রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলে একটি রিটের বিরোধিতা করে শুক্রবার সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম৷ শুধু তাই নয়, পরে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মাহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ৷
বিজ্ঞাপন
স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ ১৯৮৮ সালের ৫ই জুন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংযুক্ত করার পর, সেই বছরই সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনসহ ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন৷ রুল দেয়ার পর দীর্ঘ ২৩ বছর আবেদনটি হাইকোর্টে বিচারাধীন ছিল৷ গত ২৯শে ফেব্রয়ারি হাইকোর্টে এই রুলের ওপর শুনানি হয়৷
মুফতি ফয়জুল্লাহ
শুনানি শুরুর পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে শুরু করে হেফাজতে ইসলাম৷ পরবর্তী শুনানির দিন ২৭শে মার্চ৷ তাই এরইমধ্যে রিটের শুনানি স্থগিত এবং রিট বাতিলের দাবি জানিয়েছে তারা৷ তবে হেফাজত একা নয়, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু ইসলামি দল৷
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মাহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা মনে করি যারা এই রিট করেছেন তারা শুধু ইসলাম না, তারা সব ধর্ম বিরোধী৷ তারা ইসলামের অবমাননা করছেন৷ মুসলমানদের এই দেশে ইসলামের অবমামনা সহ্য করা হবে না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা আশা করি এই রিট খারিজ হবে এবং তা বাতিল করা হবে৷ আর সেটা যদি না করা হয়, তাহলে দেশের মানুষ তা মানবে না৷ আমরা আইন মানি, বিচারবিভাগ মানি৷ কিন্তু আল্লাহর আইনের ওপর বড় কোনো আইন নেই৷ এই দেশে ইসলামবিরোধী কোনো আইন বা সিদ্ধান্ত চলবে না৷ তাই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে, থাকবে৷''
অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক
তিনি জানান, শুক্রবার এই রিটের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের পর আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে৷
এ নিয়ে রিটের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে রিট করিনি৷ আমাদের অবস্থান ইসলামের বিরুদ্ধেও নয়৷ আমরা সংবিধান সমুন্নত রাখার জন্য লড়াই করছি৷ সংবিধানের ৮, ১২ এবং ২৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম বিষয়টি সাংঘর্ষিক৷ সংবিধান সব ধর্ম এবং সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার এবং সমনীতির নিশ্চয়তা দিয়েছে, যার মূলনীতি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা৷ রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের মাধ্যমে এই নীতি ক্ষুণ্ণ হয়েছে৷''
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা ভীত নই৷ জীবনের ভয় করি না৷ জীবনের ভয় করলে মানুষের অধিকার নিয়ে লড়াই করতাম না৷''
আপনি কি হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকে সমর্থন করেন?
ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে পৃথককরণ
তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের আমল থেকে ‘‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিচ্ছেদ’’ কথাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু৷ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে এই সমস্যার মূল্যায়ন ও সমাধান আজও আলাদা৷ তার কিছু নমুনা৷
ছবি: Jewel Samada/AFP/Getty Images
অস্ট্রেলিয়া
কমনওয়েলথ দেশটির সংবিধানে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা বা সরকারি পদ গ্রহণের জন্য কোনো ধর্ম পরীক্ষা নিষেধ করা আছে৷ অপরদিকে যে কোনো ধর্ম মুক্তভাবে পালন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ (ছবিতে সিডনির সংসদ ভবনের উপর অস্ট্রেলিয়ার লোগো)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/L. Coch
ব্রাজিল
ব্রাজিলের বর্তমান সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে; কোনো রাষ্ট্রীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ সরকারি কর্মকর্তাদের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের ‘‘জোট গঠন বা নির্ভরতা’’ নিষিদ্ধ৷ (ছবিতে ব্রাজিলের কনগ্রেসো নাসিওনাল বা জাতীয় কংগ্রেস, যার দুই কক্ষ হলো সেনেট এবং চেম্বার অফ ডেপুটিজ)৷
ছবি: Voishmel/AFP/Getty Images
চীন
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘‘কোনো সরকারি বিভাগ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নাগরিকদের কোনো ধর্মে বিশ্বাস করতে বা না করতে বাধ্য করতে পারবে না; এছাড়া যে সব নাগরিক কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন অথবা করেন না, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা চলবে না৷’’ (ছবিতে বেইজিং-এর গ্রেট হল অফ দ্য পিপল, যেখানে প্রতিবছর ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/How Hwee Young
ফ্রান্স
ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদকে ফরাসিতে বলা হয় ‘লাইসিতে’৷ ফ্রান্সে ধর্ম ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পরস্পরের থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ একদিকে যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, অপরদিকে সরকারি ক্ষমতাকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ (ছবিতে প্যারিসের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় সম্মেলন)৷
ছবি: picture-alliance/ZB/M. Tödt
জার্মানি
জার্মান সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে, যদিও জার্মানিতে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে পুরোপুরি বিচ্ছেদ নেই৷ সরকারিভাবে স্বীকৃত গির্জাগুলিকে পাবলিক কর্পোরেশনের মর্যাদা দেওয়া হয়, তাদের প্রাপ্য কিছু কিছু কর সরকার আদায় করে দেন – তবে বিনামূল্যে নয়৷ ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয় নয়৷ (ছবিতে বার্লিনের বুন্ডেসটাগ বা জার্মান সংসদ)৷
ছবি: imago/Schöning
জাপান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন দখলদারির সময় ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মার্কিন ধ্যানধারণা জাপানে আরোপিত হয়৷ জাপানের সংবিধানে ধর্মপালনের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করা হয়েছে, অপরদিকে সরকার ধর্মপালনের জন্য কোনোরকম চাপ দিতে পারবেন না, অথবা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে সরকারি অর্থ ব্যয় করতে পারবেন না৷ (ছবিতে টোকিও-র সংসদভবন)৷
ছবি: Reuters
সুইজারল্যান্ড
সুইশ কনফেডারেশনের ফেডারাল সংবিধানে ‘‘ধর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতা’’-র গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে৷ বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে, ‘‘কোনো ব্যক্তিকে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে যোগ দিতে বা অঙ্গ হতে, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বা ধর্মীয় নির্দেশ অনুসরণ করতে বাধ্য করা চলবে না’’৷ (ছবিতে বার্ন শহরের বুন্ডেসহাউস বা ফেডারাল প্যালেস, যেখানে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন বসে)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Klaunzer
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যের চার্চ অফ ইংল্যান্ডের প্রধান হলেন ব্রিটিশ নৃপতি স্বয়ং, তিনিই গির্জার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করেন৷ হাউস অফ লর্ডস-এও ২৬ জন বিশপের আসন আছে৷ সব সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ সীমিত, যুক্তরাজ্যে সরকারি শাসনও অপেক্ষাকৃতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ৷ ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধান অনুযায়ী অপরাপর ধর্মীয় গোষ্ঠীও ব্যাপক স্বাধীনতা উপভোগ করে৷ (ছবিতে প্যালেস অফ ওয়েস্টমিনস্টার)৷
ছবি: Mohammad Karimi
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
গির্জা ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সম্পর্কে জেফারসনের প্রখ্যাত উক্তি মার্কিন সংবিধানে উল্লিখিত নেই৷ ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্টে বলা হয়েছে যে, ‘‘(মার্কিন) কংগ্রেস কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে, বা মুক্তভাবে ধর্মপালন নিষিদ্ধ করে কোনো আইন প্রণয়ন করবে না’’৷ (ছবিতে ক্যাপিটল হিল-এ মার্কিন কংগ্রেসের আসন)৷