তিমি ও ডলফিন পরিবারে বেলুগা তার সুরেলা কণ্ঠের জন্য বিখ্যাত৷ রাশিয়ায় এই প্রাণীর চরম অবস্থা তুলে ধরার উদ্যোগ নিচ্ছেন দুই তথ্যচিত্র পরিচালক৷ বেলুগাদের বিলুপ্তি থেকে বাঁচাতে তাঁরা সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন৷
বিজ্ঞাপন
রাশিয়ার দুই চলচ্চিত্র পরিচালকের কাজ শুরু হয়েছিল কৃষ্ণ সাগরে৷ সেখানেডলফিন ও বেলুগা বা সাদা তিমির ছবি তোলেন তাঁরা৷ তাদের গানের গলা কী সুন্দর! শিশু বয়সেই তাঁরা এসব প্রাণীর সঙ্গে সাঁতার কেটেছেন৷ এখন এই প্রাণীর সংখ্যা মারাত্মক হারে কমে চলেছে৷ প্রায়ই বেলুগা অ্যাকোয়েরিয়ামে বিক্রি করা হয়ে থাকে৷
তারা রাশিয়ার উত্তর মহাসাগরে বড় পরিবারে বসবাস করে৷ খুবই বুদ্ধিমান ও সামাজিক প্রাণী তারা৷ দুই পরিচালক মনে করেন, এই প্রাণীদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ছোট জায়গায় পুরে দেওয়া বড় অপরাধ৷ তাঁরা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে, কৃষ্ণ সাগর উপকূল ও চীনে একের পর এক ডলফিনেরিয়াম গজিয়ে উঠছে৷ ফলে নতুন বেলুগার চাহিদা বেড়েই চলেছে৷
এমন অ্যাকোয়েরিয়ামের চার দেয়ালে আটকে থাকা এই প্রাণীদের জন্য নারকীয় যন্ত্রণার কারণ৷ মুক্ত পরিবেশে বেলুগা দিনে কয়েকশ' কিলোমিটার সাঁতার কাটে৷ বন্দিদশায় ছোট জায়গার মধ্যে তাদের খেলা দেখাতে হয়৷ বুদ্ধিমান এই প্রাণীকে পতুলের মতো কাজে লাগানো হয়৷ তথ্যচিত্র পরিচালক টাটিয়ানা বেলি বলেন, ‘‘বন্ধ দরজা ও বেড়ার মধ্যে বেলুগা ও ডলফিনদের নিয়ে যা চলে, সেটা জানতে পারলে খুবই খারাপ লাগে৷ তার উপর তাদের সাহায্য করতে না পেরে আরও খারাপ লাগে৷''
দুই রুশ পরিচালক বিষয়টি নিয়ে খুবই তৎপর৷ ৪ বছর ধরে তাঁরা এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন৷ রাশিয়ায় যেসব জায়গায় বেলুগা ধরা হয়, কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও তাঁরা সেইসব জায়গায় গেছেন৷ তাঁরা এমন এক তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন, যা নিয়ে রাশিয়ায় তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ তথ্যচিত্র পরিচালক গায়ানে পেট্রোসিয়ান বলেন, ‘‘দেশের পূর্বাংশে যাত্রার অভিজ্ঞতা ছিল সবচেয়ে খারাপ৷ সেখানে যা দেখেছি, তা অবিশ্বাস্য৷ প্রাণীদের নতুন করে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাদের উপর অত্যাচার চলে৷ ফলে বিশেষ করে পরিবহণের সময় অনেকে মারা যায়৷ কিন্তু কর্মীরা ভাবলেশহীন থাকেন৷ শুটিংয়ের সময়ে আমাদের বারবার হুমকি দেওয়া হয়েছে৷''
তিমিদের কেন সৈকতে পাওয়া যাচ্ছে?
গত সপ্তাহে উত্তর সাগর সংলগ্ন জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের উপকূলে ১২টি মৃত তিমির দেখা পাওয়া গেছে৷ কী কারণে তাদের এই দুরবস্থা তা বের করার চেষ্টা চলছে?
ছবি: picture-alliance/dpa/I.Wagner
দুঃসংবাদ
গত সপ্তাহে উত্তর সাগর সংলগ্ন জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের উপকূলে ১২টি মৃত তিমির দেখা পাওয়া গেছে৷ একেকটি তিমির দৈর্ঘ্য ১০ মিটারেরও বেশি৷ তাদের মৃত্যুর কারণ জানতে তিমিদের ময়নাতদন্ত করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/I.Wagner
ক্রেনের সহায়তা
জার্মানির লোয়ার সাক্সনি রাজ্যের উপ পরিবেশমন্ত্রী আলমুট কোটভিৎস ডয়চে ভেলেকে বলেন, সৈকত থেকে তিমিদের সরিয়ে নেয়ার কাজ একইসঙ্গে কঠিন ও মজার৷ একটি নারী তিমির ওজন গড়ে সাড়ে ১৬ টন হয়ে থাকে৷ আর পুরুষ তিমির ওজন ৬০ টন পর্যন্ত হতে পারে৷ ফলে সৈকতে পাওয়া তিমিগুলো বয়সে তরুণ হলেও তাদের পরীক্ষাগারে নিয়ে যেতে ক্রেনের সহায়তা নিতে হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/I.Wagner
জাদুঘরে প্রদর্শিত হবে
দেখছেন একটি তিমির চোয়াল৷ এটি গিসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ এর হাড়গুলো জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য রাখা হবে৷ আরেকটি কংকাল স্ট্রালসুন্ডের মেরিন জাদুঘরে রাখা হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Rumpenhorst
খাবারের অভাব
কোটভিৎস ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, মৃত তিমিগুলোর কয়েকটির পেট একদম খালি ছিল৷ তারা অপুষ্টিতে ভুগছিল৷ এই জাতের তিমি সাধারণত স্কুইড খেয়ে থাকে৷ কিন্তু উত্তর সাগরে এগুলো পাওয়া যায় না৷ তাই প্রশ্ন ওঠেছে, তিমিগুলো উত্তর সাগরে এলো কী করে?
ছবি: picture-alliance/dpa/A. van Elten
এলোমেলো অবস্থা?
জার্মানির কিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ ক্লাউস ফান্সেলোভ ডয়চে ভেলেকে বলেন, গত ডিসেম্বরে তিনটি বড় ‘সোলার উইন্ড’ বা সৌর ঝড় হয়েছে৷ এতে তিমিগুলো দিশেহারা হয়ে দিক ভুলে উত্তর সাগরে ঢুকে পড়তে পারে৷ তারপর খাবার না পেয়ে অপুষ্টিতে ভুগে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Wassman
অগভীর সাগর
কয়েকটি তিমি অপুষ্টিতে ভুগলেও বাকিগুলোর পেট ভরাই ছিল৷ কিন্তু তাদের যে সমস্যা হতে পারে সেটা হচ্ছে, সাগরের অগভীরতা৷ এ সব তিমি সাধারণত সাগরের কয়েক’শ মিটার পানির নীচে চলাফেরা করে৷ কিন্তু উত্তর সাগর তত গভীর নয়৷ ফলে তারা উত্তর সাগরে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে না পেরে নতুন স্থানের সন্ধান করতে করতে সৈকতে পৌঁছে থাকতে পারে বলে গবেষকরা মনে করছেন৷
ছবি: picture-alliance/Wildlife
হাজার হাজার তিমির গন্তব্য সৈকত
তিমি ও ডলফিন নিয়ে কাজ করেন ফাবিয়ান রিটার৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, বছরে গড়ে কয়েক হাজার তিমি সৈকতে ভিড়ছে৷ যেমন ছবিতে সপ্তাহখানেক আগে ভারতের একটি সৈকতে ছোট জাতের ৮০টি তিমি পড়ে থাকতে দেখা যায়৷ স্থানীয়রা কয়েকটিকে আবারও সাগরে পাঠাতে সমর্থ হলেও কয়েকটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Str
সামরিক প্রশিক্ষণ
পরিবেশবিদরা বলেন, সাগরের পানির নীচে শব্দের কারণে সেখানকার প্রাণীজগতের সমস্যা হয়৷ যেমন সামরিক প্রশিক্ষণ চলার কারণে যে শব্দ দূষণ সৃষ্টি হয়, তা প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: AFP/Getty Images/J. Kriswanto
8 ছবি1 | 8
তা সত্ত্বেও ‘পোলার সার্কেল' বা মেরুচক্রের কাছে তাঁরা ছবি তুলতে পেরেছেন৷ সেখানে বিশেষ করে কমবয়সি ধূসর রংয়ের বেলুগা ধরার চেষ্টা চলে৷ কারণ, শুধু তাদেরই প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব৷ রং সাদা হয়ে গেলে নতুন করে কিছু শেখা সম্ভব নয়৷বড় তিমিগুলি তাদের শিশুদের বাঁচানোর চেষ্টা করে৷ কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তারা নিজেরাই জালে আটকে পড়ে৷ অনেক তিমি এভাবে মারা যায়৷ গায়ানে পেট্রোসিয়ান বলেন, ‘‘এইসব পুরানো জং-ধরা আধারে করে তাদের চীনে পাঠানো হয়৷ দিনের পর দিন তাদের বদ্ধ জায়গায় থাকতে হয়, প্রায়ই চরম উত্তাপের মধ্যে৷''
ওঠানামার সময়ে প্রায়ই প্রাণীদের ঘাড় ভেঙে যায়৷ ধূসর শাবকদের জন্য অ্যামিউজমেন্ট পার্কগুলি ৪০,০০০ থেকে ১ লক্ষ ইউরো দিতে প্রস্তুত থাকে৷ তাদের নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চলছে৷
এর মধ্যে সেই চলচ্চিত্র রাশিয়ার সিনেমা হলে দেখানো হচ্ছে৷ ইউরোপ, অ্যামেরিকা ও ক্যানাডার তথ্যচিত্র নির্মাতাদের মতো এই পরিচালকরাও এভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করতে চান৷ সেখানে পশু সুরক্ষায় বিধিনিয়ম বেশ কড়া হয়ে উঠেছে৷
রাশিয়ার মানুষের এ বিষয়ে ধারণা নেই বললেই চলে৷ তাই এমন ছবি দেখেও তাঁদের প্রতিক্রিয়া অবাক করার মতো৷ একজন বলেন, ‘‘রাশিয়ায় এমন ছবি হওয়া ভালো, যাতে এমন অবিচার মানুষের সামনে তুলে ধরা যায়৷ কিন্তু বড় সমস্যা হলো এখানে তিমি রাখার কোনো বিধিনিয়ম নেই৷ এমন বুদ্ধিমান প্রাণী রাখার জন্য সরকারি নিয়ম না থাকা সত্যি খুবই খারাপ৷''
দুই চলচ্চিত্র নির্মাতা ঠিক সেটাই চান৷ বেলুগা ধরা বন্ধ করতে ও অ্যাকোয়াপার্কে তাদের রাখতে স্পষ্ট আইন প্রণয়ন দেখতে চান৷
এই চক্র ভাঙতে কয়েক বছর লেগে যাবে৷ রাশিয়ার সংবাদপত্রগুলিতে এই প্রথম বেলুগাদের করুন অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে৷ তবে এই তথ্যচিত্র আপাতত হাতে গোনা কয়েকটি বিশেষ সিনেমা হলে প্রদর্শিত হচ্ছে৷
বির্গিট ভিয়রনিশ/এসবি
ড্রোন দিয়ে তোলা তিমির ছবি
ড্রোন এখন অনেক কাজেই ব্যবহার হচ্ছে৷ ছবি তোলা এর মধ্যে একটি৷ ছবিঘরে ড্রোন দিয়ে তোলা সাগরে তিমিদের চলাচলের কিছু ছবি দেখা যাবে৷
ছবি: NOAA, Vancouver Aquarium
তিমির আচরণ জানা
সাগরে তিমিদের আচরণ সম্পর্কে আরও ভালো করে জানতে মার্কিন বিজ্ঞানীরা এবার ড্রোনের সাহায্য নিচ্ছেন৷ ‘ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ার এডমিনিস্ট্রেশন’-এর বিজ্ঞানীরা ড্রোনের মাধ্যমে তিমির শিকার ধরার পদ্ধতি ও সামাজিক আচরণ জানার চেষ্টা করছেন৷
ছবি: NOAA, Vancouver Aquarium.
অন্তরঙ্গ মুহূর্ত
সাগরের পানির স্তর থেকে প্রায় ৪০ মিটার উঁচু থেকে ড্রোন দিয়ে ছবি তোলা হয়৷ ফলে তিমিরা ছবি তোলার বিষয়টি বুঝতে পারে না৷ তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করতে পারে৷ ছবিতে দুটো তিমিকে এক অন্তরঙ্গ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: NOAA, Vancouver Aquarium
নতুন সুযোগ
ড্রোন ব্যবহারের কারণে বিজ্ঞানীরা এখন একসঙ্গে অনেকগুলো প্রাণী পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন৷ তাদের শারীরিক অবস্থার দিকেও নজর রাখা যাচ্ছে৷
ছবি: NOAA, Vancouver Aquarium.
পার্থক্য জানা
বামের ছবিটি ভালো করে খেয়াল করুন৷ সেখানে একটি মা তিমির সঙ্গে তার বাচ্চাকে দেখা যাচ্ছে৷ পাশের ছবিটিও তাই৷ কিন্তু বুঝতেই পারছেন বামের চেয়ে ডানের তিমির শারীরিক অবস্থা অনেক ভালো৷ এরকম ছবির কারণে বিজ্ঞানীরা তিমিদের মধ্যে থাকা এরকম পার্থক্য ও তার কারণ বোঝার চেষ্টা করতে পারছেন৷
ছবি: NOAA
একটি পরিবার
এরা একই পরিবারের সদস্য৷ ছবির মতোই এই জাতের তিমিরা জীবনের বেশিরভাগ সময় একসঙ্গে চলাফেরা করে৷ ড্রোন না থাকলে কি এমন ছবি দেখা সম্ভব হতো?