রানা প্লাজা ধসের দুই বছর হতে চললেও এখনো কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি৷ এমন পরিস্থিতিতে সরকারের প্রতি শ্রম আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷
বিজ্ঞাপন
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দুই বছরকে সামনে রেখে একটি জরিপ চালানো হয়৷ মঙ্গলবার এই জরিপের ফলাফল জানানো হয়৷ এতে বিভিন্ন কারখানার দুই হাজার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে৷ জরিপের তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, গার্মেন্টস পরিদর্শক জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স সম্পর্কে ৯২ শতাংশ শ্রমিক কিছুই জানেন না বা বোঝেন না, ৮০ শতাংশ শ্রমিক গার্মেন্টসের বিকল্প থাকলে এ পেশা ছেড়ে দিতেন৷ তিনি বলেন, শ্রমিকরা আনন্দের সঙ্গে গার্মেন্টসের কাজ করতে ছুটে আসছে, বিষয়টি তা নয়৷ এ খাতে এখনো শ্রমিকদের জীবন ও কর্মপরিবেশ নিম্নমানের – এমনকি বর্বরোচিত৷
এমন পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের পক্ষ থেকে রানা প্লাজা ও তাজরীনের ‘খুনী' মালিকদের হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া, অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া, ২৪ এপ্রিলকে (রানা প্লাজা ধসের দিন) শোক দিবস ঘোষণা করা, নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের ৪৮ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া, আহতদের সুচিকিত্সা দেয়া, নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক কারখানা গড়ে তোলা, ইপিজেড এলাকাসহ সব এলাকায় ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং শ্রমিকদের উপর নির্যাতন বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে৷
বাংলাদেশে পোশাক কারখানার নিরাপত্তা
পশ্চিমা বিশ্বের একদল পরিদর্শক বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে ভয়াবহ নিরপত্তা ঝুঁকি দেখতে পেয়েছেন৷ রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় তারা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
রানা প্লাজা বিধ্বস্তের পর...
২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হলে নিহত হয় অন্তত ১,১০০ পোশাক শ্রমিক৷ এ ঘটনার পর পশ্চিমা যেসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়, তারা পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়৷ সম্প্রতি বেশ কিছু নামি-দামি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করেছেন৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ঝুঁকি
পরিদর্শকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ পোশাক কারখানায় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা এবং ভবনের কাঠামোর বিষয়ে অন্তত ৮০,০০০ নিরারপত্তা ইস্যু খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷
ছবি: Kamrul Hasan Khan/AFP/Getty Images
২,২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য
বাংলাদেশে পোশাক খাতে বাণিজ্যের পরিমাণটি বিশাল৷ অর্থের অঙ্কে প্রায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার৷
ছবি: DW/C. Meyer
পোশাক রপ্তানিতে মন্দা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে গার্মেন্টসগুলো তাদের ক্রেতা হারাচ্ছে৷ ফলে পোশাক রপ্তানির হার হ্রাস হয়েছে৷
ছবি: Reuters
পোশাক কারখানা পরিদর্শন
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম এবং ইনডিটেক্সসহ ১৮০টিরও বেশি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি ও সদস্যরা অন্তত ১,১০৬টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ তাঁরা জানিয়েছেন, প্রতিটি কারখানায় বৈদ্যুতিক ঝুঁকির পাশাপাশি, ভবনের কাঠামো ও অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাতে গাফিলতি খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷ এমনকি অনেক কারখানায় ফায়ার অ্যালার্ম ও ফায়ার এক্সিটও নেই৷
ছবি: DW/C. Meyer
অবিলম্বে খালি করার নির্দেশ
১৭টি কারখানা অবিলম্বে খালি করে বন্ধের নোটিস দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিদর্শকরা৷ কারণ ঐ ১৭টি কারখানা যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা৷ এছাড়া ১১০টি কারখানার ভবন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলেও জানা গেছে৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা
এর আগে নর্থ অ্যামেরিকান কোম্পানি ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর মতো বেশ কিছু কোম্পানির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের ৫৮০টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ উদ্দেশ্য একই, নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা৷ দেশের অন্তত ৩০০টি কারখানায় ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর পোশাক তৈরি হয়৷
ছবি: AP
আশঙ্কায় শ্রমিকরা
তবে যেসব কারখানা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে, সেসব শ্রমিকরা বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন৷ কেননা পরিদর্শকরা শ্রমিকদের বেতন দেয়ার কথা বললেও মালিকরা এ বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি৷
ছবি: Imago/Xinhua
পরবর্তী পদক্ষেপ
পরিদর্শকরা বেশিরভাগ কারখানার মালিক ও প্রকৌশলীদের নিয়ে আলোচনায় বসে কী কী ইস্যুতে পরিবর্তন আনা দরকার, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে৷ এরপর আবারো তাঁরা পরিদর্শনে আসবেন নিজেদের নির্দেশনা কতটা বাস্তবায়ন হলো, তা দেখার জন্য৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডে বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের উন্নত কর্মপরিবেশ, ইউনিয়ন গঠনের অধিকারসহ তাদের আইনসঙ্গত অধিকার নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডাবলিউ৷ সংগঠনের এশিয়া বিষয়ক উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ যদি রানা প্লাজা বিপর্যয়ের মতো আরেকটি দুর্ঘটনা এড়াতে চায়, তাহলে দেশটির উচিত কার্যকরভাবে শ্রম আইন বাস্তবায়ন করা৷ পোশাক কারখানার কর্মীরা যাতে দুর্ব্যবহার শঙ্কা ছাড়াই কাজের পরিবেশের ব্যাপারে তাদের কথা প্রকাশ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে৷
ফিল রবার্টসন বলেন, পোশাক প্রতিষ্ঠানের যে ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপকরা পোশাক শ্রমিকদের ওপর হামলা এবং ইউনিয়ন গঠনের অধিকারকে অস্বীকার করেন, বাংলাদেশ যদি তাদের দায়ী না করে, সেক্ষেত্রে সরকার এ ধরনের প্রথাকে স্থায়ী করে তুলবে৷ এসব প্রথার কারণে হাজার হাজার পোশাক শ্রমিককে জীবন দিতে হয়েছে৷ বাংলাদেশ সরকার, পোশাক প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং পশ্চিমা পোশাক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের প্রতি এইচআরডাবলিউ শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং পোশাক প্রতিষ্ঠানের মালিক ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের (সুপারভাইজার) শ্রমিক নেতাদের বেআইনিভাবে টার্গেট করার ঘটনাগুলো অবসানের আহ্বান জানিয়েছে৷
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তি
২৪শে এপ্রিল, ২০১৩৷ সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছের সুউচ্চ ভবন ‘রানা প্লাজা’ ধসে পড়ল বিকট শব্দে৷ ধসের আশঙ্কাকে আমলে না নেয়ার পরিণাম ১,১৩৫ জন পোশাক শ্রমিক, করুণ মৃত্যু৷ আহত এক হাজারেরও বেশি মানুষের এখনো দিন কাটে আতঙ্কে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাঁচা আর বাঁচানোর লড়াই
ভবন মালিক সোহেল রানার অর্থলিপ্সার নির্মম শিকার পোশাক শ্রমিকদের বাঁচানোর জন্য সরকারি উদ্যোগের অপেক্ষায় বসে থাকেননি সাধারণ মানুষ৷ দূর দূরান্ত থেকে ছুটে এসে একরকম খালি হাতেই অনেকে নেমে পড়েন উদ্ধার কাজে৷ নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে বহু পোশাক শ্রমিককে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনেন তাঁরা৷
ছবি: Reuters
অসহায়ত্ব
আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকলেও, ঘটনাস্থলে উদ্ধারকর্মীর কমতি ছিল না৷ তবুও অনেকেই চলে গেছেন স্বজনদের কাঁদিয়ে৷ এ ছবির মতো অবস্থাতেও উদ্ধার করতে হয়েছে অনেক মৃতদেহ৷ ৮০০-রও বেশি মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা গেলেও, অনেকের পরিচয় আজও জানা যায়নি৷ কিছু লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে৷ কিন্তু ৮৭ জনের জন্য নতুন করে নমুনা চাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রেশমার ফেরা
রানা প্লাজা ধসের ১৭তম দিনে ঘটে বিস্ময়কর এক ঘটনা৷ ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে আর কাউকে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব নয় ভেবে সাধারণ উদ্ধারকারীদের অনেকে যখন ঘরে ফিরছেন, তখনই প্রায় সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২২ বছর বয়সি পোশাক শ্রমিক রেশমাকে৷
ছবি: Reuters
এখনো কাঁদে প্রাণ
ধসের পর ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন অনেকে৷ বিজিএমইএ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে মাত্র ১৪ কোটি টাকা৷ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ১২৭ কোটি টাকা জমা হয়েছে ঠিকই, তবে বিতরণ করা হয়েছে ২২ কোটি টাকা৷ ভবন ধসের বর্ষপূর্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের মুখে শোনা গেছে হতাশা আর ক্ষোভের কথা৷ পপি বেগমকে কেড়ে নিয়েছে রানা প্লাজা৷ ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে তাঁর কবর জিয়ারত করতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন বোন রোজিনা৷
ছবি: DW/M. Mamun
মায়ের কান্না
জুরাইন কবরস্থানে রশিদা খাতুনের কবরের পাশে সফুরা খাতুন৷ ভবন ধসের প্রায় দশ মাস পর, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি পেয়েছিলেন সন্তানের লাশ খুঁজে পাওয়ার সান্ত্বনা৷
জুরাইন কবরস্থানে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করতে মূলত তাঁদের পরিবারের সদস্যরাই এসেছিলেন৷ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বর্ষপূর্তিতে আয়োজন ছিল অনেক, তবে জুরাইন কবরস্থানে ভিড় ছিল না তেমন৷ সেখানে এভাবেই হারানো স্বজনের ছবি হাতে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছিলেন এক নারী৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রদর্শনী
রানা প্লাজা ধসের ছবি নিয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়েছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী৷ বাংলাদেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত ৬০ জন আলোকচিত্র সাংবাদিকের তোলা ছবি স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ফুলের জলসা
রানা প্লাজা ধসে নিহতদের ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছে বেশ কিছু শ্রমিক সংগঠন৷
ছবি: DW/M. Mamun
মোনাজাত
জুরাইন কবরস্থানে নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত৷
ছবি: DW/M. Mamun
10 ছবি1 | 10
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১,১০০ জনেরও বেশি পোশাক শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ এরপর ২ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে৷ ওই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশের পোশাক প্রতিষ্ঠানসমূহকে আরও নিরাপদ করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে এইচআরডাবলিউ-র প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷
অপরদিকে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দুই বছর পরও শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিপূরণ, আহত শ্রমিকদের নিয়মিত চিকিত্সা ও পুনর্বাসন, দায়ীদের শাস্তির মত বিষয়ে এখনো সুরাহা হয় নি৷ এ সব বিষয়ে দ্রুততম সময়ে সম্মানজনক সমাধান হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)৷ মঙ্গলবার রানা প্লাজার দুই বছরকে সামনে রেখে আয়োজিত এক সংলাপে সিপিডি-র পক্ষ থেকে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়৷ রানা প্লাজার ঘটনায় দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা, ক্ষতিপূরণের মানদণ্ড নির্ধারণ করা, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা অপসারণ, কারখানা পরিদর্শনকারী দল অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কমিটির (এনটিপিএ) কাজে সমন্বয় আনা, কারখানা সংস্কার কার্যক্রম কার্যকরভাবে সমাপ্ত করা, বিদেশী ক্রেতারা (বায়ার) পোশাকের উচিত মূল্য দেয়ার উপর গুরুত্ব দেন সিপিডি-র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য৷