একজন খুন হওয়ার পর, আসামী গ্রেপ্তারের আগেই খুন হচ্ছেন আরেকজন৷ এমন পরিস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতিকেই দায়ী করছেন সবাই৷ সর্বশেষ ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত চলছে এখনও৷
বিজ্ঞাপন
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রীয় নির্লিপ্ততা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আমি অদক্ষ বলবো না৷ তারা তো অনেক ভালো কাজ করছে! তাই কেন তারা ব্লগার হত্যাকারীদের ধরছে না – সেটা আমারও প্রশ্ন৷ তবে রাষ্ট্রযন্ত্র যদি ব্লগার হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে আন্তরিক হতো, তাহলে অবশ্যই খুনিরা ধরা পড়ত৷ রাষ্ট্রযন্ত্রের আন্তরিকতা তো দূরে থাক, উল্টো তারা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে আপস করে৷ কখনও কখনও বৈঠকও করে৷ তাহলে এরা উৎসাহী হয়ে হত্যাকাণ্ড তো ঘটাবেই৷''
পরপর কয়েকজন ব্লগার হত্যাকাণ্ডের পর এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতত্ত্ববিদ ড. হুমায়ুন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদকে ক্রমাগত হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে মৌলবাদী জঙ্গিরা৷ তিন সপ্তাহ আগে থেকে তাঁর ফেসবুক আইডিতে এ হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে৷ সর্বশেষ, ২২শে মে দুপুরে অকথ্য ভাষায় অনন্য আজাদকে গালিগালাজ করা হয় এবং তাঁর মাথা কেটে রাজু ভাস্কর্যে ঝুলিয়ে রাখার হুমকি দেওয়া হয়৷ এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটেনের দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান' গত ২৮শে মে ‘বাংলাদেশ ব্লগার নেমড অন হিটলিস্ট ওয়ার্নড: ইউ উইল বি নেক্সট' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ এরপর গত ৩০শে মে ভারতের দৈনিক ‘দ্যা টাইমস অফ ইন্ডিয়া' প্রায় একই শিরোনাম করে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ, বিচারের দাবি
বইমেলা থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাতে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ব্লগার অভিজিৎ রায়৷ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিতকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷
ছবি: DW
যেখানে হামলার শিকার অভিজিৎ, বন্যা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার ফুটপাথ৷ লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের নিহত হবার এই জায়গাটা নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ হামলায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন৷
ছবি: DW
বেঁচে গেছেন বন্যা
হামলার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা৷ দুষ্কৃতিকারীরা তাঁকে কুপিয়ে জখম করলেও প্রাণে বেঁচে যান অ্যামেরিকায় বসবাসকারী এই ব্লগার৷ বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি৷
ছবি: DW
নির্বাক অজয় রায়
ছেলের মৃত্যুর খবরে নির্বাক নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়৷ আজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন৷
ড. হুমায়ুন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদও তাঁর বাবার অনুসারী৷ তিনিও ধর্মীয় উগ্রপন্থার কট্টর সমালোচক৷ এদিকে, যে ৮৪ জন ব্লগারকে হত্যার তালিকা তৈরি করা হয়েছে, সে তালিকায় অনন্য আজাদের নাম রয়েছে৷ উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে এক দল ধর্মীয় মৌলবাদী ৮৪ জনের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করে তাদের শাস্তি দেওয়ার দাবি জানায়৷ এ পর্যন্ত যতজন ব্লগার খুন হয়েছেন, তাঁদের সবাই এই ৮৪ জনের তালিকায় ছিলেন৷ সর্বশেষ গত ১২ই মে অনন্ত বিজয় দাস নামে মুক্তচিন্তার এক ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখককে সিলেটে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ তিনি হচ্ছেন চতুর্থ ব্যক্তি, যাঁকে একই কায়দায় রাস্তায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ ২০১৩ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি প্রথম আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে হত্যা করা হয়েছিল৷
অনন্য আজাদ গার্ডিয়ানকে জানান, ‘‘গত মার্চ মাসে ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যার পর অনেকেই আমাকে লেখালেখি থেকে বিরত থাকতে বলেছেন৷ কিন্তু আমি লেখালেখি বন্ধ করব না৷'' এ ঘটনায় থানায় জিডি করেছেন কিনা জানতে চাইলে অনন্য আজাদ বলেন, ‘‘না, এ দেশে জিডি করে কিছু হয় না৷ তাছাড়া নিজের নিরাপত্তার জন্য আমি মোটেই চিন্তিত নই৷'' তিনি জানান, তিনি তাঁর লেখা চালিয়ে যাবেন এবং এ হুমকির কারণে মোটেই ভীত নন তিনি৷
ধর্মীয় মৌলবাদের সমালোচনা করায় এর আগে চারজন ব্লগারকে হত্যা করা হয় বাংলাদেশে৷ তাই বর্তমানে অনেক ব্লগারই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন৷ ধর্মীয় মৌলবাদীদের দেয়া ৮৪ জনের তালিকায় থাকা একজন ব্লগার সোমবার ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ‘‘লেখালেখি তো বন্ধ করা সম্ভব নয়, রক্তের সঙ্গে এটা মিশে গেছে৷ নিজের ‘আইডি' পরিবর্তন করে লিখছি৷ তবে তারপরও ওরা বুঝে যাবে৷ আসলে সরকার আন্তরিক হলে জঙ্গিরা ভয় পেত৷ কিন্তু সরকারের আন্তরিকতা না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই লেখালেখি করছি৷ কপালে যা আছে, তাই হবে৷''
অপর একজন ব্লগার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সংখ্যা যে বাড়ছে, তা এখন দৃশ্যমান৷ কারণ এর মধ্যে বেশ কয়েকজন জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস সদস্য আটক হয়েছে বাংলাদেশে৷ এর অর্থ, আরো অনেক আইএস সদস্য দেশে আছে৷ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের যখন পুলিশ গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে, তখন আইএস-এ যোগ দেয়ার প্রবণতা ভালো আলামত না৷ উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের সদস্যরা আইএস-এ যোগ দিচ্ছে৷ এর মধ্যে যারা ধরা পড়েছে তাদের একজন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছেলে, আরেকজন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তার ছেলে৷ এতে বোঝা যাচ্ছে, উচ্চ শিক্ষিত পরিবারেও ধর্মীয় উগ্রবাদীতা আছে৷''
‘নাস্তিক ব্লগার’ ইস্যুতে ইসলামি দলের তাণ্ডব
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে কথিত ‘ধর্মনিন্দার’ অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ বাংলাদেশের কয়েক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে বিভিন্ন ইসলামি দল৷ এতে প্রাণহানিসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: Reuters
বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্র
শুক্রবার (২২.০২.১৩) দুপুর বারোটার দিকে বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ ১২টি ইসলামি ও সমমনা দল আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের ভাষায় যেসব ব্লগার ইন্টারনেটে ‘ধর্মনিন্দা’ করে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখছে, তাদের ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আন্দোলন করা হবে৷ কিন্তু সেই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই তাণ্ডবে রূপ নেয়৷ এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘পরিকল্পিত অ্যাকশন’
ঢাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানিয়েছেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবেই সহিংস অ্যাকশনে গেল জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীরা৷ ব্লগে ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত কটূক্তির কথা বলে তাদের ভাষায় ‘মুরতাদ-নাস্তিকদের’ ফাঁসির দাবিতে আগেই শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কর্মসূচি দেয়৷ আর আজ (২২.০২.১৩) জুম্মার নামাজের আগেই তারা তাণ্ডব শুরু করে৷’
ছবি: Reuters
শাহবাগে হামলার চেষ্টা
শুক্রবার (২২.০২.১৩) পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ইসলামি দলের সদস্যরা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোতে চাইলে সংঘর্ষ পল্টন হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ ককটেল, গুলি আর টিয়ার গ্যাসের সেলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ প্রায় একই সময়ে ঢাকার কাঁটাবনে শাহবাগ বিরোধীরা রাস্তায় নামে৷ তারাও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে৷ সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
ঢাকার বাইরে তাণ্ডব, প্রাণহানি
ঢাকার বাইরে চট্টগামের প্রেসক্লাবে হামলা হয়েছে৷ তাদের হামলায় পুলিশ এবং সাংবদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন৷ বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, চাঁদপুরে গণজাগরণ মঞ্চে হামলা চালায় তারা৷ হামলা চালায় সিলেট শহীদ মিনারে৷ সেখানে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ শুক্রবার বিকেল অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, গাইবন্ধায় ২ জন এবং ঝিনাইদহে জাগরণ মঞ্চ বিরোধীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷
ছবি: Reuters
শাহবাগে জনতা
দেশব্যাপী ইসলামি দলগুলোর এই তাণ্ডবের পর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আবারো ভিড় বাড়তে শুরু করেছে৷ ব্লগারদের ডাকে গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে এই চত্বরে অবস্থান করছেন অগুনতি মানুষ৷ তাদের মূল দাবি হচ্ছে, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কট৷’’
ছবি: Reuters
তাণ্ডবের পর নতুন কর্মসূচি
শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার শুক্রবার সন্ধ্যায় জাগরণ মঞ্চ থেকে দাবি করেন, ‘‘আজকের (২২.০২.১৩) হামলায় উস্কানি দিয়েছে জামায়াত শিবিরের পত্রিকা আমার দেশ৷ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর সম্পাদক মাহামুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে৷ তা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া হবে৷’’ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: Reuters
ইন্টারনেটে সতর্ক দৃষ্টি
‘ধর্মীয় ভাবমূর্তিতে আঘাত হানছে’ এরকম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট খুঁজে খুঁজে বন্ধ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ ইতোমধ্যে কমপক্ষে দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ এবং দশটি ব্লগ পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে৷ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এই তথ্য জানিয়েছেন টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি'র ভাইস-চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
রোববার হরতাল
শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর পর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ ১২টি ইসলামি দল৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে৷ পুলিশ আন্তরিকতা নিয়ে তদন্ত কাজ করছে৷ মনে রাখতে হবে, এই হত্যাকাণ্ডগুলো অন্য হত্যাকাণ্ডগুলোর মতো না৷ জঙ্গিদের যারা খুন করতে আসে তারা ধর্মীয়ভাবে অন্ধ! ফলে অন্যদের ব্যাপারে কোনো তথ্যই দিতে পারে না৷ এ জন্যই এদের মূল ‘চেইন' খুঁজে বের করতে সময় লাগছে৷ তবে কেউই ধরাছোয়ার বাইরে থাকবে না৷''
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ব্যানারে জঙ্গিরা একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছিল৷ এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ করায় এখন ভিন্ন নামে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে৷ আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থা নিয়েছি৷''
তাই শিগগিরই এদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন মনিরুল ইসলাম৷