রানা প্লাজা ধসে আহতদের একটি অংশ এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি৷ কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে গেছেন৷ অন্তত ৫০ ভাগ এখনো গুরুতর ট্রমায় আক্রান্ত বলে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম৷
বিজ্ঞাপন
আন্না বেগম (১৭) ধসে পড়া রানা প্লাজার ফ্যান্টম গার্মেন্টস এ কাজ করতেন৷ ভবন ধসে তিনি তার ডান পা হারিয়েছেন৷ পা হারিয়ে পঙ্গু হওয়ার পর তিনি চিকিত্সা শেষে হাসপাতাল ছাড়েন৷ কিন্তু এরপর তার ভিতরে মানসিক অস্বাভিকতা দেখা দেয়৷ কোনো শব্দ শুনলে ভয়ে চিত্কার করে ওঠেন৷ ঘুমাতে গেলে মনে করেন উপরে টিনের চালা ভেঙে পড়বে৷ আর কোনো কারণে দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লে নিজেকে অপরাধী ভেবে বিড় বিড় করে কী যেন বলেন৷ আন্না তাঁর পরিবারে সঙ্গে এখনো সাভারের একটি টিনশেড বস্তিতে থাকেন৷ তিনি জানান, ‘‘আমার ভয় হয়৷ কোন কিছু ভাল লাগেনা৷ মনে হয় আমার ওপর সবকিছু ভেঙে পড়বে৷''
আন্নার মা শাফিয়া বেগম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘একেতো আমার মেয়ে পঙ্গু হয়ে গেছে৷ তার ওপর এই অস্বাভাবিক আচরণ৷ মেয়েকে নিয়ে যে কী করব ভেবে পাচ্ছি না৷'' তিনি জানান, মেয়েকে নিয়ে তিনি সাভারের পক্ষাঘাতগ্রস্তদের চিকিত্সা কেন্দ্র-সিআরপিতে চিকিত্সা করিয়েছেন৷ কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে৷ কিন্তু কৃত্রিম পা তাঁর মেয়েকে কেন জানি আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শারীরিক পঙ্গুত্বের সঙ্গে আন্না বেগম এখন মানসিক রোগে আক্রান্ত৷ তার এখন গভীর ট্রমা৷ দীর্ঘমেয়াদি চিকিত্সা এবং পুনর্বাসন ছাড়া তাকে এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়৷'' তিনি বলেন, ‘‘সে এখনও ভীত এবং অবসাদগ্রস্ত৷ নানা কারণে তার ভিতরে যখন পুরনো স্মৃতি ফিরে আসে তখন সে অস্বাভাবিক আচরণ করে৷''
তাজুল ইসলাম জানান, ‘‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট রানা প্লাজা ধসের পর ৬ মাস পর বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের ওপর একটি জরিপ চালায়৷ জরিপে দেখা যায়, ৯০ ভাগ শ্রমিকই প্রাথমিক ট্রমায় আক্রান্ত৷ পরে আরেকটি জরিপে দেখা যায়, কমপক্ষে ৪০ ভাগ শ্রমিক ‘গুরুতর ট্রমায়' আক্রান্ত৷''
তিনি জানান, ‘‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিউটের পক্ষ থেকে পরে ফলো আপ করা হয়৷ তাতেও দেখা যায় গুরুতর ট্রমায় আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় একই আছে৷''
‘মনোসামাজিক সহায়তা কেন্দ্র' নামে একটি প্রতিষ্ঠান কেয়ারের সহায়তায় ট্রমায় আক্রান্ত ৫০০শ' আহত শ্রমিককে চিকিত্সা ও কাউন্সিলিং করিয়েছে৷ কেন্দ্রের পরিচালক ও মনোসামাজিক চিকিত্সক দেওয়ান সাফায়েত আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা ৫০০ জনকে বাছাই করার আগে একটি জরিপ করি৷ আর আমাদের পর্যবেক্ষণে মনে হয়েছে রানা প্লাজায় আহতদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে পাঁচজন ট্রমায় আক্রান্ত৷ তাঁর মতে, রানা প্লাজার ঘটনায় ২,৪৩৮ জনের মধ্যে অর্ধেকই এখনো গুরুতর ট্রমায় ভুগছেন৷''
ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আহতদের মধ্যে বড় একটি অংশ এখন ভয় পাওয়া, দুঃস্বপ্ন দেখা, অপরাধবোধসহ নানা ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত৷ আর এটা তাদের আরো গুরুতর মানসিক রোগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ এর সঠিক চিকিত্সা না হলে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না৷ এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা স্থায়ী হতে পারে৷ আর তারা অবসাদ ও হতাশা থেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন৷''
রানা প্লাজার ঘটনার পর অ্যাকশন এইডের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে শ্রমিকদের ৫৫ ভাগ এখনো বেকার৷ তারা কোনো কাজ পাননি অথবা তাদের কাজ করার দক্ষতা কমে গেছে৷ আর যারা আহত হয়েছেন তাদের কাজ দিতে মালিকদের অনীহা আছে বলে প্রতিবদেনে বলা হয়৷ চলতি মাসেই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত আহত পোশাক শ্রমিক শিউলি বেগম (২১) জানান, ‘‘আমি কাজ নেয়ার পরও কাজ করতে পারিনি৷ আমার হাত-পা কাঁপে৷ কোন শব্দ হলে ভয় পাই৷ মনে হয় যেন ভবন ভেঙে পড়বে৷''
আর একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা ডয়চে ভেলেকে বলেন মোবারক মিয়া (২৩)৷ তিনি বলেন, ‘‘ভবন ধসের ছয় ঘণ্টা পরই আমাকে উদ্ধার করা হয়৷ প্রাথমিক চিকিত্সার পর আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়৷ ছয় মাস পর আমি আরেকটি পোশাক কারখানায় কাজ নিলেও শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারিনি৷'' কেন পারেননি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘মেশিনে হাত দিলেই আমার শরীর কাঁপে৷ বিদ্যুৎ চলে গেলে ভয় পাই৷ সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে মনে হয় পড়ে যাব৷''
ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘দুঃসহ স্মৃতি তাদের তাড়া করছে৷ তাদের মধ্যে অপরাধ বোধও কাজ করছে৷ কারণ তাদের চোখের সামনেই তাদের সহকর্মী মারা গেছে৷ কেউ কাউকে সহায়তা করতে পারেননি৷''‘
তিনি বলেন, ‘‘সমস্যা হচ্ছে আহতরা এখন আর এক জায়গায় নেই৷ সমন্বিতভাবে তাদের চিকিত্সা এবং পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি৷ তবে এখনো সময় আছে৷ তাদের সমন্বিতভাবে চিকিত্সা এবং পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়ার৷ নয়তো তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না৷''
প্রসঙ্গত ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক নিহত ও প্রায় আড়াই হাজারের শ্রমিক আহত হন৷
রানা প্লাজায় আহতদের সহায়তায় জার্মানিতে প্রদর্শনী
রানা প্লাজা ধসে আহত পোশাক শ্রমিকদের সহায়তায় জার্মানির বিলেফেল্ড শহরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো এক আলোকচিত্র প্রদর্শনী৷ একটি গির্জায় আয়োজিত এই প্রদর্শনী থেকে সংগৃহীত অর্থ ব্যয় হবে আহত শ্রমিকদের সহায়তায়৷
ছবি: DW/A. Islam
বিলেফেল্ডে প্রদর্শনী
জার্মানির বিলেফেল্ড শহরের একটি গির্জায় ২৬ জানুয়ারি প্রদর্শন করা হয় একদল পোশাক শ্রমিকের ছবি, যাঁরা রানা প্লাজা ধসের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত৷ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য, ২০১৩ সালের ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এ সব মানুষ সম্পর্কে জার্মানদের জানানো৷ পাশাপাশি তাঁদের সহায়তায় অর্থ সংগ্রহ৷
ছবি: DW/A. Islam
শুধু ছবি নয়
বিলেফেল্ডে গির্জার পাশের সম্মেলন কক্ষে পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন ছবির পাশেই শোভা পাচ্ছিল কিছু টি-শার্ট৷ সাদা এই টি-শার্টের উপরে লেখা রয়েছে ‘ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন’৷
ছবি: DW/A. Islam
উৎসুক দৃষ্টি
একটি ছবির ক্যাপশনের দিকে প্রদর্শনীতে আগত দর্শকদের উৎসুক দৃষ্টি৷
ছবি: DW/A. Islam
ছিলেন বাঙালিরাও
বিলেফেল্ডে বসবাসরত বাঙালিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছবি প্রদশনীটি দেখতে গির্জায় হাজির হন৷ সাভারে পোশাক শ্রমিকদের করুণ পরিণতিতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যথিত তাঁরা৷
ছবি: DW/A. Islam
গির্জার ভেতরে
গির্জায় রবিবার প্রার্থনা সভা চলাকালে বাংলাদেশের এই ছবিটিসহ আরো কয়েকটি ছবি প্রদর্শন করা হয় প্রার্থনা কক্ষের ভেতরেই৷ বাংলাদেশ সম্পর্কে জার্মানির আমজনতাকে ধারণা দেওয়ার ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ স্থানীয় গণমাধ্যমেও সাড়া জাগিয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
আয়োজকের কথা
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে স্বেচ্ছাসেবী ব্যার্নহার্ড হ্যার্টলাইন প্রদর্শনীর আয়োজন করেন৷ ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা জানতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন তিনি৷ উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারোশ’র বেশি মানুষ নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হন, যাঁদের অধিকাংশই পোশাক শ্রমিক৷
ছবি: DW/A. Islam
অর্থ যাচ্ছে স্নেহা ফাউন্ডেশনে
ব্যার্নহার্ড হ্যার্টলাইন জানান, প্রদর্শনী থেকে সংগৃহীত অর্থ স্নেহা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকদের সহায়তায় খরচ করা হবে৷ ফাউন্ডেশনটি ৩০ জন নারী পোশাক শ্রমিকের দীর্ঘমেয়াদি পুর্নবাসনের দায়িত্ব নিয়েছে, যাঁরা ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এবং মা৷
ছবি: DW/A. Islam
7 ছবি1 | 7
বাংলাদেশে পোশাক কারখানার নিরাপত্তা
পশ্চিমা বিশ্বের একদল পরিদর্শক বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে ভয়াবহ নিরপত্তা ঝুঁকি দেখতে পেয়েছেন৷ রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় তারা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
রানা প্লাজা বিধ্বস্তের পর...
২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হলে নিহত হয় অন্তত ১,১০০ পোশাক শ্রমিক৷ এ ঘটনার পর পশ্চিমা যেসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়, তারা পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়৷ সম্প্রতি বেশ কিছু নামি-দামি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করেছেন৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ঝুঁকি
পরিদর্শকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ পোশাক কারখানায় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা এবং ভবনের কাঠামোর বিষয়ে অন্তত ৮০,০০০ নিরারপত্তা ইস্যু খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷
ছবি: Kamrul Hasan Khan/AFP/Getty Images
২,২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য
বাংলাদেশে পোশাক খাতে বাণিজ্যের পরিমাণটি বিশাল৷ অর্থের অঙ্কে প্রায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার৷
ছবি: DW/C. Meyer
পোশাক রপ্তানিতে মন্দা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে গার্মেন্টসগুলো তাদের ক্রেতা হারাচ্ছে৷ ফলে পোশাক রপ্তানির হার হ্রাস হয়েছে৷
ছবি: Reuters
পোশাক কারখানা পরিদর্শন
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম এবং ইনডিটেক্সসহ ১৮০টিরও বেশি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি ও সদস্যরা অন্তত ১,১০৬টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ তাঁরা জানিয়েছেন, প্রতিটি কারখানায় বৈদ্যুতিক ঝুঁকির পাশাপাশি, ভবনের কাঠামো ও অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাতে গাফিলতি খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷ এমনকি অনেক কারখানায় ফায়ার অ্যালার্ম ও ফায়ার এক্সিটও নেই৷
ছবি: DW/C. Meyer
অবিলম্বে খালি করার নির্দেশ
১৭টি কারখানা অবিলম্বে খালি করে বন্ধের নোটিস দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিদর্শকরা৷ কারণ ঐ ১৭টি কারখানা যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা৷ এছাড়া ১১০টি কারখানার ভবন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলেও জানা গেছে৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা
এর আগে নর্থ অ্যামেরিকান কোম্পানি ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর মতো বেশ কিছু কোম্পানির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের ৫৮০টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ উদ্দেশ্য একই, নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা৷ দেশের অন্তত ৩০০টি কারখানায় ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর পোশাক তৈরি হয়৷
ছবি: AP
আশঙ্কায় শ্রমিকরা
তবে যেসব কারখানা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে, সেসব শ্রমিকরা বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন৷ কেননা পরিদর্শকরা শ্রমিকদের বেতন দেয়ার কথা বললেও মালিকরা এ বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি৷
ছবি: Imago/Xinhua
পরবর্তী পদক্ষেপ
পরিদর্শকরা বেশিরভাগ কারখানার মালিক ও প্রকৌশলীদের নিয়ে আলোচনায় বসে কী কী ইস্যুতে পরিবর্তন আনা দরকার, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে৷ এরপর আবারো তাঁরা পরিদর্শনে আসবেন নিজেদের নির্দেশনা কতটা বাস্তবায়ন হলো, তা দেখার জন্য৷