রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করা সংক্রান্ত একটি পিটিশন খারিজ করে দিয়েছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই নিয়ে মন্তব্য করেছেন অনেকে৷ কেউ কেউ এখনো আশাবাদী৷
বিজ্ঞাপন
২৮ বছর আগে করা একটি পিটিশন সোমবার মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে খারিজ করে দিয়েছে বাংলাদেশের হাইকোর্ট৷ আদালত মনে করছে, সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার পিটিশন যে গ্রুপ করেছিল, তাদের তা করার এখতিয়ার নেই৷
আদালতের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি ব্লগার বন্য আহমেদ৷ মুক্তমনা ব্লগের এই মডারেটর ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘সবাইকে অভিনন্দন! ইসলাম রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব এতদিন শুধু আমাদের সরকারেরই ছিল এবার আমাদের মাননীয় উচ্চ আদালতও সেই ঈমানী দায়িত্বে শরিক হইলেন৷ আর চিন্তা নেই, শান্তি-ভালোবাসার বেহেস্তি আমল কায়েম হইলো বলে৷''
বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করে বন্যা লিখেছেন, ‘‘এতদিন আওয়ামী সরকারকে নাকি ‘ফাইন লাইনে' হাঁটতে হইতো (আমি কই নাই কথাটা, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ছেলে কইসিলো রয়টারের সাক্ষাৎকারে গতবছর), হেফাজতিদের ডরে নাকি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে রাস্তায় খুন হয়ে পড়ে থাকা অভিজিতের বাবাকে ফোন করতে হইতো লুকায়াছুপায়া – আপদ নাস্তিকগুলা খুন হইলে মুখে স্কচটেপ মাইরা রাখতে হইতো – পাছে যদি হেফাজতিরা গোসা করে! যাক ওদের কষ্ট তো দূর হইলো, আমাদের ইহাতেই শান্তি৷''
বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন মনে করেন, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে নেই৷ বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সক্রিয় বিতর্কিত এই লেখিকা টুইটারে লিখেছেন:
প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করা হলে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের হুমকি দিয়েছিল উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলাম৷ তাদের সেই ঘোষণার পর রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের পিটিশন খারিজ হয়ে যাক, যাকে বিজয় হিসেবে দেখছে গোষ্ঠীটি৷ ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার সাংবাদিক প্রবীণ স্বামী টুইটে তুলে ধরেছেন সেকথা:
আদালত পিটিশন খারিজ করায় এখন খানিকটা বিভ্রান্ত ভারতের রাজনীতিবিদ পরিমল নাথভানি৷ তাঁর প্রশ্ন, বাংলাদেশের পরিচয় এখন তাহলে কী?
লন্ডন প্রবাসী ব্লগার আরিফুর রহমান অবশ্য এখনো আশাবাদী৷ তিনি মনে করেন, আদালত পিটিশনটি যে কারণে খারিজ করেছেন, তার সঙ্গে এর বিষয়বস্তুর কোনো সম্পর্ক নেই৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘দুঃখের বিষয় হলো, আইনি এই সাধারণ প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে না বুঝে সবাই বলছে ‘আদালত নাকি ইসলাম সমুন্নত রেখেছে৷' যেখানে আলোচনাই হয় নাই, সেখানে বিবেচ্য বিষয়ের ওপর আদালতের রায়ের কোনো প্রশ্নই আসে না৷ কাজেই সঠিকভাবে আগামীতে আবেদন দাখিল করলে আলোচনা হবে, এবং আশা করছি এই কলঙ্কজনক ২ক ধারা সংবিধান থেকে লোপ পাবে৷''
ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে পৃথককরণ
তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের আমল থেকে ‘‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিচ্ছেদ’’ কথাটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু৷ বিভিন্ন দেশের সংবিধানে এই সমস্যার মূল্যায়ন ও সমাধান আজও আলাদা৷ তার কিছু নমুনা৷
ছবি: Jewel Samada/AFP/Getty Images
অস্ট্রেলিয়া
কমনওয়েলথ দেশটির সংবিধানে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা বা সরকারি পদ গ্রহণের জন্য কোনো ধর্ম পরীক্ষা নিষেধ করা আছে৷ অপরদিকে যে কোনো ধর্ম মুক্তভাবে পালন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ (ছবিতে সিডনির সংসদ ভবনের উপর অস্ট্রেলিয়ার লোগো)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/L. Coch
ব্রাজিল
ব্রাজিলের বর্তমান সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে; কোনো রাষ্ট্রীয় গির্জা প্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ সরকারি কর্মকর্তাদের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের ‘‘জোট গঠন বা নির্ভরতা’’ নিষিদ্ধ৷ (ছবিতে ব্রাজিলের কনগ্রেসো নাসিওনাল বা জাতীয় কংগ্রেস, যার দুই কক্ষ হলো সেনেট এবং চেম্বার অফ ডেপুটিজ)৷
ছবি: Voishmel/AFP/Getty Images
চীন
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘‘কোনো সরকারি বিভাগ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নাগরিকদের কোনো ধর্মে বিশ্বাস করতে বা না করতে বাধ্য করতে পারবে না; এছাড়া যে সব নাগরিক কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন অথবা করেন না, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা চলবে না৷’’ (ছবিতে বেইজিং-এর গ্রেট হল অফ দ্য পিপল, যেখানে প্রতিবছর ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/How Hwee Young
ফ্রান্স
ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদকে ফরাসিতে বলা হয় ‘লাইসিতে’৷ ফ্রান্সে ধর্ম ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পরস্পরের থেকে আলাদা রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ একদিকে যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, অপরদিকে সরকারি ক্ষমতাকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে৷ (ছবিতে প্যারিসের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় সম্মেলন)৷
ছবি: picture-alliance/ZB/M. Tödt
জার্মানি
জার্মান সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে, যদিও জার্মানিতে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে পুরোপুরি বিচ্ছেদ নেই৷ সরকারিভাবে স্বীকৃত গির্জাগুলিকে পাবলিক কর্পোরেশনের মর্যাদা দেওয়া হয়, তাদের প্রাপ্য কিছু কিছু কর সরকার আদায় করে দেন – তবে বিনামূল্যে নয়৷ ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয় নয়৷ (ছবিতে বার্লিনের বুন্ডেসটাগ বা জার্মান সংসদ)৷
ছবি: imago/Schöning
জাপান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন দখলদারির সময় ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মার্কিন ধ্যানধারণা জাপানে আরোপিত হয়৷ জাপানের সংবিধানে ধর্মপালনের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করা হয়েছে, অপরদিকে সরকার ধর্মপালনের জন্য কোনোরকম চাপ দিতে পারবেন না, অথবা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে সরকারি অর্থ ব্যয় করতে পারবেন না৷ (ছবিতে টোকিও-র সংসদভবন)৷
ছবি: Reuters
সুইজারল্যান্ড
সুইশ কনফেডারেশনের ফেডারাল সংবিধানে ‘‘ধর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতা’’-র গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে৷ বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে, ‘‘কোনো ব্যক্তিকে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে যোগ দিতে বা অঙ্গ হতে, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বা ধর্মীয় নির্দেশ অনুসরণ করতে বাধ্য করা চলবে না’’৷ (ছবিতে বার্ন শহরের বুন্ডেসহাউস বা ফেডারাল প্যালেস, যেখানে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন বসে)৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Klaunzer
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যের চার্চ অফ ইংল্যান্ডের প্রধান হলেন ব্রিটিশ নৃপতি স্বয়ং, তিনিই গির্জার উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করেন৷ হাউস অফ লর্ডস-এও ২৬ জন বিশপের আসন আছে৷ সব সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ সীমিত, যুক্তরাজ্যে সরকারি শাসনও অপেক্ষাকৃতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ৷ ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধান অনুযায়ী অপরাপর ধর্মীয় গোষ্ঠীও ব্যাপক স্বাধীনতা উপভোগ করে৷ (ছবিতে প্যালেস অফ ওয়েস্টমিনস্টার)৷
ছবি: Mohammad Karimi
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
গির্জা ও রাষ্ট্রের বিচ্ছেদ সম্পর্কে জেফারসনের প্রখ্যাত উক্তি মার্কিন সংবিধানে উল্লিখিত নেই৷ ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্টে বলা হয়েছে যে, ‘‘(মার্কিন) কংগ্রেস কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে, বা মুক্তভাবে ধর্মপালন নিষিদ্ধ করে কোনো আইন প্রণয়ন করবে না’’৷ (ছবিতে ক্যাপিটল হিল-এ মার্কিন কংগ্রেসের আসন)৷