাহত
২৪ এপ্রিল সকাল ৯ টায় সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত নয় তলা ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়ে৷
ছবি: Reuters
আগেই ফাটল দেখা দিয়েছিল
২৪ এপ্রিল সকাল ৯ টায় সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত নয় তলা ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়ে৷ সাভার মডেল থানার ওসি আসাদুজ্জামান জানান, মঙ্গলবার সকালে ফাটল দেখা দেয়ার পরপরই ওই ভবনে থাকা চারটি গার্মেন্ট কারখানা ও ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল৷ তবে ২৪ এপ্রিল সকালে কারখানায় আবার কাজ শুরু হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বহু হতাহত
১০ মে সকাল পর্যন্ত ধসে পড়া রানা প্লাজা থেকে ১০৩৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে৷ এসব লাশের অধিকাংশই পোশাক শ্রমিকদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘প্রয়োজনীয় যন্ত্র নেই’
ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা বলছেন, ব্যাপক ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছে৷ এমন ধ্বংসস্তূপ সরানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্র নেই৷ এ কারণে উদ্ধারকাজ চালাতে সমস্যা হচ্ছে৷
ছবি: Reuters
এখনো অনেকে আটকা পড়ে আছেন
সাভারে ধসে পড়া বহুতল ভবনে এখনো অনেকে আটকা পড়ে আছেন বলে জানিয়েছেন উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিরা৷ সকালে ভবন ধসের পরপরই স্থানীয়রা উদ্ধার তৎপরতায় এগিয়ে আসেন৷ এরপর ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন৷
ছবি: Reuters
রক্ত চাই
ধ্বংসস্তুপ থেকে থেকে উদ্ধার করা শত শত আহতের জন্য প্রচুর রক্ত প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা৷ এজন্য ব্লগ, ফেসবুকের মাধ্যমে সকলকে রক্ত দানে আহ্বান জানানো হয়েছে৷ বিভিন্ন সংগঠনও রক্ত সংগ্রহে নেমেছে৷
ছবি: Reuters
জোর করে ঢোকানোর অভিযোগ
আগের দিন ভবনে ফাটল দেখা দেয়ায় ঐ ভবনে থাকা পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কাজে যেতে না চাইলেও মালিকরা তাদেরকে জোর করে ঢুকিয়ে দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে৷
ছবি: Reuters
ইমারত বিধিমালা মানা হয়নি
‘রানা প্লাজা’ ইমারত বিধিমালা সঠিকভাবে অনুসরণ করে নির্মিত হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর৷ বুধবার দুপুরে তিনি ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন৷ বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘কিছু হরতাল সমর্থক ভবনটির ফাটল ধরা দেয়ালের বিভিন্ন স্তম্ভ এবং গেট ধরে নাড়াচাড়া করেছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন৷ ভবনটি ধসে পড়ার পেছনে সেটাও একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে৷'' (ফাইল ফটো)
ছবি: Reuters
হরতাল প্রত্যাহার
উদ্ধার তৎপরতা নির্বিঘ্ন এবং আহতদের দ্রুত চিকিৎসার পথে বাঁধা দূর করতে হরতাল প্রত্যাহার করেছে বিএনপি৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এজন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন৷
ছবি: Harun Ur Rashid
সরকারের আশ্বাস
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন৷ এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য যা যা করা দরকার তা করা হবে বলে জানিয়েছে সরকার৷
ছবি: dapd
খালেদার শোক প্রকাশ
ভবন ধসে প্রাণহানির ঘটনায় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন৷ উদ্ধারকাজ যথাযথভাবে চালাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷ খালেদা জিয়া শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
10 ছবি1 | 10
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট রানা প্লাজা ধসের পর বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের ওপর একটি জরিপ চালায়৷ সেই জরিপে দেখা যায়, ৯০ ভাগ শ্রমিকই ‘প্রাথমিক ‘ট্রমা' বা প্রাথমিক আতঙ্কে আক্রান্ত৷ তিন মাস পর আরেকটি জরিপে দেখা যায় যে, কমপক্ষে ৪০ ভাগ শ্রমিক ‘গুরুতর ট্রমা' বা গুরুতর আতঙ্কে আক্রান্ত৷ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘তাঁদের মধ্যে নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে৷ ভয় পাওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখা, অপরাধ বোধসহ নানা ধরণের দুঃসহ স্মৃতি তাঁদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে৷ এছাড়া ঘটনার পর থেকে তাঁরা বিষন্নতা এবং মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন৷'' তিনি বলেন, ‘‘এর সঠিক চিকিত্সা না হলে তাঁরা মাদকাসক্ত হয়ে উঠতে পারেন৷ তাঁদের মধ্যে বাড়তে পারে আত্মহত্যার প্রবণতা৷''
রানা প্লাজায় আহতদের মধ্যে যাঁরা আতঙ্কগ্রস্ত, তাঁদের চিকিত্সা সহায়তা দিচ্ছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন৷ ‘কেয়ার'-এর চিকিত্সা কেন্দ্র ‘মনোসামাজিক সহায়তা কেন্দ্র' এরকম ৫০০ জনকে চিকিত্সার আওতায় এনেছে৷ তাঁদের নিয়ে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে৷ কেন্দ্রের পরিচালক ও মনোসামাজিক চিকিত্সক দেওয়ান সাফায়েত আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, তাদের পর্যবেক্ষণে রানা প্লাজার ঘটনায় আহতদের প্রতি ১০ জনের পাঁচজন ট্রমায় আক্রান্ত৷ তার মানে, আহত ২,৪৩৮ জনের মধ্যে অর্ধেকই এখন গুরুতর আতঙ্কে ভুগছেন৷ দেওয়ান সাফায়েত আহমেদও বলেন, সঠিক চিকিত্সা না হলে এর শেষ পরিণতি আত্মহত্যা৷
অধ্যাপক ড. তাজুল ইসলামের কথায়, আতঙ্কগ্রস্তদের জন্য এখন সরকারের উদ্যোগে ব্যাপক ভিত্তিক চিকিত্সা কার্যক্রম শুরু করা উচিত৷ নয়ত তাঁরা আর কর্মক্ষম হবেন না৷ ঠিকমতো চিকিত্সা না হলে তাঁরা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না৷ করতে পারবেন না কোনো কাজ৷ তখন তাঁদের ও তাঁদের পরিবারে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়৷