রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কেনার জন্য ভারতের কাছ থেকে বুদ্ধি চেয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। ভারত এই অবস্থায় বাংলাদেশকে কী বুদ্ধি দিতে পারে?
বিজ্ঞাপন
অ্যামেরিকা, ইইউ-র আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ভারত রাশিয়াথেকে সস্তা দরে তেল কিনছে। এখনো পর্যন্ত চাপের কাছে তারা নতিস্বীকার করেনি। বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিবশঙ্কর জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত এক্ষেত্রে নিজের স্বার্থ দেখবে এবং সেইমতো চলবে। ফলে রাশিয়া থেকে তেল কেনার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটবে না ভারত।
রাশিয়া ভারতকে তেল দিচ্ছে অনেকটাই কম দামে। আর ভারত যেহেতু বিশ্বের তৃতীয় বড় তেল আমদানিকারী দেশ, তাই রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কিনে বিদেশি মুদ্রার বিপুল সাশ্রয় করছে দিল্লি। রিফিনিটিভ আইকনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানাচ্ছে, ভারত গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৪ মিলিয়ন ব্যারেল তেল আমদানি করেছে রাশিয়া থেকে। তার মধ্যে ২৪ মিলিয়ন ব্যারেল এসেছে গত একমাসে। ফলে ভারত তেল কেনা বাড়াচ্ছে, কমাচ্ছে না।
কিন্তু ভারতের পক্ষে যা সম্ভব, সেটা কী বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব? বাংলাদেশকে রাশিয়া থেকে তেল কেনা নিয়ে কী পরামর্শ দিতে পারে ভারত? যশবন্ত সিনহা এর আগে পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন। যশবন্তের কাছে ডয়চে ভেলের প্রশ্ন ছিল, সাবেক পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী হিসাবে আপনি বাংলাদেশকে কী পরামর্শ দেবেন? যশবন্তের জবাব, ''আমি বাংলাদেশকে পরামর্শ দেব, রাশিয়া থেকে তেলই না কিনতে।''
যশবন্তের যুক্তি, ''ইউক্রেনের ক্ষেত্রে রাশিয়া আগ্রাসনকারীর ভূমিকায় আছে। যদিও বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এখন নৈতিকতার স্থান খুব একটা নেই, কিন্তু তা কখনোই পুরোপুরি নীতিহীন হতে পারে না। হলে বিপর্যয় হবে।'' তাহলে ভারত কী করে রাশিয়ার থেকে তেল কিনছে? যশবন্তের জবাব, ''রাশিয়া ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু। কিন্তু বন্ধুকে যদি এ কথা বলা না যায়, তুমি ভুল করছো, তাহলে বন্ধুত্ব কীসের? ভারত একবারও রাশিয়ার নিন্দা করা দূরস্থান, তারা যে ভুল করছে, সেই কথাটাই বলতে পারল না। এখানে ভারতের নীতি ঠিক নয়।''
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বড় চ্যালেঞ্জগুলো
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছে৷ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আঞ্চলিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও৷ বেশ কিছু বিষয়ে যেমন বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য রয়েছে, তেমনিই রয়েছে কিছু অমীমাংসিত ইস্যুও৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
ভারতে এনআরসি ও বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব
আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতাদের মুখে শোনা গেছে বাংলাদেশ-বিরোধী নানা মন্তব্য৷ বাংলাদেশ বরাবরই এসব মন্তব্যকে ভারতের ‘অভ্য়ন্তরীণ বিষয়’ বলে এড়িয়ে এসেছে৷ তবে বাংলাদেশও তার বাইরে থাকতে পারেনি৷ ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা, বাংলাদেশের হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা দিয়ে আইন পাস করার বিষয়টি বড় প্রভাব ফেলছে দুই দেশের সম্পর্কেও৷
ছবি: Mohsin Javed
চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর মাধ্যমে সিল্ক রোডকে আবার চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে চীন৷ এই উদ্যোগে বঙ্গোপসাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷ বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগ নিয়ে হাজির চীন৷ ২০১৯ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ এসেছে এক হাজার ৪০৮ মিলিয়ন ডলার। আমদানিতে চীনের ওপরই বাংলাদেশ বেশি নির্ভর করে৷ তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের এমন একক আধিপত্য নিয়ে অনেকের মধ্যে রয়েছে শঙ্কাও৷
ছবি: Jia Qing/HPIC/picture alliance
ভারত-চীন দ্বন্দ্ব
বিশ্বে সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চীন৷ অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হতে চায় ভারতও৷ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই চীন ও ভারত দুই দেশের কাছেই বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ দক্ষিণ এশিয়াতে আধিপত্য নিয়ে বেশ কিছু ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে দুই দেশ৷ এই দ্বন্দ্বে অর্থনৈতিক উপাদানের পাশাপাশি ভারত-মার্কিন জোট কোয়াডও রয়েছে৷ এই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের অবস্থান কী হয়, সেটিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Z. Ling
অভিন্ন নদীর পানিবন্টন
ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে বাংলাদেশের৷ তবে এখন পর্যন্ত গঙ্গা বা পদ্মা ছাড়া অন্য কোনো নদীর পানিবণ্টন নিয়েই ভারত ও বাংলাদেশ মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি৷ তিস্তা নদীর পানিবণ্টন দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে৷ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে এই খাতেও ঘটেছে চীনের প্রবেশ৷ বাংলাদেশে তিস্তার নদী ব্যবস্থাপনায় চীনের মেগাপ্রজেক্ট দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে ভারতের কপালেও৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
রোহিঙ্গা সংকট
কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে৷ তবে সেটিকে আন্তর্জাতিকভাবে মোকাবিলা না করে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমাধানে পৌঁছানোর পথ বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ৷ একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গাম্বিয়ার করা মামলায় সহযোগিতাও করছে বাংলাদেশ৷ এই ইস্যুতেও ভারত ও চীনকে বারবার কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হলেও এখনও তেমন উদ্যোগ আসেনি কোনো পক্ষ থেকেই৷
ছবি: CARE/T. Haque
ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য
ইউরোপের সঙ্গে কূটনীতিতে বরাবরই বাণিজ্য গুরুত্ব পেয়ে এসেছে৷ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশকে পণ্য রপ্তানিতে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে আসছে ইউরোপ৷ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশ এই সুবিধা হারাতে পারে৷ তবে এরপর ‘জিএসপি প্লাস’ নামে একই ধরনের আরেকটি সুবিধার সুযোগ রয়েছে৷ কিন্তু সেজন্য শ্রম অধিকার, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নসহ বিভিন্ন শর্ত রয়েছে ইইউ এর৷
ছবি: Daniel Reinhardt/dpa/picture alliance
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব
সবশেষ ইসরায়েল-হামাস পালটাপালটি রকেট হামলার মধ্যেও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ৷ এই সংকটে বাংলাদেশ যে দুই রাষ্ট্র সমাধানে বিশ্বাসী- সেটিও স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ তবে একই সঙ্গে মার্কিন মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া এবং বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ‘except Israel’ শব্দ দুটি তুলে দেয়ার বিষয়টি কোন পরিবর্তন বয়ে আনে সে বিষয়ে কৌতুহলেরও জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/S. Qaq
7 ছবি1 | 7
প্রশ্ন হলো, বললেই কি রাশিয়া শুনতো? যশবন্তের জবাব, ''না শুনলে ভারত তখন নিজের মতো করে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চলতো। কিন্তু তারা বলবে না কেন?''
পরিস্থিতি আলাদা
আউটলুক পত্রিকার কূটনৈতিক সম্পাদক প্রণয় শর্মা মনে করেন, ভারত ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি আলাদা। ভারত যে চাপ উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় তেল কিনতে পারে, সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নেই। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''ভারত ও অ্যামেরিকা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। অর্থনীতি, সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি সবদিক থেকে দেখতে গেলে অ্যামেরিকা এখনো এক নম্বর দেশ। তাই সকলেই অ্যামেরিকার সঙ্গে সুস্পর্ক রাখতে চায়। অ্যামেরিকা নিজের স্বার্থে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায়।''
প্রণয় মনে করেন, অ্যামেরিকা ভারতকে বেশি গুরুত্ব দেয় দুইটি কারণে। অ্যামেরিকার কাছে চীন হলো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। অ্যামেরিকা মনে করে, ইন্দো-প্যাসিফিকে ভারত বড় ভূমিকা নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভারতের বাজার। ভারতীয়রাও এখন অ্যামেরিকায় বিনিয়োগ করছে। প্রণয় জানিয়েছেন, ''ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক। এখনো ৫০ শতাংশ সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম রাশিয়া থেকে আসে। ভারতের পক্ষে রাশিয়াকে ছেড়ে দেয়া, নিষেধাজ্ঞায় সায় দেয়া সম্ভব নয়। অ্যামেরিকাও প্রকাশ্যে না বললেও বুঝতে পেরেছে, ভারতের নীতির পিছনে যুক্তি আছে।''
কিন্তু বাংলাদেশের কাছে এই সুবিধা আছে কি? প্রণয়ের মতে, ''বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এখন ভালো। আগে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে হিলারি ক্লিন্টনের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তখন দুই দেশের তিক্ততা বাড়ে। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই।'' তার দাবি, ''বাংলাদেশ গত ১০ বছরে যেভাবে স্থায়িত্ব বজায় রাখতে পেরেছে, যেভাবে তাদের আর্থিক উন্নতি হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। এখন অ্যামেরিকাও চাইবে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো থাকুক। চীনের প্রভাব কম হোক। কিন্তু তারা ভারত সম্পর্কে যে নীতি নেবে, তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নেবে না।''
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিবৃত্ত
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন? এক কথায় তার মূল্যায়ন কঠিন৷ বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশটির সম্পর্ক মধুর যেমন বলা চলে, তেমনি আবার কিছু তিক্ততাও আছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
বিপদের বন্ধু
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকায় ছিল ভারত৷ ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের পূর্ণ সমর্থন দেন৷ পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে বাঙ্গালীদের জন্য খুলে দেয়া হয় দেশটির সীমান্ত৷ নভেম্বরে গঠন হয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড, যার পথ ধরে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা৷
ছবি: Getty Images/AFP/
মৈত্রী চুক্তি
দুই দেশের শান্তি ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী৷ আঞ্চলিক অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার মোট ১২ টি ধারা ছিল এতে৷ ১৯৯৭ সালের ১৯ মার্চ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চুক্তিটি আর নবায়ন হয়নি৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্ধনে সংস্কৃতি
ভারতের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য এক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক৷ এক সময় পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ ছিল একই অঞ্চল৷ দুই বাংলার মানুষের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতেও আছে মিল৷ আছে পারস্পরিক যোগাযোগ৷ দুই দেশের মধ্যে সরকারিভাবে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তিও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যোগাযোগে মৈত্রী
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু আছে বহুদিন থেকে৷ কলকাতা-ঢাকা, শিলং-ঢাকা এবং ঢাকা হয়ে আগরতলা-কলকাতা নিয়মিত বাস যাতায়াত করে৷ ৬টি রেল লাইন ছাড়াও দু’টি ব্রডগেজ রেল সংযোগ আছে দুই দেশের মধ্যে৷ কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে 'মৈত্রী এক্সপ্রেস' চলে সপ্তাহে চারদিন৷ ২০১৭ সালে চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’৷ এছাড়া বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি রেলযোগাযোগ চালুর কাজও চলছে৷
ছবি: DW/P. Mani
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
দুই দেশের বাণিজ্যের আকার ৯১৪ কোটি ডলার৷ ২০১৭-১৮ অথর্বছরে ভারত থেকে ৮৪৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ আর রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য৷ রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশিরভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পেলেও ভারতের বিরুদ্ধে অশুল্ক বা শুল্কবহির্ভূত বাধা তৈরির অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ
২০১৭ সালে বাংলাদেশে ভারতের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫১ কোটি ডলার৷ টেলিযোগাযোগ, ঔষধ, অটোমোবাইলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা আছে৷ এছাড়া ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় ভারতের সঙ্গে ১০ বিলিয়ন ডলারের ১৩টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. U. Ekpei
বিদ্যুৎ আমদানি
বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ৷ ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)-র অংশীদারিত্বে রামপালে নির্মিত হচ্ছে বিতর্কিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র৷ এছাড়াও ২০১৭ সালের এপ্রিলে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও অর্থায়ন সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Malukas
জ্বালানি সহযোগিতা
বাংলাদেশে যেসব দেশের প্রতিষ্ঠান পরিশোধিত তেল সরবরাহ করে তার একটি ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড৷ সেখান থেকে ডিজেল আমদানির জন্য শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে দুই দেশের সরকার৷ ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সে এর উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী৷
ছবি: Reuters/E. Gaillard
সমুদ্র বিরোধের নিষ্পত্তি
বঙ্গোপসাগরে ২৫,৬০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধ ছিল৷ তার মধ্যে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশি আদালতের রায়ে ১৯,৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পেয়েছে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/Str
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে আর সেখানকার বাসিন্দারা পায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও লীন হয়ে যায় দেশটির সাথে৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণঘাতী সীমান্ত
দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷ সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার করবে না দুই দেশ, ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ পর্যায়ে এমন চুক্তি হলেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা৷
ছবি: AP
ফারাক্কা বাঁধ
গঙ্গা নদীতে বাংলাদেশ সীমান্তের ১৮ মাইল উজানে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে ভারত৷ ১৯৬১ সালে শুরু হয়ে কাজ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে৷ শুস্ক মৌসুমে বাঁধের গেট বন্ধ রেখে বাংলাদেশে পানি প্রবাহে বাধা তৈরি করে ভারত৷ অন্যদিকে বর্ষায় খুলে দেয়া হয় সবগুলো গেট, যার ফলে উত্তরাঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা৷
তিস্তা চুক্তি
১৯৮৭ সালের পর থেকে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সাথে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের৷ একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে দেশটি৷ ফলে বাংলাদেশ অববাহিকায় পানিসংকট চলছে৷ ২০১১ সালের ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে এই বিষয়ে চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা হয়নি৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
রোহিঙ্গায় পাশে নেই
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে নেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি৷ শুরু থেকেই এ বিষয়ে মিয়ানমারের অবস্থানকেই বরং সমর্থন জানিয়ে আসছে দিল্লি৷ এমনকি সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের (ইউএনএইচআরসি) অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এক ভোটাভুটিতেও বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে দেশটি৷
ছবি: Getty Images/P. Bronstein
নতুন জটিলতা এনআরসি
সম্প্রতি হালনাগাদ নাগরিকঞ্জি প্রকাশ করে ভারতের আসাম রাজ্য৷ তাতে রাতারাতি নাগরিকত্ব হারিয়েছেন ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ, যাদের বেশিরভাগ মুসলিম৷ বাদ পড়াদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলে আসছে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারা, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nath
ক্রিকেটের উত্তেজনা
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ক্রিকেটের সম্পর্কটাও রাজনীতির মতোই ঐতিহাসিক৷ টাইগাররা ঢাকায় প্রথম টেস্ট খেলেছিল ভারতের বিপক্ষেই, ২০০০ সালে৷ তবে ভারতে টেস্ট খেলার সুযোগের জন্য ১৭ বছর অপেক্ষা করতে হয় বাংলাদেশকে৷ দুই দলের মধ্যে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্ট অবশ্য হয়েছে অনেক৷ সেখানে বেশ কিছু টানটান উত্তেজনার ম্যাচও হয়েছে৷ আগামী নভেম্বরে এই প্রথম দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে ভারত সফরে যাবে বাংলাদেশ দল৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Singh
16 ছবি1 | 16
বাংলাদেশের সমস্যা
যোজনা কমিশনের সাবেক উচ্চপদস্থ আমলা অমিতাভ রায় মনে করেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''ঢাকার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো, আবার তারা অ্যামেরিকাকে চটাতে চায় না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিকেও তারা খুশি রাখতে চায়। সেজন্যই তারা ভারতের কাছ থেকে পরামর্শ চায়।'' অমিতাভের মনে হচ্ছে, ''বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে ভালো সমাধান এবং যেটা তারা চাইতেও পারে, সেটা হলো, ভারতই রাশিয়া থেকে একটু বেশি তেল কিনে বাংলাদেশকে দিক। তাহলে সবদিক রক্ষা করতে পারে বাংলাদেশ। ভারত বড় দেশ ও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বলে, তারা চাপ উপেক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষে তা সম্ভব হবে না।''
প্রণয় মনে করেন, ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ এই বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারে, আইডিয়া নিতে পারে, অ্যামেরিকাকে বোঝাতে পারে, রাশিয়ার তেল তাদেরও প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তব হলো, অ্যামেরিকার যতটা ভারতকে প্রয়োজন, ততটা বাংলাদেশকে প্রয়োজন নয়। তার বক্তব্য, ''এখন বাংলাদেশের দরকার কূটনৈতিক দক্ষতা। তারা অ্যামেরিকাকে কতটা বোঝাতে পারে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।''
ঘটনা হলো, দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রায় কোনো দেশই রাশিয়ার বিরুদ্ধে অ্যামেরিকার নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন জানায়নি। অ্যামেরিকা তাই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি আরো বেশি করে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল হোক সেটা চাইবে না বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানাচ্ছে, এক্ষেত্রে অ্যামেরিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারে ভারত। বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর যে বিপুল চাপ পড়ছে, সে কথাটা জানাতে পারে। তারা সাহায্যকারীর ভূমিকা নিতে পারে। বাকি কাজ বাংলাদেশকেই করতে হবে বলে তারা মনে করছেন।