রামমন্দিরের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে কাকে ডাকা যাবে না, কোন কথা বলা যাবে না, তা জানিয়ে দিল জেলা প্রশাসন। চ্যানেলগুলিকে হলফনামা দিয়ে অনুমতি নিয়ে অযোধ্যা থেকে অনুষ্ঠান করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
আগামী ৫ অগাস্ট বেলা বারোটা বেজে ১৫ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে অযোধ্যায়রামমন্দিরের ভূমিপুজোর মূল অনুষ্ঠান হবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গর্ভগৃহে ২২ কেজি ৬০০ গ্রামের রুপোর ইট স্থাপন করবেন। অযোধ্যায় সেই অনুষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব পাবে ভারতের সব টিভি চ্যানেলে। কিন্তু সেদিন টিভি চ্যানেলে রামমন্দির নিয়ে আলোচনার সময় কী করতে হবে, তার রূপরেখা তৈরি করে দিল উত্তর প্রদেশ প্রশাসন।
অযোধ্যা জেলা প্রশাসন জানিয়ে দিয়েছে, যে সব টিভি চ্যানেল ওই দিন অযোধ্যা থেকে খবর দেখাতে চায়, আলোচনা করতে চায়, তাঁদের আগাম অনুমতি নিতে হবে এবং একটি হলফনামা দিতে হবে। সেখানে বলা থাকবে, কোনও বিতর্কিত ব্যক্তিকে, মোকদ্দমাকারীকে বিতর্কে ডাকা যাবে না। হলফনামায় টিভির কর্তাকে বলতে হবে, ''আইন ও শৃঙ্খলায় যদি কোনওরকম সমস্যা হয়, তা হলে ব্যক্তিগতভাবে আমি দায়ী থাকব।''
মোট নয়টি ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হবে বা নিয়ম পালন করতে হবে। আলোচনা, বিতর্ক বন্ধ ঘরে করতে হবে। বাইরে করা যাবে না। করোনার সময় বাইরে ক্যামেরা ঘিরে লোক জমে গেলে মুশকিল হবে। শুধু যে বিতর্কিত ব্যক্তিত্বকে ডাকা যাবে না, তাই নয়, কোনও ধর্ম, সম্প্রদায়, ব্যক্তি সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা যাবে না। কোথায় অনুষ্ঠান করা হবে, তা আগাম প্রশাসনকে জানাতে হবে।
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, রাম মন্দির, নাকি মোগল সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত একটি মসজিদ? বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৩ সাল থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চলেছে, যা চরমে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে৷
ছবি: dpa - Bildarchiv
১৫২৮ সালে নির্মাণ
রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত৷ তারই কাছে রামকোট পর্বত৷ ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান' বলেও পরিচিত ছিল৷
ছবি: DW/S. Waheed
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার৷ অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. E. Curran
সংঘাতের সূত্রপাত
প্রথমবারের মতো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত৷১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
হিন্দুদের দাবি
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি৷ তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি৷
ছবি: AP
বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর – বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷
ছবি: DW/S. Waheed
নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন ‘‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে’’৷
ছবি: Getty Images
মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে৷ ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ৷ অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন৷
ছবি: AP
‘রাম রথযাত্রা'’
১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস'-এর অনুমতি পায়৷ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা'’ শুরু করেন৷
ছবি: AP
১৯৯২
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছান৷ ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়৷ ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
ছবি: AP
শিলালিপি কী বলে
পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল৷ আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী'-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির৷
ছবি: CC-BY-SA-Shaid Khan
বিজেপি দোষী
বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়৷ প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়৷
ছবি: AP
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত৷ এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন৷ রায়ে আরো বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে৷ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই জমিটি ভাগ করতে চান না৷
ছবি: AP
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷
ছবি: AP
মন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়
ভারতের অযোধ্যার এক বিতর্কিত জমি নিয়ে কয়েক দশক অপেক্ষার পর ৯ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত৷ রায়ে ওয়াকাফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহী আখড়ার জমির উপর দাবি দুটোই খারিজ করে দেন বিচারকরা৷ বিতর্কিত সেই জমিতে একটি ট্রাস্টের অধীনে মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত৷ পাশাপাশি, একটি মসজিদ গড়তে কাছাকাছি অন্য কোথাও মুসলমানদের পাঁচ একর জমি দিতেও বলা হয়েছে রায়ে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. Armangue
17 ছবি1 | 17
তথ্য বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর মুরলীধর সিং বলেছেন, ''রামমন্দিরের ভূমিপুজো অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার ক্ষেত্রে মিডিয়ার কোনও অসুবিধা হবে না। সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মিডিয়া সেন্টার থাকবে। লাইভ দেখানোর ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু করোনা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ঠিক হয়েছে, চ্যানেলগুলিকে আগে থেকে অনুমতি নিতে হবে। তাঁদের দেখতে হবে, জনসমাবেশ যাতে না হয়, কোনো বিতর্কিত কথা যেন বলা না হয়। সকলে যেন প্রটোকল মেনে চলেন।''
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এ ভাবে কাকে বিতর্কে ডাকা যাবে, বিতর্কে কী বলা যাবে, কী বলা যাবে না, সেই সব ঠিক করে দেওয়ার মানে কি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপ নয়? তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ ও আইনজীবী সুখেন্দু শেখর রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''এটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। মত প্রকাশের অধিকার হলো মৌলিক অধিকার। ভারতীয় দণ্ডবিধিতেই বলা আছে, উত্তেজনা ছড়ানো যাবে না, দাঙ্গা-হাঙ্গামা করা যাবে না। তার জন্য প্রশাসন আগাম সতর্কতা নিতে পারে। সকলকে সতর্ক করে দিতে পারে। কিন্তু ''টিভির বিতর্কে কী বলতে হবে., কাকে ডাকা যাবে না, সেটা প্রশাসন ঠিক করার কে? আমাকে টিভি বিতর্কে ডাকা হলে আমি কী বলব, তা টিভির লোক বা অ্যাঙ্কার কী করে জানবে?''
ভিন্নমত হওয়াটা তো অপরাধ নয়। যতক্ষণ উস্কানিমূলক কোনো কথা বলা না হচ্ছে, ততক্ষণ তো কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। সুখেন্দু শেখর যেমন মনে করছেন, ''জরুরি অবস্থার সময় আইন করে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। এখন আইন ছাড়াই করা হচ্ছে।''
প্রশ্ন উঠছে যে, তা হলে কি শুধু বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের লোকেদেরই টিভির আলোচনায় দেখা যাবে?
বিজেপি নেতারা অবশ্য বলছেন, অযোধ্যায় রামমন্দিরের বিষয়টি এতটাই স্পর্শকাতর যে সামান্য ফুলকিতে উত্তজনা ছড়াতে পারে এবং হাঙ্গামা হতে পারে। সে জন্যই প্রশাসন অত্যন্ত সতর্ক। তারা এ নিয়ে কোনোরকম গন্ডগোল চায় না বলেই নীতিনির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। তা মেনে চললে সকলেরই মঙ্গল।