ইউনেস্কোর রামপাল মনিটরিং মিশন থেকে পরিষ্কারভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের বা সরানোর নির্দেশনা রয়েছে, বার্লিনে এক সম্মেলনে একথা বলেন অ্যাক্টিভিস্ট অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ৷
বিজ্ঞাপন
ইউনেস্কোর রামপাল মনিটরিং মিশন থেকে পরিষ্কারভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের বা সরানোর নির্দেশনা রয়েছে, বার্লিনে এক সম্মেলনে একথা বলেন অ্যাক্টিভিস্ট অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ৷
জার্মানির রাজধানী বার্লিনে চলছে ‘‘সুন্দরবন রক্ষা এবং বাংলাদেশে বিকল্প জ্বালানি নীতির সম্ভাবনা'' শীর্ষক দু'দিনব্যাপী সম্মেলন৷ তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ইউরোপীয় অ্যাকশন গ্রুপের উদ্যোগে আয়োজিত এই সম্মেলনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র অবিলম্বে বন্ধের দাবি উঠেছে৷ তাদের মতে, বাংলাদেশে বিদ্যুতের প্রয়োজন হলেও তা সুন্দরবনের ক্ষতি করে তৈরির দরকার নেই৷
বার্লিন সম্মেলনে অংশ নেয়া অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘রামপালবিরোধী আন্দোলনে যে ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে সেটা স্বীকার করতে সরকার নারাজ৷ সরকার যদি কিছু গোষ্ঠীর দায়দায়িত্ব রক্ষার চেষ্টা না করে জনগণের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতেন, জনগণের ভাষাটা বুঝতে চেষ্টা করতেন তাহলে দেখতেন যে সারা দেশে কোম্পানির সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী ছাড়া বাকি সকলেই সুন্দরবন আন্দোলনের সমর্থক৷''
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভয় দিলে তাঁর দলের অনেকেও রামপাল বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেবেন বলে মনে করেন আনু মুহাম্মদ৷ রামপাল বিরোধীদের ‘উন্নয়নবিরোধী' এবং ‘রাষ্ট্রদ্রোহী' বলা হচ্ছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রদ্রোহী খেতাব পাওয়া নতুন নয়৷ এর আগে গ্যাস রপ্তানি বন্ধের আন্দোলন করে এই খেতাব পেয়েছি, ফুলবাড়ির উন্মুক্ত কয়লা খনির বিরোধিতা করায় সময় পেয়েছি৷ কিন্তু পরে দেখা গেছে আমাদের আন্দোলন সঠিক ছিল৷''
সুন্দরবনকে ক্ষতি করে, উপকূলকে ক্ষতি করে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশকে অক্ষম করে, কোটি মানুষকে নিরাশ্রয় করে কোনো প্রকল্প, সেটা যে দেশেরই হোক, আমাদের কোনভাবে গ্রহণ করা উচিত নয় বলে জানান বাংলাদেশের আলোচিত এই অধ্যাপক৷ রামপালবিরোধী আন্দোলন করায় ভারত গত এপ্রিল মাসে তাঁকে ভিসা দেয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘ভারত একটা বড় রাষ্ট্র৷ একটি বিষয় নিয়ে মতবিরোধ হচ্ছে বলে ভারতের এই আচরণ খুবই ন্যাক্কারজনক৷''
উল্লেখ্য, সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে ভারতের সহায়তায় ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ বর্তমানে অব্যাহত রয়েছে৷ এই প্রকল্পের প্রতিবাদে বার্লিনে সম্মেলনে অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে জার্মানিসহ ইউরোপে বসবাসরত বাংলাদেশিরা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠনেরপ্রতিনিধিরা রয়েছেন৷ সম্মেলন শেষ হবে ২০ আগস্ট৷
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷
ছবি: DW
10 ছবি1 | 10
এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে আপনার কোন মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷