সুন্দরবনের পাশে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে করা পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) সঠিকভাবে করা হয়নি বলে মনে করছে ইউনেস্কো৷ তাই সমীক্ষাটি আবারো করতে বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের সংস্থাটি৷
বিজ্ঞাপন
ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ইউনেস্কো গতমাসে বাংলাদেশ সরকারকে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে৷ ইউনেস্কোর তিন প্রতিনিধির সুন্দরবন পরিদর্শন নিয়ে তৈরি ঐ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে নতুন করে ইআইএ করে আইইউসিএন এর কাছ থেকে ‘অ্যাডভাইস নোট' নিয়ে জমা দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে৷ এছাড়া এই প্রতিবেদনের আগে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু না করারও আহ্বান জানানো হয়েছে৷
আগামী মাসের ১১ তারিখের মধ্যে সরকারকে প্রতিবেদনের উত্তর দিতে বলা হয়েছে৷
ইউনেস্কোর এই প্রতিবেদন এমন এক সময়ে এসেছে যখন ‘বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড' শিগগিরই ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তিতে সই করতে যাচ্ছে বলে আশা করা হচ্ছে৷
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঢাকার ঐ জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে ইউনেস্কোর প্রতিবেদনের উত্তর তৈরি হয়ে যাবে৷ তবে নতুন করে ইআইএ করা হবে কিনা সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানান তিনি৷
এদিকে, গ্রিনপিস সহ ৪০টি আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনের নেটওয়ার্ক ‘ব্যাংকট্র্যাক' রামপাল প্রকল্পে অর্থ সহায়তা না দিতে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে৷ সংস্থাটি বলছে, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবনের মানুষ ও প্রাণীর প্রতি হুমকিস্বরূপ৷
আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠনের আরেকটি নেটওয়ার্ক ‘ফ্রেন্ডস অফ দ্য আর্থ ইন্টারন্যাশনাল' বা এফওইআই বাংলাদেশের ক্ষতিকারক কয়লা প্রকল্পে অর্থায়ন না করতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে৷
রামপাল ছাড়াও সুন্দরবনের পাশে বাংলাদেশের ওরিয়ন গ্রুপের আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে এবং সেই প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিম ব্যাংক সহায়তা করতে পারে এমন সম্ভাবনার খবর তাদের কাছে বলে দাবি করছে এফওইআই৷ এই দাবির পক্ষে তথ্যপ্রমাণ হিসেবে কিছু কাগজপত্র এফওইআই-এর কাছে আছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ বিষয়ক সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘ইকোওয়াচ'৷ এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা, যার শিরোনাম ‘যুক্তরাষ্ট্রের করের টাকা কি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংসে অর্থায়ন করা হচ্ছে?'
সংকলন: জাহিদুল হক
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷