রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারের অভিযোগে করা মামলায় মঙ্গলবার কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ভূঁইয়া, ব্যবসায়ী মুশতাক আহমেদকে গ্রেপ্তারের পর বুধবার আটক করা হয় মিনহাজ মান্নানকে।
বিজ্ঞাপন
বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকম জানায়, বিএলআই সিকিউরিটিজের কর্ণধার মিনহাজ মান্নান ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের একজন পরিচালক। মিনহাজের ভাই ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানকে ২০১৬ সালে জঙ্গিরা হত্যা করেছিল।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন এখনো পড়ে আছে ব্রিটিশ আমলে
ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংক্রান্ত যেসব আইন তৈরি হয়েছে, এবং এখনো বলবৎ আছে, তাতে কী বলা হয়েছে৷ ছবিঘরে জেনে নিন কিছু আশ্চর্য আইনের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার কয়েকটি কিছুটা সংশোধিত আকারে আজও রয়ে গেছে৷ যেমন: ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩৷ এ আইন অনুযায়ী, যে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের আগে জেলার ডেপুটি কমিশনারের লিখিত অনুমোদন লাগবে৷ এটি ১৮২৩ সালে ভারতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত গর্ভনর জেনারেল জন অ্যাডামের অধ্যাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
দণ্ডবিধি ১৮৬০
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ‘১২৪ ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে, তার তিন বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানার বিধান রয়েছে৷ এটি একেবারেই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন৷ একই আইনের ‘৫০৫ খ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো প্রতিবেদন বা বিবৃতি যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তাকে ৭ বছর কারাভোগ করতে হবে৷ একইভাবে মানহানির জন্য ৪৯৯ এবং ৫০১ অনুচ্ছেদে শাস্তির বিধান রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪
বাংলাদেশের অবাধ তথ্যের প্রবাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হল অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন বা স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪৷ প্রথমটিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা যেতে পারে এমন কোনো বিষয় কাউকে দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷ দ্বিতীয় আইনে রাষ্ট্রের চোখে অনিষ্টকর কোনো তথ্য গণমাধ্যমে কেউ প্রকাশ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’র কথা বলা হয়েছে৷ অথচ ৩৯(২)-এ এই স্বাধীনতা আইনের দ্বারা আরোপিত ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষেই’ নিশ্চিত হবে বলা হয়েছে৷ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে অথবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে এই বাধা-নিষেধের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Jaspersen
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা
২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে কোনো ব্যক্তি যদি ইন্টারনেটে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যার দ্বারা কারো মানহানি ঘটে, কিংবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, বা এ ধরনের তথ্য কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে দেয়া হয়, তাহলে এটি অপরাধ এবং সেই অপরাধে ৭ থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: Schlierner - Fotolia.com
ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারা
এ আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ৷
ছবি: Badruddoza Babu
৩২ ধারায় শাস্তি
এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে৷ কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে৷
ছবি: Imago/IPON
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯
এই আইনটি বাক স্বাধীনতার পক্ষে৷ বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে৷’’ আরো বলা হয়েছে, ‘‘তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সহিত সাংঘর্ষিক হইলে, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/Dinodia Photo Library
8 ছবি1 | 8
আসুন আমরা খবরটিকে বিশ্লেষণ করি৷ মানে, যা বলা হয়েছে, যা আমাদের জানানো হয়েছে তা ধরে এগোই৷ আমার একজন সহকর্মী আমাকে তাদের বিরুদ্ধে করা এজাহারের কপি দিয়েছেন৷ রেফারেন্স হিসেবে সেটাও পাশে রাখলাম৷
শুরুতে আমরা অভিযোগটি দেখি আর তা হলো রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার৷ এরকম একটি অভিযোগই বলে দেয়, সরকার কাজটিকে খারাপ মনে করে বলে এর বিরুদ্ধে তরতাজা একটি আইনও করেছে৷ তার মানে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার হোক সেটি তারা চায় না৷ তাই সরকার বা তার র্যাব তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে, ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে৷
কিন্তু যে কেউই চোখ মেলে বা সামান্য পর্যবেক্ষেণে দেখবেন যে, এদের গ্রেপ্তার করার ফলে যে পরিমাণ রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার পেয়েছে তার ভগ্নাংশও এতদিন ধরে অর্জিত হয় নাই৷ সেইটা গ্রেপ্তার কার্টুনিস্ট কিশোরের কার্টুন বা অভিযুক্তদের আরো যেসব কনটেন্ট সামাজিক মাধ্যমে এর মধ্যেই শেয়ার হয়েছে তার পরিমাণ দেখেই বলে দেওয়া যায়৷ আরো একটি বিষয় হলো, সরকার যতবার এই মান-মর্যাদা রক্ষা জাতীয় বিষয়ে ডিজিটাল আইনে মোকদ্দমা করে বা এরে তারে জেলে পাঠায়, ততবার দেশে-বিদেশে এই রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার বেশি শুনতে, দেখতে আর মানতে দেখা যায়৷ এমনকি তখন তা আর প্রচার থাকে না ,বরং তা-ই হয়ে দাঁড়ায় পরিচয়৷ ডিজিটাল আইনে এই গ্রেপ্তারকাণ্ডের পর যে শব্দগুলো বেশি শুনছি তার মধ্য থেকে তিনটি এরকম- নিপীড়ক, নিপীড়ক এবং নিপীড়ক৷
আসুন এবার আমরা কারণ বিশ্লেষণ করি৷ এ কাজ করে যে, রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার থামে না, বরং বাড়ে, সেটা কি আমাদের বুদ্ধিমান এলিট ফোর্স র্যাব বা তাদের কর্তারা জানে না, বুঝতে পারে না? আমরা কেউ কেউ মজা নেই বা দুঃখ পাই এই বলে যে, আহারে উহারা কী বোকা!
জ্বি না ম্যাডাম/স্যার ওরা বোকা নন৷ ওরা জানেন, আমরা এরকম আচরণ নিয়ে অনেক সমালোচনা করবো, আমাদের কল্পিত দাঁত-নখ নিয়ে বাঘের ছবির উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো প্রবল বীরত্বে৷ অতীতেও আমরা এরকমটাই করেছি৷ কিন্তু তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না৷ তারা বড়জোর বলবেন, কাজ করলে একটু-আধটু ওরকম শুনতে হয়, অত ধরলে চলে?
তারপর ডিজিটাল অপরাধীরা জেলে থেকে যাবেন৷ রোমহর্হষক অনেক তথ্য় দেবেন সেইসব আউট ল'রা৷ তাদের দেওয়া তথ্যে দেশ জাতি রাষ্ট্র বেঁচে যাবে৷ পদক বা প্রমোশন পাবেন কঠিন এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎকারীরা৷ হয়ত কয়েক দিন. মাস বা বছর পর তারা একসময় বেরিয়ে আসবেন৷ তখন অন্য কোনো প্রবল ইস্যু না থাকলে টিভি ক্যামেরা থাকবে সামনে গোটাকয়৷ দর্শক জানবেন, তারা ক্লান্ত, কয়টা দিন পরিবারের সঙ্গে থাকতে চান৷
আর সবাই শিক্ষা পাবেন৷ কমে যাবে আরো কার্টুনের সম্ভাবনা৷ কেউ কেউ আগে থেকেই বুদ্ধিমান৷ যেমন শিশির ভট্টাচার্য৷ তিনি কার্টুন আঁকা ছেড়েছেন, অন্তত প্রথম আলোতে তার কার্টুন দেখি না অনেকদিন৷ এর জন্য প্রথম আলোর প্রচার সংখ্যা কমেছে এরকম তো শুনি নাই৷ শুধু ওই পত্রিকা কেন কোনো পত্রিকারই প্রচার সংখ্যা দেশে কমেছে এরকম শুনি নাই৷ সব পত্রিকারই প্রচার সংখ্যা বেড়েছে৷ বেড়েছে পত্রিকার সংখ্যাও৷ অন্তত তথ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া নথি তো তাই বলে৷ কারণ, সেখানে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার থাকে না৷ সেগুলো আমাদের জন্য ক্ষতিকর না৷
সকলের শিক্ষা সম্পন্ন হোক, আর রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার না হোক, সব কিছু মেনে নেওয়ার শক্তি হোক৷