রামপালে ভারতের কয়লা পোড়ানো নিয়ে আগে থেকেই কানাঘুষা চলছিল৷ বাংলাদেশ এ বিষয়ে পরিষ্কার কিছু জানায়নি৷ তবে ভারতের গণমাধ্যম ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভারতের কয়লাই রামপালে পোড়ানো হতে পারে৷ এটা সত্যি হলে উদ্বেগের কারণ আছে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের সুন্দরবনের কাছে ভারতের সহায়তায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করছেন পরিবেশবাদী অ্যাক্টিভিস্টরা৷ তাদের বক্তব্য হচ্ছে, নির্মাণাধীন কয়লা খনিটির কার্যক্রম শুরু হলে তা সুন্দরবনের জন্য হবে বিপর্যয়কর৷ পরিবেশ দূষণের কারণে সুন্দরবন একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে – এই বক্তব্যের পক্ষে অনলাইনে এবং অফলাইনে নানারকম যুক্তি দিয়েছেন তাঁরা৷ এসব যুক্তির একটি হচ্ছে, রামপালে ব্যবহারের জন্য ভারতের কয়লা আমদানি করা হতে পারে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যা অত্যন্ত নিম্নমানের৷ এই কয়লা পোড়ালে মাত্রাতিরিক্ত সালফার উৎপন্ন হয়, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর৷
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি রামপালের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে এবং কেন সেটি সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর হবে না – তা জানাতে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন৷
সেখানে তিনি বিভিন্ন বক্তব্য দিলেও ভারত থেকে কয়লা আমদানি করা হবে না এমন কোনো বক্তব্য দেননি৷ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করার সুযোগ থাকলেও তারা তা করার বদলে প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেই সময় কাটিয়েছেন৷ ফলে ব্যাপারটি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছিল৷
ভারতীয় গণমাধ্যম অবশ্য মঙ্গলবার বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছে৷ সে দেশের কয়লা বিষয়ক সচিব অনিল স্বরুপ জানিয়েছেন, কয়লা রপ্তানির ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সরকারের ‘গভীর আলোচনা' চলছে৷ ভারতে কয়লার চাহিদা কমে যাওয়ায় এবং রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ায় রপ্তানির ব্যাপারটি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন স্বরূপ৷ তিনি আশা করেছেন, পাশের দেশে রপ্তানি সম্ভব হলে ভারতীয় কয়লার বিক্রি বাড়বে৷
এখানে বলে রাখা ভালো, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধীতাকে ‘ভারত বিরোধীতা' বলে আখ্যা দিচ্ছে খোদ বাংলাদেশ সরকার৷ ফলে যাঁরা এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন, তাদের উপর এক ধরনের ‘সাম্প্রদায়িকতার' ছাপ এঁটে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা এড়াতে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ এই বিষয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকছেন৷ ডয়চে ভেলেকে এরকম একজন বিশেষজ্ঞ কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সরকার অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রামপালের জন্য কয়লা আনার কথা বললেও কয়লা আসলে আনা হবে ভারত থেকে৷ আর আন্তর্জাতিকভাবেই ভারতের কয়লাকে ‘নিম্নমানের' বিবেচনা করা হয়, কেননা এতে সালফারের পরিমাণ বেশি৷
শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের অনেক পরিবেশবাদীও রামপালে কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের বিরোধিতা করেছেন সুন্দরবনের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় এনে৷ তাদের আলোচনায় এটাও উঠে এসেছে যে, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে ট্রাকে করে কয়লা পরিবহণ করা হতে পারে, যা বনের ক্ষতির মাত্রা আরো বাড়াবে৷
প্রশ্ন হচ্ছে, এত ক্ষতির কথা জেনেও বাংলাদেশ সরকার রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মরিয়া কেন? আপনার মতামত লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷