রাশিয়ার কয়লা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ইউরোপে কার্যকর
১১ আগস্ট ২০২২
দীর্ঘকাল রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানির উপর নির্ভরতা কাটিয়ে তুলতে হিমসিম খাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ বৃহস্পতিবার থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ করলেও তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে নির্ভরতা এখনো রয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার হামলার শাস্তিহিসেবে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়ে চলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ নিজস্ব স্বার্থেই সেই সব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর করা সম্ভব না হলেও ধাপে ধাপে সেই সব নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হচ্ছে৷ তারই আওতায় বুধবার মধ্যরাত থেকে রাশিয়া থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ করা হলো৷ রাশিয়ার উপর পঞ্চম দফার নিষেধাজ্ঞার অংশ হিসেবে ১২০ দিন আগে ইইউ সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ইইউ কমিশনের হিসেব অনুযায়ী এর ফলে রাশিয়া বছরে প্রায় ৮০০ কোটি ইউরো হারাবে৷ উল্লেখ্য, গত বছর পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন আনুমানিক ৪১০ কোটি ইউরো মূল্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ কয়লা রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে৷
রাশিয়া থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ করলেও পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের ক্ষেত্রে ইইউ দ্রুত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না৷ নীতিগতভাবে পেট্রোলিয়াম আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও চলতি বছরের শেষ পর্যন্ত সেই সরবরাহে কোনো বাধা দেবে না ব্রাসেলস৷ তাছাড়া হাঙ্গেরির মতো দেশের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে ইইউ৷ উপকূলবিহীন দেশ হিসেবে হাঙ্গেরি পাইপলাইনের মাধ্যমেরাশিয়া থেকে পেট্রোলিয়াম আমদানি করে৷
ইইউ-র নিষেধাজ্ঞার মুখে মস্কোও হাত গুটিয়ে বসে নেই৷ নানা কারণ দেখিয়ে রাশিয়াই ইউরোপকে জব্দ করতে পেট্রোলিয়াম ও গ্যাসের সরবরাহ হয় কমিয়ে দিচ্ছে অথবা প্রায়ই বন্ধ করে দিচ্ছে৷ চুক্তি ভেঙে গ্যাসের দাম মেটাতে রুবল দাবি করছে রুশ কোম্পানিগুলি৷ রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতির কারণ দেখিয়ে ‘নর্ড স্ট্রিম ১' পাইপলাইন কিছুদিন বন্ধ রেখেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি৷ রাশিয়ার ট্রান্সনেফট কোম্পানি মঙ্গলবার হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়ায় পেট্রোলিয়াম সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
ইউক্রেন সংকটের জের ধরে ইউরোপের জ্বালানি নীতিও প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷ জার্মানি ও পোল্যান্ডের মতো দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার অংশ হিসেবে নিজস্ব কয়লার খনি বন্ধ করে যেভাবে রাশিয়া থেকে আমদানির উপর অতিরিক্ত নির্ভর হয়ে পড়েছিল, সেই নীতির বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা শোনা যাচ্ছে৷ এবার রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি থমকে যাওয়ায় জার্মানি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস ও ইটালির মতো দেশ কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির উপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে৷ চলতি সপ্তাহেই ইইউ প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সেই চাপ আরও বাড়ছে৷
রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতের ফলে জ্বালানির বিকল্প উৎস হিসেবে ইইউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ থেকে আমদানি বাড়াচ্ছে৷ তবে এ ক্ষেত্রে অবকাঠামোর উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, যা সামলানো সব দেশের পক্ষে সহজ হচ্ছে না৷ রেলপথ বা পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি এতকাল অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল৷ আরও অনেক দূর থেকে কয়লা ও পেট্রোলিয়াম জাহাজে করে বন্দরে এনে স্থলপথে সেই জ্বালানি বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছানো বড় চ্যালেঞ্জ৷ গ্যাসের ক্ষেত্রে সেই প্রচেষ্টা আরও কঠিন৷ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানির উদ্যোগও ধীরে ধীরে কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে৷ পাইপলাইনের মাধ্যমে বন্দর থেকে সেই গ্যাস সরবরাহ আরও সমস্যার মুখে পড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷
এসবি/কেএম (ডিপিএ/রয়টার্স)
রাশিয়ার অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
ইউক্রেনে হামলার কারণে নানামুখী নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে রাশিয়া৷ দেশটি বলছে অর্থনীতিতে এর প্রভাব যতটা পড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল ততটা পড়েনি৷ তবে বিশ্লেষকদের মতে, প্রকৃত পরিস্থিতি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে৷
ছবি: Pavel Bednyakov/SNA/IMAGO
নিষেধাজ্ঞার বহর
২২ ফেব্রুয়ারির পর থেকে রাশিয়ার উপর ৮,২২৫টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিভিন্ন দেশ৷ আমদানি-রপ্তানি, ঋণ প্রদান, লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে বাদ দেয়াসহ নানা নিষেধাজ্ঞা ঝুলছে দেশটির উপরে৷ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকি ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করা কাস্টেলাম-এর হিসাবে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ২৬টি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ এরপর আছে সুইজারল্যান্ড, ক্যানাডা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপান৷
ছবি: Torsten Sukrow/SULUPRESS.DE/picture alliance
রুবলের উল্লম্ফন
নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে দেশটির মুদ্রা দুর্বল হওয়ার বদলে শক্তিশালী হয়েছে৷ জানুয়ারির পর থেকে মে পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে রুবল ৪০ শতাংশ শক্তিশালী হয়েছে৷ জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, রাশিয়া থেকে আমদানি পণ্যের মূল্য রুবলে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে৷
ছবি: Jakub Porzycki/NurPhoto/picture alliance
বেড়েছে মূল্যস্ফীতি
জুনের হিসাবে এক বছর আগের তুলনায় রাশিয়ায় মূল্যস্ফীতি বা জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ৷ তবে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে যতটা মূল্যস্ফীতি হবে বলে ধারণা করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে বছর শেষে তা আরো কম হবে৷ যে কারণে মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস ১৮ থেকে ২৩ শতাংশের বদলে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে তারা৷
ছবি: Alexey Malgavko/REUTERS
খরচ কমিয়েছেন ভোক্তারা
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কেনাকাটা কমিয়ে দিচ্ছেন রাশিয়ার মানুষ৷ পণ্যের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের হিসাব থেকে এমন তথ্যই মিলছে৷ গত এপ্রিলে যা ৫৪ শতাংশ কমেছে বলে রাশিয়ার দৈনিক কমারস্যান্টকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে রয়টার্স৷ ফেডারেল স্ট্যাটিস্টিকস সার্ভিসের হিসাবে একই মাসে খুচরা বিক্রি কমেছে ৯.৭ শতাংশ৷ ব্যবসা ও ভোক্তা ব্যয়ে ‘চাহিদা সংকট’ রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রেশেটনিকভও৷
ছবি: Peter Kovalev/TASS/dpa/picture alliance
প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসে পরিবর্তন
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী রাশিয়ায় এপ্রিলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে তিন শতাংশ৷ মে মাসে দেশটির সরকার থেকে জানানো হয়েছিল চলতি বছর জিডিপি সাত দশমিক আট শতাংশ কমতে পারে৷ তবে অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রেশেটনিকভ সম্প্রতি বলেছেন, এই হার পাঁচ থেকে ছয় শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে৷ অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের পূর্বাভাস, বিদেশি বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদন কমায় জিডিপি কমবে ১৫ শতাংশ৷
ছবি: Gavriil Grigorov/dpa/picture alliance
আমদানি কমেছে অনেক
যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞায় বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ও শিল্প উৎপাদন কমায় রাশিয়ার আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে৷ রাশিয়ার বাণিজ্যিক ব্যাংক ওটক্রিতির তথ্য দিয়ে দ্য মস্কো টাইমস জানিয়েছে, এপ্রিলে ৫০০ কোটি থেকে এক হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে দেশটি৷ যেখানে ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয়েছে দুই হাজার ৭৫০ কোটি ডলারের পণ্য৷ তবে সরকারের পক্ষ থেকে সবশেষ মাসের আমদানি, রপ্তানি বিষয়ক তথ্য প্রকাশ করা হয়নি৷
ছবি: Yuri Smityuk/TASS/dpa/picture alliance
চাঙা জ্বালানি রপ্তানি
দ্য ইকোনোমিস্ট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জ্বালানি রপ্তানি থেকে এখনও দৈনিক ১০০ কোটি ডলার আয় করে চলেছে রাশিয়া৷ হেলসিংকিভিত্তিক দ্য সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিয়ার এয়ার-এর তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন হামলার পর প্রথম ১০০ দিনে জ্বালানি রপ্তানি থেকে ৯৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে মস্কো৷ এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল-এর তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশটির তেল রপ্তানি থেকে আয় ১২ শতাংশ বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Aleyev
গাড়ি বিক্রিতে ধাক্কা
অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোপিয়ান বিজনেসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চাহিদা কমে যাওয়া এবং কাঁচামাল সংকটের কারণে মে মাসে গাড়ি বিক্রি রেকর্ড ৮৩ শতাংশ কমেছে৷ রুশ পরিসংখ্যান দপ্তর রসস্ট্যাট-এর তথ্য অনুযায়ী, গাড়ির দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে৷ গাড়ি শিল্পের ক্ষতি কাটাতে প্রণোদনার উদ্যোগ নিতে ১৬ জুন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুটিন৷
ছবি: Stanislav Krasilnikov/TASS/dpa/picture alliance
সার্বিক প্রভাব কতটা?
রুশ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘প্রথম প্রান্তিকের (অর্থনৈতিক) ফলাফল এবং এপ্রিল-মে মাসের পূর্বাভাস বলছে, যতটা খারাপ আশঙ্কা করা হয়েছিল পরিস্থিতি ততটা খারাপ হবে না৷’’ তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান এলভিরা নাবিউলিনা সেন্ট পিটার্সবার্গের অর্থনৈতিক ফোরামে বলেছেন, বিদেশি চাপে রুশ অর্থনীতি যে চাপে পড়েছে, তা অনির্ধারিত সময় ধরে চলমান থাকার শঙ্কা রয়েছে৷ পরিস্থিতি আগের অবস্থায় আর ফিরবে না বলেও আশঙ্কা তার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Belousov
প্রকৃত পরিস্থিতি
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়ার প্রকৃত পরিস্থিতি কী সেটি এখনও পরিস্কার নয়৷ দীর্ঘমেয়াদে দেশটির অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে৷ বিশেষ করে রাশিয়া ছাড়ার ঘোষণা দেয়া বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিগুলো কর্মীদের বেতন দেয়া বন্ধ করলে তা মানুষের আয়ে প্রভাব ফেলবে৷ তবে কর্মসংস্থান, আমদানি, রপ্তানিসহ অর্থনীতির সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ রেখেছে দেশটির সরকার৷