১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের এই পরমাণু প্রকল্পেই বিধ্বংসী বিস্ফোরণ হয়েছিল। যার প্রভাব থেকে গিয়েছিল বহু বছর। বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তার চেয়েও বেশি। ইউক্রেনের সেই চেরনোবিল পরমাণু কেন্দ্র প্রথম দিনই রাশিয়ার সেনা দখল করে ফেলেছে বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাশিয়া দাবি করেছিল যে তারা চেরনোবিল দখল করেছে। পরে ইউক্রেনের সামরিক কর্তৃপক্ষ সেই দাবি মেনে নেয়।
বৃহস্পতিবার রাতে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, তাদের গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, চেরনোবিলের প্রকল্পে বেশ কিছু কর্মীকে রাশিয়া পণবন্দি করেছে। ইউক্রেন জানিয়েছে, ১৯৮৬ সালের বিস্ফোরণের পর বাকি তিনটি চুল্লিতে কাজ হতো। ২০০০ সালে তা-ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে অল্পসংখ্যক কর্মী সেখানে এখনো কাজ করতেন।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার তিন দশকের বেশি পরে আণবিক চুল্লির আশপাশের এলাকা এখনও বাসের অযোগ্য – যদিও কিছু মানুষ তাদের বাসায় ফিরেছেন৷ ইউক্রেনীয় আলোকচিত্রী আলিনা রুদিয়া তাদের সঙ্গে দেখা করেন৷
ছবি: DW/A. Rudya দাদি গানিয়ার বয়স আজ ৮৬৷ বছর দশেক হল স্বামী মারা গেছেন৷ আজ ২৫ বছর হতে চলল গানিয়া তাঁর মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী ছোটবোন সোনিয়ার দেখাশুনা করেন৷ ‘‘আমার তেজস্ক্রিয়তায় ভয়৷ মাশরুমগুলো অনেকক্ষণ ধরে রাঁধি, যাতে সবটা দূর হয়ে যায়৷’’ আলোকচিত্রী আলিনা রুদিয়া একাধিকবার দাদি গানিয়ার সাথে দেখা করেছেন৷ তাঁর মতে গানিয়ার মতো উষ্ণহৃদয় মানুষ খুব কমই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/A. Rudya গানিয়া ও তাঁর বোন বাস করেন কাপুভাতে গ্রামে, যা চেরনোবিল আণবিক চুল্লির চারপাশে ৩০ কিলোমিটার ব্যাসের নিষিদ্ধকৃত এলাকার মধ্যে পড়ে৷ ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসের দুর্ঘটনার পর সাড়ে তিন লাখ বাসিন্দাকে এলাকাটি ছেড়ে যেতে হয়৷ কাপুভাতে গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি খালি পড়ে থাকে৷ গানিয়া কাছের এই পোড়োবাড়িটিতে তাঁর বোন ও তাঁর নিজের জন্য কফিন জমা করে রেখেছেন৷
ছবি: DW/A. Rudya কাপুভাতে গ্রামের কবরখানা ইউক্রেনের অন্য সব গ্রামের কবরখানার মতোই৷ এলাকার বহু মানুষ দুর্ঘটনার পর গ্রাম ছেড়ে গেলেও, মৃত্যুর পর তাদের অনেককেই এখানে ফিরিয়ে এনে গোর দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/A. Rudya দাদি মারুসিয়ার মতো যারা এখনও বেঁচে, তারা পরিবারের অন্যান্যদের কবরের দেখাশুনা করেন৷ দাদি মারুসিয়া তাঁর মায়ের কবরটি সাজিয়ে-গুছিয়ে, পরিষ্কার করে রাখেন৷ ‘‘এটাই আমার দেশ৷ আমাকে এখানেই গোর দেওয়া হোক, এই আমার ইচ্ছে – কিন্তু আমার মায়ের পাশে, আমার স্বামীর পাশে নয়৷’’
ছবি: DW/A. Rudya নিষিদ্ধকৃত এলাকায় যারা বেআইনিভাবে ফিরেছেন, ইউক্রেনীয় ভাষায় তাদের বলে ‘সামোসেলি’৷ গালিনা ইভানিভনা তাদের একজন৷ ‘‘চোখের পলকে জীবন কেটে গেল৷ আজ আমার বয়স ৮২, অথচ মনে হয়, যেন কখনো বাঁচিনি৷ যখন ছোট ছিলাম, তখন দুনিয়া ঘোরার স্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু কোনোদিন কিয়েভের চাইতে বেশি দূরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি৷’’
ছবি: DW/A. Rudya আশির দশকেই যারা তেজস্ক্রিয়তায় দূষিত এলাকায় ফিরেছেন, তাদের মধ্যে পড়েন ইভান ইভানোভিচ ও তাঁর স্ত্রী৷ আজ যারা এখানে পর্যটক হিসেবে আসেন, তাদের কাছে ইভান এক ধরণের ‘স্টার’৷ নিজের মনে গল্প বলে চলেন ইভান – তার কতোটা সত্যি আর কতটা কল্পনা, তা হয়ত তিনি নিজেই জানেন না৷
ছবি: DW/A. Rudya চেরনোবিল দুর্ঘটনার ৩২তম বার্ষিকীর এক সপ্তাহ আগে আলিনা রুদিয়া ওপাচিচি গ্রামটি পরিদর্শন করেন৷ আজ নাকি এখানে শুধুমাত্র একজন বর্ষীয়সী মহিলা থাকেন, আর যারা গ্রামে ফিরেছিলেন, তাদের সকলেই পরলোকগমন করেছেন৷ চলে যাওয়া মানুষদের বাড়িঘরে পড়ে আছে নানা পুরনো ছবি, চিঠি, আসবাব – কত হারানো জীবনের স্মৃতিচিহ্ন৷
ছবি: DW/A. Rudya মারুসিয়া তাঁর শায়িত স্বামী ইভানকে দেখছেন৷ ইভানের সম্প্রতি একটি স্ট্রোক হয়েছে, মতিভ্রমও দেখা দিয়েছে৷ ইভান নাকি মাঝেমধ্যে রাতে উঠে তাঁর ট্র্যাক্টর খোঁজেন, যা নিয়ে তিনি ৪২ বছর কাজ করেছেন৷ নিজের জন্য মারুসিয়া শুধুমাত্র একটি শান্ত, সুন্দর মরণ কামনা করেন – তিনি সন্তান বা নাতি-নাতনিদের বোঝা হয়ে থাকতে চান না৷
ছবি: DW/A. Rudya নিজের আর নিজের স্ত্রীর কফিন নিজের হাতে গড়ে রেখেছেন ইভান৷ গোলাঘরে পুরনো সাইকেলটার পাশে সে দু’টো রাখা আছে৷ ‘‘নীচেরটা আমার জন্যে আর ওপরেরটা আমার স্বামীর জন্য,’’ বললেন মারুসিয়া৷
ছবি: DW/A. Rudya আজ খুব কম ‘সামোসেলি’ নিষিদ্ধকৃত এলাকায় বাস করেন৷ অধিবাসীদের অধিকাংশের বয়স ৭০ ছাড়িয়েছে৷ আলিনা রুদিয়া প্রতিবার এসে দেখেন, কেউ না কেউ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন – তবে অন্য এক বহুদূরের পথে, চিরকালের যাত্রায়...৷
ছবি: DW/A. Rudya চেরনোবিল এমন একটি জায়গা যেখানে সামান্য কিছু ঘটলেই বড়সড় দুর্ঘটনা হতে পারে। ফের পরমাণু চুল্লিতে বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। প্রকল্পের বাইরে ৩২ কিলোমিটারের একটি অঞ্চল আছে। যা মূল প্রকল্পকে ঘিরে রেখেছে। রাশিয়ার সেনা সেই জায়গাটি ঘিরে রেখেছে বলে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র মিখাইলো পডোলিয়াক জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ অকারণে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধ' ঘোষণা করেছে। চেরনোবিল নিয়েও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
স্ট্র্যাটেজির দিক থেকেও চেরনোবিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এর একদিকে নদী। যা বেলারুশে ঢুকে গেছে। অন্যদিকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। বেলারুশ রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বলে ইউক্রেনের অভিযোগ। বস্তুত, বেলারুশ সীমান্ত থেকেও ইউক্রেনের উপর হামলা চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে চেরনোবিল থেকে রুশ সেনা সরাসরি রাজধানী কিয়েভের দিকে আক্রমণ চালাতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এসজি/জিএইচ (রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি, এপি)