মস্কো সফর শেষে ইইউ-র শীর্ষ পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তা সে দেশের উপর আরো নিষেধাজ্ঞার মতো কড়া পদক্ষেপের পরামর্শ দিলেন৷ অ্যামেরিকা ও ইউরোপে এমন মনোভাব বেড়েই চলেছে৷
বিজ্ঞাপন
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিগত বছরগুলিতে বার বার বিড়ম্বনায় পড়ছে৷ এক দিকে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের বেশ কিছু আচরণ বরদাস্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে, অন্য দিকে পূর্ব প্রান্তে এমন বিশাল ও শক্তিশালী প্রতিবেশীকে উপেক্ষা করাও কঠিন৷ কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থও এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হচ্ছে৷ কিন্তু সম্প্রতি রাশিয়ার সরকার বিরোধী নেতা আলেক্সেই নাভালনির বিষক্রিয়া ও গ্রেফতারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে৷ রাশিয়ার উপর আরো শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর জন্য চাপ বাড়ছে৷ অন্যদিকে সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা কমানোর পথও পুরোপুরি বন্ধ করতে চাইছেন না কিছু ইইউ নেতা৷
এমনই প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষ কর্মকর্তা জোসেপ বরেল মস্কো সফর করে রাশিয়ার নেতৃত্বের সঙ্গে সংলাপের চেষ্টা চালিয়েছেন৷ মূলত জার্মানি ও ফ্রান্সের উদ্যোগে তিনি বিতর্কিত এই কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ কিন্তু রবিবার বরেল বলেন, রাশিয়া ইইউ-র সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ চালাতে প্রস্তুত নয়৷ এক ব্লগ পোস্টে তিনি নিজের মূল্যায়ন তুলে ধরেন৷ তাই ইউরোপকে নতুন নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপের কথা ভাবতে হবে৷ তাঁর দুই দিনের মস্কো সফরের সময় সে দেশ থেকে যেভাবে তিন জন পোল্যান্ড, জার্মানি ও সুইডেনের একজন করে কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছে, তার ফলেই সেই মনোভাব স্পষ্ট হয়ে গেছে বলে বরেল মনে করেন৷ তাঁর মতে, রাশিয়া ইউরোপ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হবার পথ বেছে নিয়েছে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে৷
বরেল আগামী ২২শে ফেব্রুয়ারি ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন৷ তারপর মার্চ মাসে ইইউ শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে কড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে৷ বরেলের এমন মূল্যায়ন নরমপন্থিদের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশই রাশিয়ার প্রতি আরও কড়া মনোভাবের পক্ষে সওয়াল করছে৷ সম্প্রতি রাশিয়ায় সরকার বিরোধী বিক্ষোভে দশ হাজারের বেশি মানুষকে আটক হবার পর মস্কোর বিরুদ্ধে আরো নিষেধাজ্ঞার জন্য চাপ বাড়ছে৷ ইইউ পার্লামেন্টও এমন ডাক দিচ্ছে৷
রাশিয়া ও ইইউ-র মধ্যে বেড়ে চলা উত্তেজনার জের ধরে সমুদ্রের নীচে রাশিয়া থেকে জার্মানি পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক আরও দানা বাঁধছে৷ মার্কিন প্রশাসন এমনকি ‘নর্ড স্ট্রিম ২' প্রকল্পের উপর নিষেধাজ্ঞার হুমকিও দিয়েছে৷ সেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করার জন্য ঘরে-বাইরে চাপ বাড়ছে৷ অথচ শনিবারই আবার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে৷
শুক্রবার জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এই প্রকল্পের প্রতি আবার তার সমর্থন জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেন, তাঁর সরকার নাভালনিকে কেন্দ্র করে মস্কোর সঙ্গে উত্তেজনার সঙ্গে এই বিষয়টিকে জড়াতে চায় না৷ জার্মানির সবুজ দল খোলাখুলি এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে৷ অর্থাৎ চলতি বছরের সাধারণ নির্বাচনের পর এই দল আগামী জোট সরকারের শরিক হলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে৷
নাভালনির ঘটনায় পুটিনের যা হতে পারে
আলেক্সেই নাভালনিকে বিষ খাইয়ে মারার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ক্রেমলিন৷ নাভালনির নামই উচ্চারণ করেন না পুটিন৷ এমন অস্বীকার ও তাচ্ছিল্যের কৌশলের পরিণাম কী হতে পারে? ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Instagram @Navalny/Reuters
রাশিয়ার রাজনীতিবিদ জার্মানিতে
রাশিয়ার বিরোধী রাজনীতিবিদ, আইনজীবী এবং দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের কর্মী আলেক্সেই নাভালনি গত ২০ আগস্ট টোমাস্ক থেকে মস্কো যাওয়ার পথে বিমানে অজ্ঞান হয়ে যান৷ ১৮ দিন হাসপাতালে কোমায় ছিলেন৷ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে গোপনে জার্মানিতে নিয়ে আসা হয় তাকে৷ বার্লিনে দীর্ঘ চিকিৎসার পর নাভালনি এখন সুস্থ৷
ছবি: Vasily Maximov/APF/Getty Images
রাশিয়ার ‘অস্বীকার’ ও ‘আদেশ’
রাশিয়ার বিরোধী দল এবং পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে, রুশ গোয়েন্দা সংস্থা নাভালনিকে বিষ খাইয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু রাশিয়ার পক্ষ থেকে এ অভিযোগ শুরু থেকেই অস্বীকার করা হচ্ছে৷ সম্প্রতি রাশিয়ার কারা কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালের এক মামলায় দোষী সাব্যস্ত নাভালনিকে অবিলম্বে সশরীরে হাজির হতে বলে, তা না হলে পরে দেশে ফেরামাত্র জেলে পোরা হবে তাকে৷
ছবি: Shamil Zhumatov/REUTERS
কৌশলী পুটিন
গত চার মাসে নাভালনির ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে৷ কিন্তু ভ্লাদিমির পুটিন একটিবারের জন্য নাভালনির নাম উচ্চারণই করেননি৷ জার্মানিতে নিয়ে আসার পর থেকে নাভালনিকে পুটিন বর্ণনা করছেন স্রেফ ‘বার্লিনের হাসপাতালের একজন রোগী’ হিসেবে৷
রাশিয়া দায় অস্বীকার করলেও, পুটিন ‘বার্লিনের হাসপাতালের রোগী’ বলে তাচ্ছিল্য করলেও ঘটনার বিস্তার থেমে থাকেনি৷ নাভালনির বিষয়ে মানুষের কৌতুহলও কমেনি৷ অজ্ঞান হয়ে পড়ার বিষয়টি নিয়ে দুটি ভিডিও অনুসন্ধানী নেটওয়ার্ক বেলিংক্যাট এবং দ্য ইনসাইডারে ছেড়েছিলেন নাভালনি৷ একটি ভিডিও এক সপ্তাহে দেখা হয়েছে দু কোটি বার, অন্যটি মাত্র দু দিনেই এক কোটি ৭০ লাখ বার! ওপরের ছবিতে বার্লিনে স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে নাভালনি৷
ছবি: Instagram @Navalny/Reuters
রুশ নিরাপত্তা সংস্থার চরম ব্যর্থতা
ব্রিটেনের ইতিহাসবিদ এবং গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মার্ক গালেওট্টি মনে করেন ‘নাভালনিকাণ্ড’ রাশিয়ার কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থা এফএসবিকে সের্গেই ক্রিপাল ও তার মেয়েকে বিষ খাওয়ানোর ঘটনার চেয়েও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, কারণ, ‘‘এফএসবি নাভালনিকে শুধু হত্যা করতে ব্যর্থই হয়নি, বড় একটা প্রমাণও রেখে দিয়েছে তারা, কেননা নাভালনিকে জার্মানিতে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে৷’’
ছবি: Imago/ZUMA Press
পুটিনের কী হবে?
মার্ক গালেওট্টির ধারণা এত বড় ঘটনাকেও হয়ত কৌশলে সামাল দিয়ে ফেলবেন ভ্লাদিমির পুটিন৷ ক্রেমলিন এখনো মনে করে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা যথেষ্ট দক্ষ৷ ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগে যখন রুশ গোয়েন্দা সংস্থার নাম আসে, তখনও ধারণা করা হয়েছিল পুটিন হয়ত কোণঠাসা হবেন, বিব্রত হবেন৷ অথচ পরে সেই ঘটনার জন্য পুটিনকে ‘কিংমেকার’ ভেবেছেন অনেকে৷
ছবি: Alexei Nikolsky/AP Photo/picture alliance
‘রাশিয়া হতে চায় কঠোর খারাপ ছেলে’
রাশিয়ার সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে গালেওট্টির মনে হচ্ছে, রাশিয়ায় যারা ক্ষমতাসীন, তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ‘‘ওকে, আমরা যেহেতু ভালো ছেলে হতে পারবো না, চল তাহলে সবচেয়ে কঠোর খারাপ ছেলে হয়ে যাই৷’’ ব্রিটিশ ইতিহাসবিদের মতে, ‘‘ক্রেমলিনের নিয়ন্ত্রণ এখন এমন নিষ্ঠুর রাজনীতিবিদদের হাতে, যারা কিছুতেই থামবে না৷’’