কেউ পালিয়ে গেছেন কাজাখস্তান, কেউ বা জার্মানি। ইউক্রেন যুদ্ধ এতদিন চলবে, তারা কেউ ভাবেননি।
বিজ্ঞাপন
বাভারিয়ার মিউনিখ শহরে চলছে অক্টোবর ফেস্ট। সেখান থেকে সামান্য দূরে শহরতলিতে বসবাস করেন ভ্যাসিলি। এটা তার নিজের নাম নয়। নাম প্রকাশ করলে রাশিয়ায় তার পরিবারের উপর আক্রমণ হতে পারে, তা-ই পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছেন তিনি।
রাশিয়া থেকে পালিয়ে জার্মানিতে এসে বসবাস করছেন এই রাশিয়ার সেনা অফিসার। দীর্ঘদিন রাশিয়ার সেনা বাহিনীতে কাজ করেছেন তিনি। মাসখানেক আগে জার্মানিতে পালিয়ে এসেছেন।
রাশিয়ার সেনায় বন্দুক চালানোর পল্টনে কাজ করতেন তিনি। বহুদিন ধরেই সেনাবাহিনীর কাঠামো এবং অবস্থা নিয়ে বিরক্ত ছিলেন তিনি। কাজ ছেড়ে অন্য কিছু করার কথা ভাবছিলেন। তারই মধ্যে শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। ডিডাব্লিউকে ভ্যাসিলি জানিয়েছsন, ''আমার বাবা ইউক্রেনের। তাই ইউক্রেনের মানুষ আমার নিজের লোক। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।''
ইউক্রেনে আতঙ্কের নগরীতে সুরের মূর্ছনা
যুদ্ধ চলছে একদিকে, অন্যদিকে রাতের আঁধারে মোমবাতি জ্বালিয়েও ধ্রুপদী সংগীতের সুরে বাঁচার আনন্দ নিচ্ছেন অসংখ্য মানুষ৷ লভিভে প্রায় প্রতিদিনের এমন এক আয়োজনের কথা জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Alina Smutko/REUTERS
আকাশে যুদ্ধবিমান, নীচে কনসার্ট
ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর লভিভের আকাশে যখন যুদ্ধবিমান আতঙ্ক ছড়ায়, তখনো অর্গান হলে থাকে সুরপাগল মানুষদের ভিড়৷ মগ্ন হয়ে লুহানস্ক ফিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রার পারফর্ম্যান্স উপভোগ করেন তারা৷ অনেক সময় মোমের আলোয় চলে কনসার্ট৷ শ্রোতারা মোমের আলোয় এতটাই অভ্যস্ত যে মাঝে মাঝে যুদ্ধবিমান ফিরে গেলে, কিংবা বিদ্যুৎ ফিরে এলেও আলো জ্বালাতে চান না তারা৷
ছবি: Alina Smutko/REUTERS
কম আয়, অনেক বেশি আনন্দ
যুদ্ধপরিস্থিতিতে কনসার্ট আয়োজনে প্রতিকূলতা অনেক৷ মৃত্যুঝুঁকি তো থাকেই, কনসার্ট আয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত টাকাও জোটে না৷ অথচ ঝুঁকি নিয়ে সংগীত উপভোগ করতে আসা অনেকেই চান দীর্ঘক্ষণ চলুক কনসার্ট, আবার কবে আসা হবে, আদৌ সে সুযোগ আর হবে কিনা তার তো ঠিক নেই!
ছবি: Alina Smutko/REUTERS
আনন্দটাই বড় বিষয়
লুহানস্ক ফিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রার কো-ডিরেক্টর টারাস ডেমকো মনে করেন যুদ্ধের সময় মানুষকে সামান্য আনন্দে রাখাও অনেক বড় ব্যাপার৷ রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘‘রাশিয়া একটানা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে৷ এ অবস্থায় মানুষকে তো আমাদের সহায়তা করতে হবে৷ প্রতিদিন কয়েক মিনিটের জন্যও যদি তাদের মনে একটু শান্তি দেয়া যায় তা-ও তো অনেক!’’
ছবি: Alina Smutko/REUTERS
যুদ্ধের পর যুদ্ধ
১৯১৫ সাল পর্যন্ত লুহানস্কে পারফর্ম করেছে লুহানস্ক ফিলহার্মোনিক৷ রুশ-সমর্থিত ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা’ লুহানস্ক দখল করে নেয়ার পর ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট শহর সিভিয়েদনেৎস্কে চলে যায় তারা৷ গত বছর রুশ হামলায় সিভিয়েরদনেৎস্কও বিদ্ধস্ত হয়৷ তখন বাধ্য হয়েই লভিভে চলে আসে লুহান্স্ক ফিলহার্মোনিক৷
ছবি: Alina Smutko/REUTERS
‘সংগীত আত্মবিশ্বাস জোগায়’
লভিভে কনসার্ট করতে পেরে লুহানস্ক ফিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রার পরিচালক ইগর শাপোভালভ খুব খুশি৷তিনি মনে করেন কনসার্ট আয়োজন করে যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত অনেক মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারছেন, কারণ, ‘‘প্রাচীন কাল থেকে সংগীত মানুষকে নানাভাবে শক্তি জুগিয়ে আসছে৷ সংগীত অনেক মানুষকে আত্মবিশ্বাস জোগায়, অনেকের কাছে আবার সংগীত মানসিক দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার উপায়৷’’
ছবি: Alina Smutko/REUTERS
হামলা হলে কনসার্ট বন্ধ
লভিভে রাশিয়ার বড় ধরনের হামলা খুব কম হয়েছে৷ তাই এখন কনসার্ট হচ্ছে প্রায় নিয়মিত৷ জুলাই মাসে রাশিয়ার এক হামলায় ১০ জন মারা যায়৷ ওই সময় বাধ্য হয়ে কনসার্ট বন্ধ রেখেছিল লুহানস্ক ফিলহার্মোনিক৷
ছবি: Alina Smutko/REUTERS
6 ছবি1 | 6
কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন এই অনুরোধ শোনেননি। তিনি ডিক্রি ঘোষণা করেন যে, যুদ্ধে না গেলে সেনা জওয়ান এবং অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এই সময় কম্যান্ডারের কাছ থেকে ফোন পান ওই অফিসার। যুদ্ধে যোগ না দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর কোনো উপায় না দেখে দেশ ছেড়ে পালান ভ্যাসিলি।
কাজাখস্তান এবং আর্মেনিয়া
জার্মানিতে এমন বেশ কিছু রাশিয়ার সেনা এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে অধিকাংশই যাচ্ছেন কাজাখস্তান এবং আর্মেনিয়ায়। বেশ কিছু এনজিও তাদের পালানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে পৌঁছাতে হচ্ছে কাজাখস্তানে।
ভিক্টরও সেভাবেই কাজাখস্তানে আশ্রয় নিয়েছেন। ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, অন্তত ৫০০ রাশিয়ার সেনা আপাতত কাজাখস্তান এবং আর্মেনিয়াতে আছেন। ভিক্টরও এই সেনার নিজের নাম নয়। আপাতত কাজাখ রাজধানী আস্তানায় আছেন তিনি। রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে কমিউনিকেশন অফিসার ছিলেন তিনি। ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ক্রাইমিয়ায় পাঠানো হয়েছিল তাকে।
ইউক্রেন: যুদ্ধের মাঝে বিদ্যালয়ে ফেরা
ইউক্রেনে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে৷ তবে সব শিক্ষার্থীর পক্ষে সাধারণ বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না৷ নিরাপত্তার কারণে কোথাও কোথাও বিদ্যালয় সরিয়ে নেয়া হয়েছে বাঙ্কার ও সাবওয়ে স্টেশনে৷
ইউক্রেনে গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হয়েছে এবং শিশুরা বিদ্যালয়ে ফিরেছে৷ দেশটির কিছু অঞ্চলে যুদ্ধের কারণে সাধারণত অনলাইনে বা হাইব্রিড সেশনে ক্লাস নেয়া হচ্ছে৷ খারকিভ শহরে মাটির নিচের সাবওয়ে স্টেশনে বিদ্যালয় সরিয়ে নেয়া হয়েছে৷ শিশুরা সেখানে সুরক্ষিত পরিবেশে ক্লাস করতে পারছে৷
ইউক্রেনে চলতি বছর ৩৭ লাখের মতো শিশু ও কিশোর বিদ্যালয়ে যাচ্ছে৷ দেশটির প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি সব শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাবর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন৷
শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে স্বাগত জানাচ্ছেন এক শিক্ষক৷ যুদ্ধের গুমোট পরিবেশের মধ্যে শ্রেণিকক্ষগুলোকে উজ্জ্বল ও উৎসবমুখর রাখতে কঠোর পরিশ্রম করছেন শিক্ষকেরা৷ তারা তাদের শিক্ষার্থীদের যতটা সম্ভব রঙিন সময় উপহার দিতে চান৷
খারকিভের মেয়র ইহর তারাখাভ তার শহরের মাটির নিচে ট্রেন স্টেশনে সরিয়ে নেয়া একটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করছেন৷ এরকম ৬০টি শ্রেণিকক্ষ তৈরি করা হয়েছে যেখানে এক হাজারের মতো শিক্ষার্থী ক্লাস করছেন৷
ক্লাসরুমে একসঙ্গে পড়াশোনা এবং সরাসরি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের অধিকাংশ বড় শহরে বেশিরভাগ সময় অনলাইনে ক্লাস নেয়া হচ্ছে৷ খারকিভের এই বিদ্যালয়ের মতো কিছু স্কুলে সরাসরি ক্লাস করার সুযোগ মেলে৷
ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভের এক স্কুলশিক্ষার্থীর মা জানান যে ট্রেন স্টেশনে চালু করা বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের ও কথোপকথনের সুযোগ পাচ্ছে৷ তিনি এটা পুরোপুরি সমর্থন করেন বলেও জানান৷
যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা এখনো মনে পড়ে তার। সকাল ৫টায় ঘুম থেকে তুলে তাদের বলা হয়েছিল, অনেকটা পথ যেতে হবে। তারা ইউক্রেনে প্রবেশ করেন। ডিডাব্লিউকে ভিক্টর বলেছেন, ''চোখের সামনে যুদ্ধবন্দিদের হত্যা করতে দেখেছি। আমাদের কম্যান্ডার সে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে বেসামরিক মানুষদের উপর আক্রমণ আমরা চালাইনি। অনেক পরে ইন্টারনেটে সে সব ঘটনা পড়েছি।'' এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ভিক্টর। তারপর পালিয়ে এসেছেন। ওই ভয়াবহতা আর মেনে নিতে পারেননি।
'পুটিন হত্যাকারী জানতাম, পাগল জানতাম না'
ইয়েভজেনিই-ও বাকিদের মতো পালিয়েছেন। স্পেশাল ইউনিটে কাজ করতেন তিনি। গরিব ঘরের ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন সামাজিক সম্মানের আশায়। ইউক্রেন যুদ্ধে তিনিও যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, ''কিয়েভের দিকে যাওয়ার সময় সঙ্গে কোনো যুদ্ধবন্দিকে রাখা হচ্ছিল না। কারণ তাদের রাশিয়া ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। রাস্তাতেই তাদের খতম করা হচ্ছিল।'' তিনি নিজে অবশ্য এমন কোনো হত্যার সঙ্গে যুক্ত নন বলে জানিয়েছেন এই সেনা।
দনবাসেও ছিলেন তিনি। জানিয়েছেন, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর জন্য নিজেরাই নিজেদের পায়ে গুলি করতেন তারা। তার ক্ষেত্রেও এমনই ঘটনা ঘটেছে। বহু চেষ্টার পর পালাতে পেরেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ''ভেবেছিলাম সাময়িক অভিযান চালাবেন যুদ্ধবাজ পুটিন। তিনি যে পুরোপুরি যুদ্ধে নেমে পড়বেন, আমরা ভাবিনি। পুটিন যে পাগল, তা আমরা বুঝিনি।''
এদের মতো আরো বহু রাশিয়ান সেনা পাশের দেশগুলিতে পালিয়ে গেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতা তারা ভাগ করে নিয়েছেন ডিডাব্লিউ-র সঙ্গে।