ইউক্রেনে হামলার কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইইউ৷ নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা রাশিয়া তাই চরম অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কায়৷ এর প্রভাবে সিরিয়ায় কি তীব্র মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে?
বিজ্ঞাপন
ইইউর আয়োজনে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দাতাদের ষষ্ঠ সম্মেলন হয়ে গেল৷ সেখানে ইইউর বিদেশ নীতি বিভাগের প্রধান ইয়োসেপ বোরেল সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন৷ যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার নব্বই ভাগ মানুষই এখন দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে৷ বোরেলের আশঙ্কা, ইউক্রেনের দিকে সবার মনযোগ চলে যাওয়ায় সিরিয়ার সংকটের বিষয়টি আড়ালে চলে যেতে পারে এবং সেরকম হলে তার ফলাফল সিরিয়ার জন্য খুব ভয়াবহ হবে৷
তিনি বলেন, ‘‘রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্য এবং জ্বালানির দাম আরো বাড়বে৷ ফলে সিরিয়ার পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে৷''
রাশিয়াকে দূরে রেখে সিরিয়া-সংকট মোকাবেলা সম্ভব?
সিরিয়ার দাতাদের ষষ্ঠ সম্মেলনে ৫৫টি দেশ এবং জাতিসংঘ, ইইউসহ মোট ২২টি আন্তর্জাতিক সংস্থা অংশ নেয়৷ কিন্তু রাশিয়াকে এবার আমন্ত্রণই জানানো হয়নি৷ সিরিয়ার ‘মিত্র দেশ' রাশিয়ার অনুপস্থিতিতেই সিরিয়া এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য অর্থ সহায়তা গত বছরের ৬.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৬.৭ বিলিয়ন ডলার করা হয়৷
মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বোরেল আরো বলেন, এবারের সম্মেলন থেকে রাশিয়া এবং সিরিয়াকে একটি বার্তাই দেয়া হলো আর তা হলো- সিরিয়ায় যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত দেশ দুটোর বিরুদ্ধের নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে না, পারস্পরিক সম্পর্কেরও উন্নতি হবে না৷
কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে সিরিয়া, বিশেষ করে সিরিয়ার পূর্ব-পশ্চিমাঞ্চলে মানবিক সহায়তা পাঠানো কার্যত অসম্ভব৷ ২০১৪ সালে চারটি চ্যানেল দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়ায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ৷ কিন্তু রাশিয়া এবং চীন ভেটো দেয়ায় চারটির মধ্যে তিনটি চ্যানেলই পরে আর কাজে লাগানো যায়নি৷
ইডলিব সংলগ্ন বাব-আল-হাওয়া ছিল সহায়তা পৌঁছানোর একমাত্র পথ৷ রাশিয়া ‘নরম' হওয়ায় গত বছর এই চ্যানেল উন্মুক্ত করা গেলেও জুলাইয়ে পুটিনের দেশ বেঁকে বসলে সেই পথও বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷ সেক্ষেত্রে ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষের জীবন৷
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিষেধাজ্ঞার ভয়াবহ চাপে থাকা রাশিয়া কি সিরিয়ার মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোয় বাধা হয়ে দাঁড়াবে৷ ইইউর পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান বোরেল তা মনে করেন না, তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয় রাশিয়া তা করবে না৷ তাদের তা করা উচিত নয়৷''
যুদ্ধে ঘর হারানো মানুষদের প্রাচীন জীর্ণ স্থাপনায় বসবাস
মোহাম্মদ ওথমান ছোটবেলায় বেড়াতে যেতেন প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোতে৷ ভাবেননি সেরকম কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেই একদিন আশ্রয় নিতে হবে তাকে৷ সিরিয়ার যুদ্ধ এমন অবস্থায় ফেলেছে অনেক পরিবারকে৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
ওথমানের নতুন জীবন
আড়াই বছর ধরে এমন একটি জায়গায় বাস করছেন ওথমান৷ মারাথ আল-নুমানের কাছের এক গ্রামে সুন্দর, ছিমছাম বাড়ি ছিল তাদের৷ কিন্তু বাশার আল আসাদের বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের প্রচণ্ড যুদ্ধের কারণে বাড়ি-ঘর ছেড়ে এখানে চলে আসতে হয় তাকে৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
সন্তানরা আর স্কুলে যায় না
এক সময় এমন জায়গাগুলোতে স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে বেড়াতে আসতেন ওথমান৷ এখন নিজের বাড়ি নেই, বাড়ির ভাড়া দেয়ার টাকাও নেই বলে বাধ্য হয়ে বসবাস করেন এমন জায়গায়৷ চার সন্তান তার৷ টাকার অভাবে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
সাপ, বিচ্ছুর সঙ্গে বসবাস
তুরস্ক সীমান্তের কাছের সারজাবলেহ অঞ্চলে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই প্রাচীন অট্টালিকায় বসবাসের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ৩০ বছর বয়সি ওথমান বলেন, ‘‘এখানে গ্রীষ্মে বিচ্ছু, সাপ আর ধূলার সঙ্গে লড়তে হয় আমাদের৷ সঙ্গে জীবনের যাবতীয় চাপের ব্যাপারগুলো তো থাকেই৷ শীতে প্রচণ্ড শীত পড়ে এখানে৷ স্বাস্থ্যসেবার নাম-গন্ধ নেই৷ এখানে জীবন বড় কঠিন৷’’
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
ভূস্বামী থেকে জলপাই-কুড়ানি
মারাত আল-নুমানের কাছের গ্রামে বাড়ি ছিল, চাষের জমি ছিল৷ প্রাণ বাঁচাতে সব ফেলে চলে এসেছেন পঞ্চম শতকের এই স্থাপনার আশ্রয়ে৷ সংসার চালাতে নানা ধরনের মৌসুমী কাজ করেন ওথমান৷ কখনো জলপাই কুড়ান, কখনো যে কাজে ডাক আসে তা-ই করেন৷ কোনো কাজ না পেলে ধারের টাকায় চালাতে হয় সংসার৷ ওপরের ছবিতে এক নারীর জলপাই তোলার দৃশ্য৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
খাররাপ ক্যাম্প
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা সিরিয়া যুদ্ধে ঘর-ছাড়া হয়েছেন কমপক্ষে ২৮ লাখ মানুষ৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখ নিজের দেশেই ঘর-ছাড়া৷ তাদের একটা অংশের আশ্রয়স্থল এই ধরনের প্রাচীন ভবন৷ স্থানীয়রা এমন ভবন বা ভবনকে ঘিরে গড়ে ওঠা আশ্রয় কেন্দ্রের নাম দিয়েছেন ‘খাররাপ ক্যাম্প’, অর্থাৎ ধ্বংসাবশেষের শিবির৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
পশুপালক মাহমুদ আবু খলিফা
সারজাবলেহর কাছেই ইডলিব৷ সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এই প্রদেশেও কিছু প্রাচীন ভবন রয়েছে৷ একটির নাম বাবিস্কা৷ সেখানে বাস করে ৮০টির মতো পরিবার৷ স্ত্রী আর সাত সন্তান নিয়ে মাহমুদ আবু খলিফাও থাকেন সেখানে৷ ঘর-বাড়ি ছেড়ে এলেও ভেড়াগুলো সঙ্গে নিয়ে এসেছেন৷ ৩৫ বছর বয়সি তরুণের পরিবারের জীবিকা এখন ভেড়াগুলোর ওপরই নির্ভরশীল৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
বাড়ি ফেরা হবে?
নিজেদের বাড়িতে কখনো ফিরতে পারবেন কিনা ওথমান, মাহমুদরা তা জানেন না৷ তবে সেই দিনের অপেক্ষাতেই দিন গোণেন তারা৷ আশায় বুক বাঁধেন বারবার- একদিন শান্তি ফিরবে, সেদিন তাদেরও আবার বাড়ি-ঘর থাকবে!