রাশিয়া ও ইউক্রেনের বিরোধে মধ্যস্থতা করতে চাইছেন এর্দোয়ান। তার এই প্রয়াস কি সফল হবে?
বিজ্ঞাপন
তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়া ও ইউক্রেন দুজনেরই সম্পর্ক ভালো। দুই দেশের সঙ্গেই তুরস্কের বাণিজ্য সম্পর্ক খুবই জোরদার। তাই রাশিয়া যদি ইউক্রেন আক্রমণ করে, তাহলে তুরস্ক বিপাকে পড়বে।
সেজন্যই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান এখন দুই দেশের বিরোধে মধ্যস্থতা করতে চাইছেন। তিনি বৃহস্পতিবার কিয়েভ যাচ্ছেন। তিনি দেশে ফেরার পর ভ্লাদিমির পুটিন তুরস্কে আসবেন। তখন পুটিনের সঙ্গে এর্দোয়ানের আলোচনা হবে। প্রশ্ন হলো, এর্দোয়ান কি বিরোধ মেটাতে পারবেন? তিনি কি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে পারবেন?
কূটনৈতিক সাফল্যের আশা কম
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, এর্দোয়ানের সফল হওয়ার আশা কম। রাজনীতি ও রাশিয়া বিশেষজ্ঞ আইডিন সেজারের মতে, ''এর্দোয়ানের পক্ষে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করা অসম্ভব। কারণ, তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য এবং ন্যাটো ইতিমধ্যেই অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া মস্কো আজ পর্যন্ত তুরস্কের যাবতীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।''
ইস্তাম্বুলের আইডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক কারাকাও মনে করেন, ''এর্দোয়ানের সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তুরস্ক ও ইউক্রেনের মধ্যে শেষ যে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে, সেখানে এর্দোয়ান ইউক্রেনকে সম্পূর্ণ সমর্থন করার কথা জানিয়েছেন। সেখানে এর্দোয়ান রাশিয়ার দাবি মানেননি।''
ইউক্রেন অস্ত্র পাচ্ছে, আরও চায়
২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রাইমিয়া দখল করার পর সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে ইউক্রেন৷ সম্প্রতি রাশিয়া সীমান্তে সেনা উপস্থিতি বাড়ানোয় উত্তেজনা তৈরি হয়েছে৷ পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে৷ তবে আরও দরকার, বলছে ইউক্রেন৷
২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকার অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে৷ এর মধ্যে আছে জ্যাভলিন অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল (ছবি), টহল বোট, হামভি, স্নাইপার রাইফেল, ড্রোন, রাডার সিস্টেম, নাইট ভিশন ও রেডিও ইকুইপমেন্ট৷
কয়েক ব্যাচ বায়রাকটার টিবিটু ড্রোন বিক্রি করেছে৷ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ডনবাস এলাকায় রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে এগুলো ব্যবহৃত হয়েছে৷
ছবি: Murat Cetinmuhurdar/Turkish Presidency/handout/picture alliance / AA
জার্মানি
ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে৷ তবে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে যে ৫১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে তার একটা অংশ দিচ্ছে জার্মানি৷
ছবি: Sean Gallup/Getty Images
ইউক্রেন আরও যা চায়
যুক্তরাষ্ট্র থেকে হেলিকপ্টার, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও হালকা সাঁজোয়া যান চায়৷ নরওয়ে থেকে চায় সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম৷ এছাড়া মাঝারি ও স্বল্প রেঞ্জের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও চায় ইউক্রেন৷
ছবি: DARKO BANDIC/AFP via Getty Images
6 ছবি1 | 6
তুরস্ক ইউক্রেনকে যুদ্ধে ব্যবহার করা যায় এমন ড্রোন দিয়েছে। তাতে রাশিয়া ক্ষুব্ধ। কয়েক সপ্তাহ আগেই পুটিন বলেছিলেন, রাশিয়া সমর্থিত বাহিনী (বিচ্ছিন্নতাবাদী) যেখানে আছে, সেখানে এই ড্রোন দেখা গেছে। এছাড়া পুটিনের অভিযোগ ছিল, তুরস্ক খুব বেশি করে ইউক্রেনকে সমর্থন করছে।
রাশিয়ার গ্যাস চাই
তুরস্ক ও রাশিয়ার সম্পর্ক বেশ জটিল। তুরস্ক নিজেদের সুরক্ষার জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিনেছে। কিন্তু লিবিয়া, সিরিয়া, নাগর্নো-কারাবাখ ও ইউক্রেন প্রশ্নে তারা রাশিয়ার বিরোধিতা করেছে।
আবার দুই দেশের মধ্যে খুব ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। তুরস্ক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। বছরে তাদের ৪৮ বিলিয়ান কিউবিক মিটার গ্যাস লাগে। তার মধ্যে ৩৩ দশমিক ছয় বিলিয়ান কিউবিক মিটার গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। এই গ্যাস আসা বন্ধ হলে তুরস্ক বিপাকে পড়বে।
পূর্ব ইউক্রেনের বিভাজন রেখায় বাড়ছে উত্তেজনা
রাশিয়ার সঙ্গে চরমে উঠেছে ইউক্রেনের সংঘাত৷ রাশিয়া সীমান্তে ন্যাটোর সেনা মোতায়েন উত্তেজনা বাড়িয়েছে৷ ইউক্রেন সীমান্তে সামরিক তত্পরতা বাড়িয়েছে মস্কো৷ অন্যদিকে ইউক্রেনও পিছিয়ে নেই৷ প্রস্তুত রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও৷
ছবি: AP Photo/picture alliance
রুশ-ইউক্রেন উত্তেজনা
ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর একজন সেনাকে দেখা যাচ্ছে৷ দনেত্স্ক এলাকার হরলিভকাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত তিনি৷ রুশপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিভাজন রেখার কাছে বন্দুকধারী সেনার ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছেন একজন আলোকচিত্রী৷
ছবি: Anna Kudriavtseva/REUTERS
সেনার প্রস্তুতি
রাশিয়ার গুপ্তচররা ইউক্রেনের ভিতরে ঢুকে যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ৷ যদিও রাশিয়া এই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ দনেত্স্ক এলাকায় রাশিয়াকে রুখতে প্রস্তুত রয়েছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী৷
প্রত্যেক ইউক্রেনীয় সেনাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত৷ যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হতে পারে, মানসিকভাবে এমন প্রস্তুতি রয়েছে তাদের৷
ছবি: Anna Kudriavtseva/REUTERS
প্রস্তুত ‘নোঁ দ্য গ্যার ইয়াকুট’
লুহানস্ক এলাকায় পোপাসনা শহরে ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী ভোলোদিয়ার সেনারাও প্রস্তুত৷ এরা ‘নোঁ দ্য গ্যার ইয়াকুট’ নামে পরিচিত৷
ছবি: Maksim Levin/REUTERS
সামরিক অবস্থান শনাক্ত
দনেত্স্ক পিপলস রিপাবলিকের (ডিএনআর) এক অস্ত্রধারী জঙ্গির (মস্কোপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী) ছবিও ধরা পড়েছে চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরায়৷ সামরিক অবস্থান খতিয়ে দেখে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারাও৷
ছবি: Alexander Ermochenko/REUTERS
প্রতিপক্ষের মোকাবিলায়
লুহানস্ক এলাকায় পোপাসনায় রয়েছেন ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর সেনা আন্দ্রে৷ নোঁ দ্য গ্যার দ্রুইদ হিসেবে পরিচিত আন্দ্রেও মানসিকভাবে প্রতিপক্ষের মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছেন৷
ছবি: Maksim Levin/REUTERS
ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর সেনা
লুহানস্কে বরফ ঢাকা পথে হেঁটে চলেছেন ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর সেনারা৷ সামরিক বিন্যাস নিয়ে তৈরি তারা৷ একদিকে জারি হাই অ্যালার্ট, অন্যদিকে সেনা মোতায়েন৷ যুদ্ধের দামামা কি বেজে গেল? রাশিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ কী? উঠে আসছে এই প্রশ্নগুলি৷
ছবি: Maksim Levin/REUTERS
8 ছবি1 | 8
গ্যাজডে-র সিইও মেহমেত দোগানের মতে, ''যদি উত্তেজনা আরো বাড়ে এবং রাশিয়া তুরস্ককে গ্যাস দেয়া বন্ধ করে দেয়, তাহলে কী হবে? তুরস্কে গ্যাসের দাম আকাশ ছোঁবে। তুরস্ক ভয়াবহ অসুবিধার মধ্যে পড়বে।''
তুরস্কের কৃষিজাত জিনিস রাশিয়ায় যায়। রাশিয়া থেকে প্রচুর পর্যটক তুরস্কে আসেন। সেসব বন্ধ হলে তুরস্কের দুর্দশা বাড়বে।
ইউক্রেনের সঙ্গেও সুসম্পর্ক
তুরস্কের কাছে ইউক্রেনও গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্ক-ইউক্রেন বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এবং গত ১২ বছর ধরে কিয়েবে বসবাসকারী বুরাক পেহলিভান বলেছেন, তুরস্কের সংস্থাগুলি ইউক্রেনে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। গতবছর তুরস্ক ও ইউক্রেনের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭৫০ কোটি ডলার।
তাই তুরস্ক চাইছে, বর্তমান পরিস্থিতি যেন আর খারাপ না হয়। এর্দোয়ান তুরস্কে সুদের হার কম রাখায় সেখানে মুদ্রাস্ফীতি প্রবল আকার নিয়েছে। অর্থনীতি চাপে পড়েছে। এখন রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে তুরস্কের বাণিজ্য মার খাবে।
এর্দোয়ান এখনো পর্যন্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কির পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে এর্দোয়ানের ইউক্রেন সফরের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পুটিনের তুরস্ক সফর। পুটিন কি এর্দোয়ানকে মধ্যস্থতা করার সুযোগ দেবেন, সেটাই দেখার।