ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন রাষ্ট্রপতির কাছে৷ তা তিনি করবেন কিনা এখনো স্পষ্ট নয়৷ এর আগে তার স্বজনরা প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি নাকচ করলেও সোমবার তার ছেলে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি৷
বিজ্ঞাপন
এদিকে আইনজ্ঞরা বলেছেন এখন কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা সরকারের দায়িত্ব৷
কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তার বাবা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা তা তারা এখনো জানেন না৷ তিনি জানিয়েছেন কাদের মোল্লা পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ছেন৷ মঙ্গলবার তিনি এ নিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলবেন, তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন৷ তবে ১৭ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর হাসান জামিল বলেছিলেন, তার বাবা প্রাণভিক্ষা চাইবে না৷
কারা মহাপরিদর্শক মঈন উদ্দিন খন্দকার জানিয়েছেন তারা কাদের মোল্লাকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শুনিয়েছেন৷ এখন জানতে চাইবেন যে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা৷ চাইলে তার আবেদন নিয়মানুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে৷ তিনি জানান মৃত্যু পরোয়ানা পাওয়ার পর তারা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন৷
আর সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম ডয়চে ভেলেকে জানান কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা এখন সরকারের দায়িত্ব৷ কিছু প্রস্তুতির জন্য দণ্ড কার্যকর এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র৷ কারণ এখানে আদালতের আর কোনো কাজ নেই৷ তিনি বলেন মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী সর্বশেষ আদালতের রায় কার্যকর করাই এখন সরকারের কাজ৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও বলেছেন সরকার চাইলে এখন যে-কোনো সময় কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করতে পারে৷ তিনি বলেন এই রায়ের বিরুদ্ধে কোনো রিভিউয়ের সুযোগ নেই৷ আর এখানে জেলকোডের বিধানও কার্যকর নয়৷ কারণ এই আইনের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধি বা সংবিধানের অন্যকোনো বিধান কার্যকর নয়৷ এখন তাই সরকার যেদিন বলবে সেদিনই ফাঁসি কার্যকর হবে৷ আর জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এধরণের অপরাধীদের ক্ষমা করতে পারেন না৷ কিন্তু কেউ প্রাণভিক্ষা চাইলে চাইতে পারেন৷
তবে কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল দাবি করেছেন সরকার তড়িঘড়ি করে রায় কার্যকর করতে চাইছে৷ আইনি প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ না করে তারা রায় কার্যকরের বিরোধিতা করেন৷ এটি একটি ভুল রায় তাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার পুনর্বিচার দাবি করেন তিনি৷ কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকও মনে করেন রিভিউয়ের সুযোগ দেয়া না হলে আইনি প্রক্রিয়া শেষ হবে না৷
এদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী সোমবারের পর মঙ্গলবারও সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে৷ অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম আশঙ্কা করেন জামায়াত এই রায় কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে বড় ধরণের নাশকতার ঘটনা ঘটাতে পারে৷