কৌশলগতভাবে রাশিয়ায় ড্রোন আক্রমণ বাড়াচ্ছে ইউক্রেন। দেশের আকাশসীমা নিয়ে চিন্তিত রাশিয়া।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি রাশিয়ায় একের পর এক ড্রোন আক্রমণ চালিয়েছে ইউক্রেন। শুধু সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নয়, খোদ রাজধানী মস্কোয়। ইউক্রেন সীমান্ত থেকে যার দূরত্ব অনেক। বস্তুত, ক্রেমলিনের সেনেটের ডোমেও ইউক্রেনের ড্রোন আঘাত করেছে। তাতে বড়সড় বিপর্যয় ঘটেনি। কিন্তু ক্রেমলিনের সেনেটে বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোন পৌঁছে যাওয়া রাশিয়ার জন্য যথেষ্ট চিন্তার।
ইউক্রেনের ড্রোন হামলার জন্য বার বার নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করতে হচ্ছে রাশিয়াকে। গত সোমবারও কিছুক্ষণের জন্য বিমানবন্দর বন্ধ করতে হয়। আকাশসীমা বন্ধ করার জন্যই বিমানবন্দরের কাজ আটকে গেছিল বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা।
এবার মস্কোর আবাসিক এলাকাতেও ড্রোন হামলা
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো মস্কোর আবাসিক এলাকায় ড্রোন হামলা হয়েছে৷ ইউক্রেন এই হামলা চালায়নি বলে দাবি করেছে৷ পুটিন বলছেন, এই হামলার মাধ্যমে রাশিয়াকে ভয় দেখানো ও উসকানোর চেষ্টা করা হয়েছে৷
ছবি: Maxim Shemetov/REUTERS
প্রথমবার হামলা
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো মস্কোর আবাসিক এলাকায় ড্রোন হামলা হয়েছে৷ তবে এতে কেউ মারাত্মকভাবে আহত হননি বলে রুশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন৷ তবে কয়েকটি আবাসিক ভবনে ‘সামান্য’ ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তারা৷ এর আগে চলতি মাসে ক্রেমলিনের উপর দুটো ড্রোন রুখে দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: Kirill Kudryavtsev/AFP/Getty Images
৮টি ড্রোন
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, মস্কোতে আটটি ড্রোন দিয়ে হামলা করা হয়৷ এর মধ্যে কিছু ভূপতিত ও কিছু ড্রোনের দিক পরিবর্তন করে দেয়া হয়৷ অভিজাত এলাকা দক্ষিণ-পশ্চিম মস্কোর দুটি উঁচু আবাসিক ভবনে দুটি ড্রোন ভেঙে পড়ে৷ আরেকটি, অন্য এলাকার এক ভবনে কিছুটা ক্ষতি করেছে৷ বাকিগুলো মস্কোর বাইরে পড়েছে৷ অবশ্য রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত টেলিগ্রাম চ্যানেল ‘বাজা’য় ২৫টির বেশি ড্রোনের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: Lev Sergeev/REUTERS
অকল্পনীয়
মস্কোর স্থানীয় কিছু ব্যক্তি বলছেন, তারা কখনও ভাবেননি যে রাশিয়ার রাজধানীতে এমন হামলা হতে পারে৷ মস্কোর দক্ষিণ-পশ্চিমের পেনশনভোগী তাতিয়ানা কালিনিনা এএফপিকে বলেন, ‘‘আমি ভেবেছিলাম এসব অনেক দূরে ঘটে৷ এগুলো আমাদের পর্যন্ত আসবে না৷ কিন্তু এখন হঠাৎ করেই এগুলো এত কাছে চলে এসেছে৷’’ ছবিতে মস্কোতে হামলা করা একটি ড্রোনের অংশ দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Alexander Shcherbak/Tass/picture alliance
ইউক্রেনের অস্বীকার
ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ট কর্মকর্তা মিখাইলো পোডোলিয়াক মস্কোয় ড্রোন হামলার সঙ্গে কিয়েভের সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন৷ তবে ‘এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করে তারা আনন্দিত’ এবং ভবিষ্যতে এমন হামলা আরও হতে পারে বলে জানিয়েছেন৷ ছবিতে ড্রোন হামলার পর মস্কোর এক অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের বাইরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Evgenia Novozhenina/REUTERS
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন মঙ্গলবার বলেন, মস্কোতে ড্রোন হামলার মাধ্যমে রাশিয়াকে ভয় দেখানো ও উসকানোর চেষ্টা করা হয়েছে৷ মস্কোর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করেন তিনি৷ এদিকে, ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকোভ বুধবার বলেন, মস্কোতে ড্রোন হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ‘নিন্দা না জানানোর’ বিষয়টি রাশিয়া খেয়াল করেছে৷
ছবি: Gavriil Grigorovvia/Kremlin/Sputnik via REUTERS
হোয়াইট হাউসের প্রতিক্রিয়া
মস্কোতে ড্রোন হামলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে জানিয়ে হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব কারিন জ্য-পিয়ের বলেন, ‘‘আমরা রাশিয়ার ভেতরে হামলা সমর্থন করি না৷ দ্যাটস ইট৷ পিরিয়ড৷’’ ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দেয়া দেশগুলোর অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র৷ তবে তাদের শর্ত হচ্ছে, এগুলো শুধু নিজেদের প্রতিরক্ষার কাজে এবং রাশিয়ার দখল করা এলাকা মুক্ত করতে ব্যবহার করা যাবে৷
ছবি: Mandel Ngan/AFP
কিয়েভে টানা তৃতীয় দিন হামলা
মঙ্গলবার কিয়েভে রাশিয়া টানা তৃতীয় দিনের মতো ড্রোন ও মিসাইল হামলা চালিয়েছে৷ ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার নিক্ষেপ করা ৩১টির মধ্যে ২৯টি ড্রোন ভূপতিত করা হয়েছে৷ ছবিতে মঙ্গলবার কিয়েভে রাশিয়ার ড্রোন হামলার পর একটি ভবনে আগুন দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Kyiv City Military Administration/Handout/REUTERS
রাশিয়ার তেল শোধনাগারে ড্রোন হামলা
রাশিয়ার কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষ্ণসাগরের পাশে অবস্থিত তেল রপ্তানি করতে ব্যবহৃত দেশটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল নভোরোসিস্ক বন্দর থেকে ৬৫-৮০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত দুটি তেল শোধনাগারে বুধবার ড্রোন হামলা হয়েছে৷ হামলার কারণে একটিতে আগুন ধরেছে, অন্যটিতে কোনো ক্ষতি হয়নি৷ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা রিয়া এই তথ্য জানিয়েছে৷ মস্কোয় ড্রোন হামলার পরদিন এই হামলা হলো৷ উপরের ছবিটি ফাইল থেকে নেয়া৷
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, গত সপ্তাহে মস্কোর কমার্শিয়াল ডিস্ট্রিক্ট, যেখানে একাধিক হাইরাইস আছে, সেখানে অন্তত চারবার ড্রোন হামলা চালিয়েছে কিয়েভ। এই কমার্শিয়াল ডিস্ট্রিক্টে মস্কোর দুইটি মন্ত্রণালয় আছে। গত এক সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন মস্কোয় ইউক্রেনের ড্রোন দেখা গেছে বলে বিশেষজ্ঞদের দাবি। ক্রেমলিন সরাসরি এবিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে ইউক্রেনের ড্রোন নিয়ে যে তারা উদ্বেগে আছে, তা স্পষ্ট। যে কারণে বার বার সাময়িক সময়ের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করতে হচ্ছে।
ড্রোন হামলার সুবিধা
ড্রোন হামলা চালিয়ে ইউক্রেন বড় বিস্ফোরণ ঘটাতে পারছে না। তবু এই হামলাকে কার্যকরী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। এর সাহায্যে রাশিয়াকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা সম্ভব হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বিশেষজ্ঞ ইগাল লেভিন ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''তুর্কমেনিস্তান ইতিমধ্যেই রাশিয়ার আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। নিয়মিত ড্রোন হামলা চললে, অন্য দেশও এই রাস্তাই নেবে। যা রাশিয়াকে বিড়ম্বনায় ফেলবে।'' ইগালের মতে, এই আক্রমণের সাহায্যে রাশিয়ার স্বাভাবিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম এবং পণ্য পরিবহণকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখা সম্ভব। ইতিমধ্যেই কিয়েভ তাতে সফল হয়েছে।
রাশিয়ার লাগাতার মিসাইল আক্রমণ
জেলেনস্কির শহরের পর এবার ওডেসায় মিসাইল আক্রমণ রাশিয়ার। নিহত বেসামরিক মানুষ। ধ্বংস হয়েছে দোকান, বাড়ি, গুদাম।
ছবি: Oleksandr Ratushniak/REUTERS
মিসাইল আক্রমণ
যুদ্ধের কৌশল বদলেছে রাশিয়া। আগে তারা সেনা পাঠিয়ে সম্মুখ সমরে নেমেছিল। এবার তারা মিসাইল এবং ড্রোনের সাহায্যে ইউক্রেনে আক্রমণ চালাচ্ছে। একের পর এক শহর লক্ষ্য করে মিসাইল ছোঁড়া হচ্ছে।
ছবি: State Emergency Service of Ukraine/REUTERS
ধ্বংস ওডেসা
বুধবার দিনভর ইউক্রেনের বন্দর শহর ওডেসায় আক্রমণ চালানো হয়েছে। কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ থেকে মিসাইল হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ। অন্তত তিনজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে।
ছবি: Lyashonok Nina/Ukrinform/ABACA/IMAGO
বেসামরিক কাঠামোয় হামলা
ওডেসার গুদাম, দোকান, বাড়ি এবং স্কুলে আক্রমণ চালানো হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য, প্রতিটি ভবন সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরো মানুষ আটকে থাকতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ওডেসার পাশাপাশি দনেৎস্ক অঞ্চলেও বুধবার লাগাতার মিসাইল আক্রমণ করেছে রাশিয়া। সেখানেও অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
ছবি: Oleksandr Ratushniak/REUTERS
জেলেনস্কির শহরে আক্রমণ
এর আগে মঙ্গলবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ছোটবেলার শহর ক্রিভি রিহে মিসাইল হামলা চালানো হয়।
ছবি: Oleksandr Ratushniak/REUTERS
আক্রান্ত কিয়েভ
কিয়েভেও প্রতিদিন ড্রোন এবং মিসাইলের সাহায্যে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। তবে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সাহায্যে কিয়েভে মিসাইল এবং ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হচ্ছে।
ছবি: AFP
বেলারুশে পরমাণু অস্ত্র
এদিকে বেলারুশে রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্র পৌঁছে গেছে বলে জানিয়েছেন দেশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেনকো। রাশিয়ার একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে একথা জানিয়েছেন তিনি।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে ইউক্রেনের ড্রোন মস্কোয় পৌঁছাচ্ছে? বস্তুত, ইউক্রেন সীমান্ত থেকে এতটা ভিতরে ড্রোন হামলা চালানো খুব সহজ কাজ নয়। ড্রোন ইন্টারসেপ্টর দিয়ে অনেক আগেই তা গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা। এখনো পর্যন্ত রাশিয়া কিয়েভের কতগুলি ড্রোন নষ্ট করতে পেরেছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে বেশ কিছু ড্রোন যে মস্কোয় পৌঁছাতে পেরেছে, তা স্পষ্ট।
এখানেই প্রশ্ন। রাশিয়ার মতো শক্তিশালী দেশের কাছে যথেষ্ট ভালো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম থাকার কথা। তার সাহায্যেই তাদের ড্রোন ইন্টারসেপ্ট করার কথা। মস্কো পর্যন্ত একটিও ড্রোন পৌঁছানোর কথা নয়। সীমান্তের কাছেই তা নামিয়ে দেওয়ার কথা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, মস্কোর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যথেষ্ট কার্যকরী নয়। আর সেই সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে ইউক্রেন।