ন্যাটোর মহাসচিব এবং ফ্রান্স ও জার্মানির শীর্ষ নেতাদের পর এবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ইউক্রেনকে নিঃশর্তে পশ্চিমা অস্ত্র প্রয়োগের অধিকারের ইঙ্গিত দিলেন৷ রাশিয়া এমন পদক্ষেপ সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র পেয়েও ইউক্রেন রাশিয়ার ক্রমাগত হামলার মুখে অসহায় হয়ে পড়ছে৷ এমন পরিস্থিতির জন্য একটি শর্তকে দায়ী করা হচ্ছে, যার আওতায় ইউক্রেন পশ্চিমা অস্ত্র একমাত্র অধিকৃত এলাকায় প্রয়োগ করতে পারে৷ এতকাল রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে সেই অস্ত্র ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল৷ অথচ রাশিয়া সেই দু্র্বলতা কাজে লাগিয়ে সীমান্তের কাছে নিজস্ব ভূখণ্ড থেকে ত্রেপণাস্ত্র, ড্রোন ইত্যাদি ব্যবহার করে চলেছে৷ ইউক্রেন নিজস্ব ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়ার ভূখণ্ডে বিচ্ছিন্ন হামলার চেষ্টা করেও তেমন সাফল্য পাচ্ছে না৷
ন্যাটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টলেটবার্গ সম্প্রতি ‘দ্য ইকোনমিস্ট' পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিমা অস্ত্রের বিনিময়ে ইউক্রেনের উপর চাপানো সেই শর্ত তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় সফরে এসে চ্যান্সেলর শলৎসের সঙ্গে যৌথভাবে সেই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত দিয়েছেন৷
এবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের কণ্ঠেও সেই ইঙ্গিত শোনা গেল৷ বুধবার মলদোভায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মার্কিন প্রশাসন ইউক্রেনের বাইরে কোনো লক্ষ্যবস্তুর উপর মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারে সহায়তা বা উৎসাহ দেয় নি৷ ইউক্রেনকেই নিজস্ব প্রতিরক্ষার স্বার্থে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ ব্লিংকেন বলেন, রাশিয়ার হামলার শুরু থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতির প্রয়োজন অনুযায়ী মার্কিন প্রশাসন ধাপে ধাপে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা করে এসেছে৷ রাশিয়ার পদক্ষেপের উপরও সেই সহায়তা নির্ভর করেছে৷ উল্লেখ্য, আগামী নভেম্বর মাসের নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্পের জয় হলে ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সামরিক সহায়তা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে এখনই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য চাপ বাড়ছে৷
খারকিভ অঞ্চলে রাশিয়ার হামলার প্রেক্ষাপটে ন্যাটো ইউক্রেনের জন্য নতুন সহায়তার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছে৷ ন্যাটোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার প্রাগে সে বিষয়ে আলোচনা করছেন৷ মার্কিন নেতৃত্বে ইউক্রেনের জন্য ১,০০০ কোটি ইউরো অংকের যে সহায়তা প্যাকেজ স্থির করা হয়েছে, তার দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোর হাতে হস্তান্তরের বিষয়ে অগ্রগতি আশা করা হচ্ছে৷ সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হলে ন্যাটো এই প্রথম সরাসরি ইউক্রেনে ‘লিথাল' বা আক্রমণাত্মক অস্ত্র হস্তান্তরের দায়িত্ব নেবে৷
ইউক্রেনের সহায়তায় ন্যাটোর বাড়তি পদক্ষেপ সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছে রাশিয়া৷ রাশিয়ার ভূখণ্ডে পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহারে ছাড়পত্র, এফ-১৬ যুদ্ধবিমান হস্তান্তর এবং ন্যাটোর পক্ষ থেকে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহের মতো পদক্ষেপের ফলে বৃহত্তর যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে বলে মস্কো সাবধান করে দিচ্ছে৷
এদিকে পরিস্থিতি শান্ত করতে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ চীনের উদ্যোগে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, চীন বর্তমান সংকটের মূল কারণ দূর করার পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছে, রাশিয়া তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে৷ তবে রাশিয়া এমন প্রস্তাবিত আলোচনার ক্ষেত্রেও ইউক্রেনের ভূখণ্ডে অধিকৃত এলাকার উপর কর্তৃত্বের স্বীকৃতি দাবি করছে বলে শোনা যাচ্ছে৷ ইউক্রেন শুরু থেকেই সেই প্রস্তাব নাকচ করে আসছে৷
এসবি/এসিবি (ডিপিএ, রয়টার্স)
যুদ্ধ ও শান্তি: ন্যাটো ও ভেটোর ভূমিকা
সোভিয়েত রাশিয়ার হুমকির প্রেক্ষিতে জন্ম হলেও নিজেদের উদ্দেশ্য থেকে পরে অনেকটা সরে এসেছে ন্যাটো৷ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত হলেও যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
ন্যাটোর জন্ম
১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করে ন্যাটো৷ চুক্তির পঞ্চম ধারা অনুযায়ী, ‘‘এক বা একাধিক সদস্যের উপর সশস্ত্র হামলা সবার উপর হামলা হিসেবে বিবেচিত হবে৷’’ জন্মলগ্নে জোটের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল তিনটি: সোভিয়েত সম্প্রসারণ ঠেকানো, উত্তর অ্যামেরিকার শক্তিশালী উপস্থিতির মাধ্যমে ইউরোপের সামরিকায়ন নিষিদ্ধ করা এবং ইউরোপে রাজনৈতিক সংহতিকে উৎসাহ দেয়া৷
ছবি: Getty Images/Keystone
কারা সদস্য
শুরুতে ১২ সদস্য নিয়ে যাত্রা করে ন্যাটো৷ ১৯৫২ সালে যোগ দেয় গ্রিস ও তুরস্ক৷ পশ্চিম জার্মানি যোগ দেয় ১৯৫৫ সালে আর ১৯৮২ সালে স্পেন৷ ১৯৯৯ সালে পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক ও হাঙ্গেরি৷ বর্তমানে জোটের সদস্য সংখ্যা ৩০৷
ছবি: AP
নিজেদের বিরোধ
ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন সময় মতভেদ তৈরি হয়েছে৷ প্রথমবার এমন ঘটনা ঘটে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ সংকট নিয়ে৷ ১৯৬৬ সালে ন্যাটোর সামরিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেয় ফ্রান্স এবং সে দেশ থেকে জোটের প্রধান কার্যালয় সরিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানায়৷ নতুন কার্যালয় বসে বেলজিয়ামে৷ তবে ফ্রান্স জোটের মধ্যেই থেকে যায় এবং সংকটকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রাখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
সামরিক উত্তেজনা
১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার হামলা এবং ইউরোপে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনকে কেন্দ্র করে নড়েচড়ে বসে ন্যাটো৷ পাল্টা জবাব হিসেবে পশ্চিম ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর সিদ্ধান্ত নেয় জোট৷ ১৯৮৭ সালে এক চুক্তির মাধ্যমে দুই পক্ষ ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য মাঝারিপাল্লার সব ব্যালাস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নিতে সম্মত হয়, যাকে ঠান্ডা লড়াই সমাপ্তির প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়৷
ছবি: AP
ঠান্ডা লড়াই পরবর্তী যুগ
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া ও বার্লিন দেয়ালের পতনের পর ন্যাটোর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ তবে সময়ের সাথে সাথে বরং উল্টো ন্যাটোর সম্প্র্রসারণ চলতে থাকে৷ এক দশক ধরে চলা যুগোস্লাভ যুদ্ধ ও কসভো-সার্বিয়া সংঘাতে হস্তক্ষেপ করে জোট৷ গড়ে ওঠে ন্যাটো-বহির্ভূত সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক৷
ছবি: AP
নাইন-ইলেভেন: নতুন মোড়
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর ন্যাটো সদস্যসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র আফগানিস্তানে আল-কায়দার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়৷ ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইরাক যুদ্ধে সহায়তা কার্যক্রম চালায় ন্যাটো৷ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বাইরে অন্য রাষ্ট্রে সংঘাত, বিরোধেও নিজেদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে থাকে ন্যাটো৷ লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ভূমিকা রাখতে থাকে৷
ছবি: Chao Soi Cheong/AP/picture alliance
রাশিয়ার সঙ্গে নতুন বিরোধ
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ন্যাটোর সম্প্রসারণ নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখে রাশিয়া৷ ইউক্রেন যাতে ন্যাটোতে যোগ না দেয় সবশেষ সেই নিশ্চয়তা দাবি করে ক্রেমলিন৷ এমন প্রেক্ষিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে হামলা শুরু করেন প্রেসিডেন্ট পুটিন৷ পূর্ব ইউরোপে নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়ালেও এই যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হবে না বলে জানিয়ে আসছে ন্যাটো৷ এই সংঘাত সামনে কোন দিকে মোড় নেবে তা সময়ই বলে দেবে৷
ছবি: Yasin Ozturk/AA/picture alliance
নিরাপত্তা পরিষদ
জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নিরাপত্তা পরিষদের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা৷ ১৫ সদস্যের মধ্যে স্থায়ী সদস্য পাঁচ পরমাণু শক্তিধর দেশ: চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র৷ তাদের সবার সম্মতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত পাস করা যায় না৷ বিপরীতভাবে কোনো সিদ্ধান্তে কেউ ভেটো দিলে তা বাতিল হয়ে যায়৷ বিভিন্ন সময়ে এই পাঁচ সদস্য তাদের স্বার্থ অনুযায়ী ভেটো ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েছে৷
ছবি: Yorick Jansens/dpa/picture alliance
সবচেয়ে বেশি রাশিয়া
ভেটো ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করেছে রাশিয়া৷ ২৬৫টির মধ্যে ১১৯ বার ভেটো দিয়েছে তারা৷ ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে যত ভেটো দেয়া হয়েছে তার সবগুলোই ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকে৷ শীতল যুদ্ধের যুগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়ে আসছে রাশিয়া৷ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তোলা পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও ভেটো দেয় রাশিয়া৷
ছবি: Reuters
রাশিয়ার সহযোগী চীন
চীন মোট ১৬ বার ভেটো দিয়েছে, এর মধ্যে ১৩ বারই রাশিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে আর তিনবার এককভাবে৷ ১৯৭১ সালের ২৫ আগস্ট চীন তার প্রথম ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির বিরুদ্ধে৷
ছবি: ASSOCIATED PRESS/picture alliance
ইসরায়েলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র
ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগে রাশিয়ার পরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ ৮২ বার তারা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে৷ এর অনেকগুলোই ছিল ইসরায়েলকে নিয়ে৷ মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিনে সংঘাত ও হামলা নিয়ে দেশটির বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবে বরাবরই ভেটো দিয়ে এসেছে ওয়াশিংটন৷ তবে ২০১৬ সালে ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালে ইসারেয়েলের বসতিস্থাপন বন্ধে আনা একটি প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থাকে তারা৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/A. Lohr-Jones
সহযোগী যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স
যুক্তরাজ্য ২৯ বার ও ফ্রান্স ১৬ বার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে বিভিন্ন প্রস্তাব নাকচ করেছে তারা৷ তবে ১৯৮৯ সালের পর ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য আর ভেটো ক্ষমতার ব্যবহার করেনি৷ সেবার পানামায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছিল দেশ তিনটি৷
ছবি: Reuters/C. Allegri
সবশেষ
নিরাপত্তা কাউন্সিলে তোলা প্রস্তাবে সবশেষ ভেটোর ঘটনাটি ঘটে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি৷ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বন্ধ ও নিন্দা জ্ঞাপনের প্রস্তাব আনে কয়েক ডজন দেশ৷ তবে রাশিয়ার একার ভেটোতে তা বাতিল হয়ে যায়৷