শুরু হয়ে যাচ্ছে রামমন্দিরের কাজ। করোনার মধ্যেই। ভূমিপুজোয় থাকবেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর পিছনে রাজনৈতিক লক্ষ্যও কাজ করছে।
বিজ্ঞাপন
অযোধ্যায় রামমন্দিরের জন্য ভূমিপুজোর কাজ শুরু হবে আগামী ৩ অগাস্ট। ভূমিপুজো হবে ৫ অগাস্ট। সে দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যায় উপস্থিত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই প্রথম অযোধ্যায় রামজন্মভূমিতে পা রাখবেন মোদী।
রামজন্মভূমি ট্রাস্টের তরফে জানানো হয়েছে, বারণসীর পুরোহিতরা ভূমিপুজোর দায়িত্বে থাকবেন। তাঁদের সঙ্গে থাকবেন অযোধ্যার পুরোহিতরাও। ভূমিপুজোর দিন গর্ভগৃহে পাঁচটি রুপোর ইট রাখা হবে। গর্ভগৃহ হবে আটকোণা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মন্দিরের যে নকশা বানিয়েছিল, মূলত তাকেই অনুসরণ করা হচ্ছে, তবে তা আরও বড় করা হয়েছে। তিনটি গম্বুজের জায়গায় পাঁচটি গম্বুজ থাকবে। মন্দিরের আয়তন হবে প্রায় ৮৪ হাজার বর্গফুট।
প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, সেই সঙ্গে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে অমিত শাহ, মোহন ভাগবত, নীতীশ কুমার, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে সহ প্রায় শতিনেক অভ্যাগতকে। তবে উদ্ধব যাবেন কি না, তা জানা যায়নি।
কিন্তু এই করোনাকালে রামমন্দির নির্মাণ শুরু করে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিক শরদ পাওয়ার। তিনি বলেছেন, ''কোন কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, সেটা আগে ঠিক করতে হয়। এখন যেমন করোনাকে থামানো এবং অর্থনীতির হাল ফেরানোর কাজটাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কিছু লোক হয়ত ভাবেন, মন্দির তৈরি করলে করোনা সেরে যাবে। কিন্তু আমাদের কাছে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই ও অর্থনীতির হাল ফেরানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।''
এর জবাবে বিজেপি-র মুখপাত্র সুদেশ বর্মা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে রামমন্দিরনির্মাণের তুলনা হওয়া উচিত নয়। এখন আনলক-পর্ব শুরু হওয়ার পর সবকিছুই খুলে গিয়েছে। পুজো এবং উপাসনা চালু হয়েছে। সরকার করোনার সঙ্গে লড়াই করছে এবং সফল হয়েছে। দিল্লি ও মুম্বইতে করোনার প্রকোপ কমেছে। বাকি জায়গাতেও কমবে। এর পাশাপাশি রামমন্দিরের ভূমিপুজো হতে অসুবিধা কোথায়? পুরোহিতরা এই সময় ঠিক করেছেন। তা নিয়ে বিতর্ক অনর্থক।''
তবে অগাস্টের পাঁচ তারিখ ভূমিপুজো করার মধ্যে অন্য একটা বার্তা আছে বলে মনে করেন প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''ঠিক এক বছর আগে ৫ অগাস্ট কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এক বছর পরে আবার রামমন্দিরের ভূমিপুজো হচ্ছে। তার থেকে মনে হচ্ছে, ৫ অগাস্ট দিনটা ভেবেচিন্তেই বেছে নেওয়া হয়েছে।''
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, রাম মন্দির, নাকি মোগল সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত একটি মসজিদ? বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৩ সাল থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চলেছে, যা চরমে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে৷
ছবি: dpa - Bildarchiv
১৫২৮ সালে নির্মাণ
রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত৷ তারই কাছে রামকোট পর্বত৷ ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান' বলেও পরিচিত ছিল৷
ছবি: DW/S. Waheed
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার৷ অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. E. Curran
সংঘাতের সূত্রপাত
প্রথমবারের মতো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত৷১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
হিন্দুদের দাবি
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি৷ তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি৷
ছবি: AP
বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর – বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷
ছবি: DW/S. Waheed
নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন ‘‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে’’৷
ছবি: Getty Images
মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে৷ ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ৷ অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন৷
ছবি: AP
‘রাম রথযাত্রা'’
১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস'-এর অনুমতি পায়৷ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা'’ শুরু করেন৷
ছবি: AP
১৯৯২
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছান৷ ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়৷ ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
ছবি: AP
শিলালিপি কী বলে
পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল৷ আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী'-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির৷
ছবি: CC-BY-SA-Shaid Khan
বিজেপি দোষী
বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়৷ প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়৷
ছবি: AP
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত৷ এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন৷ রায়ে আরো বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে৷ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই জমিটি ভাগ করতে চান না৷
ছবি: AP
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷
ছবি: AP
মন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়
ভারতের অযোধ্যার এক বিতর্কিত জমি নিয়ে কয়েক দশক অপেক্ষার পর ৯ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত৷ রায়ে ওয়াকাফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহী আখড়ার জমির উপর দাবি দুটোই খারিজ করে দেন বিচারকরা৷ বিতর্কিত সেই জমিতে একটি ট্রাস্টের অধীনে মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত৷ পাশাপাশি, একটি মসজিদ গড়তে কাছাকাছি অন্য কোথাও মুসলমানদের পাঁচ একর জমি দিতেও বলা হয়েছে রায়ে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. Armangue
17 ছবি1 | 17
এতদিনে একটা কথা পরিষ্কার, মোদী-শাহ সবসময়ই একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করেন। তাঁরা অনেকদূর পর্যন্ত ভেবে রাখেন। বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, এই দিন ঠিক করার ক্ষেত্রেও বড় রাজনৈতিক পরিকল্পনা রয়েছে। আর কয়েক মাস পরে বিহারে বিধানসভা ভোট। সামনের বছর পশ্চিমবঙ্গে। আর রামমন্দির তৈরি হতে তিন থেকে সাড়ে তিন বছর লাগবে। যখন রামমন্দির শেষ হবে, লোকের জন্য খুলে যাবে, তখন লোকসভা নির্বাচন এসে যাবে। রামমন্দির তাঁদের বিধানসভা তো বটেই, লোকসভাতেও জেতার ক্ষেত্রে বড় অস্ত্র হবে বলে বিজেপি নেতাদের আশা।
তবে শরদ মনে করেন, ''বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরেই তো অযোধ্যায় রামমন্দির ছিল। সেই মন্দির এ বার বিশাল করে গড়ে উঠবে। সেটা রামভক্তদের কাছে শ্লাঘার বিষয় হতে পারে, কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সম্ভবত খুব বেশি হবে না। সেটা আর ভাবাবেগের ঘটনা হয়ে উঠবে না। মনে রাখবেন বাবরি ধ্বংসের এক বছর পর উত্তর প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি হেরেছিল।'' বিজেপি নেতাদের অবশ্য দাবি, উত্তর ভারতে যদি রামমন্দিরের প্রভাব না পড়ে তো কীসে পড়বে? মোদী ক্ষমতায় আসার পর তিন তালাক বন্ধ করেছেন, ৩৭০ ধারা বিলোপ করেছেন, এ বার রামমন্দিরও হচ্ছে। এর মধ্যে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি যদি হয়ে যায়, তা হলে তো কথাই নেই। জেতার জন্য এটাই যথেষ্ট।
একসময় রামরথের সওয়ার হয়েই নিজেদের জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়িয়ে নিয়েছিল বিজেপি। এখন আবার রামমন্দিরে সওয়ার হয়ে তারা একের পর এক নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়। সেই সঙ্গে আবার সেই স্লোগানটা উঠবে, মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়, মানে মোদী থাকলে সবই সম্ভব। রামমন্দির তৈরি শুরু হওয়ার পর সেই সম্ভবের তালিকায় রামমন্দিরও সম্ভবত যোগ করবে বিজেপি।