অযোধ্যায় রাম মন্দির বানানোর জন্য ট্রাস্ট গঠন করল নরেন্দ্র মোদী সরকার৷ এর পাশাপাশি উত্তর প্রদেশ সরকারও ঘোষণা করেছে, অযোধ্যা জেলার ধন্নিপুর গ্রামে পাঁচ একর জমি মসজিদ বানানোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
অযোধ্যায় রাম মন্দির বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিল নরেন্দ্র মোদী সরকার৷ মসজিদ বানানোর জন্যও জমি বরাদ্দ করা হল৷ বুধবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী মোদী ঘোষণা করেন, রামমন্দির বানানোর জন্য পনেরো সদস্যের ট্রাস্ট গঠন করেছে সরকার। তার নাম দেওয়া হয়েছে 'শ্রী রাম জন্মভূমি তীর্থযাত্রা ট্রাস্ট'৷ এই ট্রাস্ট তৈরির জন্য সুপ্রিম কোর্ট তিন মাস সময় দিয়েছিল৷ আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার কথা ছিল৷ তার চার দিন আগে নরেন্দ্র মোদী এই ট্রাস্ট গঠন করলেন৷ ঘটনাচক্রে তিন দিন পরে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন৷
বিরোধীদের অভিযোগ, ধর্মীয় মেরুকরণ করে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে হারানোর মরিয়া চেষ্টা করছে বিজেপি। রাম মন্দির নিয়ে ট্রাস্ট ঘোষণার দিনও তাই এমন ভাবে রাখা হয়েছে, যাতে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে এর প্রভাব পড়ে৷ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল অবশ্য কোনওরকম বিতর্কের মধ্য়ে না গিয়ে ট্রাস্ট গঠনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, ''এই সময়ে ঘোষণা করা নিয়েও আমার কোনও আপত্তি নেই৷ চাইলে কাল বা পরশুও কেন্দ্রীয় সরকার বড় কোনও ঘোষণা করতেই পারে৷'' নির্বাচন কমিশনের যুক্তি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সরকার এই ঘোষণা করেছে। এতে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ হয়নি৷ বিজেপির মুখপাত্র সুদেশ বর্মা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''রামলালা বা রামমন্দির তো ভোটের বিষয় নয়৷ একটা সময়সীমার মধ্য়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হত। সরকার সেটাই করেছে৷''
ট্রাস্টে কোন পনেরোজন সদস্য থাকবেন তা জানাননি প্রধানমন্ত্রী৷ পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন, ট্রাস্টের ১৫ জন সদস্যের মধ্যে একজন দলিতকে রাখতেই হবে৷ সামাজিক সৌহার্দ্যের জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, রাম মন্দির, নাকি মোগল সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত একটি মসজিদ? বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৩ সাল থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চলেছে, যা চরমে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে৷
ছবি: dpa - Bildarchiv
১৫২৮ সালে নির্মাণ
রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত৷ তারই কাছে রামকোট পর্বত৷ ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান' বলেও পরিচিত ছিল৷
ছবি: DW/S. Waheed
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার৷ অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. E. Curran
সংঘাতের সূত্রপাত
প্রথমবারের মতো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত৷১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
হিন্দুদের দাবি
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি৷ তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি৷
ছবি: AP
বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর – বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷
ছবি: DW/S. Waheed
নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন ‘‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে’’৷
ছবি: Getty Images
মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে৷ ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ৷ অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন৷
ছবি: AP
‘রাম রথযাত্রা'’
১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস'-এর অনুমতি পায়৷ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা'’ শুরু করেন৷
ছবি: AP
১৯৯২
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছান৷ ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়৷ ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
ছবি: AP
শিলালিপি কী বলে
পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল৷ আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী'-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির৷
ছবি: CC-BY-SA-Shaid Khan
বিজেপি দোষী
বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়৷ প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়৷
ছবি: AP
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত৷ এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন৷ রায়ে আরো বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে৷ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই জমিটি ভাগ করতে চান না৷
ছবি: AP
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷
ছবি: AP
মন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়
ভারতের অযোধ্যার এক বিতর্কিত জমি নিয়ে কয়েক দশক অপেক্ষার পর ৯ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত৷ রায়ে ওয়াকাফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহী আখড়ার জমির উপর দাবি দুটোই খারিজ করে দেন বিচারকরা৷ বিতর্কিত সেই জমিতে একটি ট্রাস্টের অধীনে মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত৷ পাশাপাশি, একটি মসজিদ গড়তে কাছাকাছি অন্য কোথাও মুসলমানদের পাঁচ একর জমি দিতেও বলা হয়েছে রায়ে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. Armangue
17 ছবি1 | 17
প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় জানিয়েছিলেন, মসজিদের জন্য সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে পাঁচ একর জমি দেওয়ার জন্য উত্তর প্রদেশ সরকারকে বলা হয়েছে, তারা জমি দিতে সম্মত হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরেই উত্তর প্রদেশ সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে অযোধ্যায় জেলা সদর অফিস থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে সোহাবলের ধন্নিপুর গ্রামে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে পাঁচ একর জমি দেওয়া হবে৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আসার পর বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দাবি ছিল, অযোধ্যার চৌহদ্দিতে মসজিদ বানানোর জমি দেওয়া যাবে না৷ যেখানে মসজিদ বানানোর জমি দেওয়া হয়েছে, সেই ধন্নিপুর রাম মন্দির পরিসর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে৷
তবে মুসলিম নেতারা দাবি করেছেন, তারা ওই জমিতে মসজিদ বানাতে চান না৷ মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য কাশিম রসুল ইলিয়াস ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''আমরা সুপ্রিম কোর্টে নিজেদের দাবি জানাতে গিয়েছিলাম৷ আমাদের দাবি খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। তাই আমাদের মসজিদের জন্য আলাদা জমি চাই না৷ উত্তর প্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড রাজ্য সরকারের অধীনে৷ ওরা কী করবে তা বলতে পারছি না৷'' এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসিও বলেছেন, ''আমি সরকারের দেওয়া জমিতে মসজিদ বানানোর বিপক্ষে।'' বিজেপির তরফে সুদেশ বর্মার যুক্তি, ''সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করেছে৷ সুপ্রিম কোর্ট মসজিদ বানানোর জন্য পাঁচ একর জমি দিতে বলেছিল৷ সরকার দিচ্ছে৷ এর বাইরে কে কী বললেন, সেটা আমাদের কাছে অর্থহীন৷''
প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই ট্রাস্ট স্বাধীনভাবে রাম মন্দির নির্মাণ করবে৷ বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, ট্রাস্টের সদস্যদের নাম ঘোষণার পর শিলান্যাসের দিন স্থির হবে। তারপর রাম মন্দির কবে থেকে তৈরি হবে, কীভাবে তৈরি হবে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রামমন্দির বানানোর জন্য যে পাথর কাটার কাজ করছে, তার কী হবে, সেই সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে৷