মানবিকতা ঝুলে থাকে কাঁটাতারে!
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬![An der Grenze zwischen Indien und Bangladesch](https://static.dw.com/image/18691323_800.webp)
ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কেন অমন নির্মমভাবে তাকে গুলি করে মেরেছিল? কী দোষ ছিল ফেলানীর? এ সব প্রশ্নেরও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি৷ অথচ ফেলানী কিন্তু কোনো সন্ত্রাসবাদী নয়৷ ভারত সীমান্তে কোনো নাশকতা করে সে গা ঢাকা দিচ্ছিল না৷ পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশে যাওয়াটা যদি অপরাধ হয়, একমাত্র সেই অপরাধটুকু করেছিল ফেলানী, তার পরিবার৷ কিন্তু সেদিন, ২০১১ সালের সেই ৭ জানুয়ারি ফেলানী প্রতিবেশী দেশটিতে অনুপ্রবেশ করছিল না৷ বরং সে তার বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল৷ নিজের দেশে ফিরছিল৷ কারণ আদরের মেয়ের বিয়ের ঠিক করেছিলেন বাবা নূর ইসলাম৷
নূর ইসলাম মই বেয়ে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া টপকে ওদিকে চলে গিয়েছিলেন, পিছনেই ছিল ফেলানী৷ কিন্তু বেড়া টপকাবার সময় তার জামার একটা অংশ আটকে গিয়েছিল কাঁটাতারে৷ ভয় পেয়ে চীৎকার শুরু করেছিল ফেলানী, সচকিত হয়েছিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা এবং গুলি চালিয়েছিল৷ বুকে গুলি লেগেছিল ফেলানীর, কিন্তু তখনই সে মরেনি৷ অনেকক্ষণ ঝুলে ছিল ওইভাবে এবং কাতর গলায় ‘জল', ‘জল' করে চেঁচিয়েছিল৷ অথচ মরার আগে পর্যন্ত কেউ তার তেষ্টা মেটায়নি৷ মরে যাওয়ার পরেও ওভাবেই ঝুলে ছিল সে৷ ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা শিকারের ‘ট্রোফি' সাজিয়ে রাখার মতো করে ঝুলিয়ে রেখেছিল মৃত ফেলানীকে, নিজেদের পরাক্রমের প্রমাণ হিসেবে৷
ফেলানীর ছবি সংবাদমাধ্যম মারফত দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর নিন্দা-সমালোচনার ঝড় উঠেছিল দিকে দিকে৷ মামলা হয়েছিল, অভিযুক্ত হয়েছিল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷ ফেলানীর বাবা এবং কাকা কুচবিহারে গিয়ে সেই মামলায় সাক্ষ্যও দিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু ন্যায়বিচার পাননি৷ অভিযুক্ত বিএসএফ কনস্টেবল অমিয় ঘোষ বেকসুর রেহাই পেয়ে যান, তাঁর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকার যুক্তিতে৷ পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ, সংক্ষেপে ‘মাসুম' নামে একটি সংগঠন এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে মামলা করে, যে আইনি লড়াই এখন ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে পৌঁছেছে৷ কিন্তু সেখানে মামলাটি গৃহীত হলেও শুনানির দিন আর আসছে না, জানালেন এই মাসুম সংগঠনের তরফে কিরীটি রায়৷ আর একা ফেলানী নয়, সীমান্তে রক্ষীবাহিনীর নিগ্রহ এবং সন্ত্রাসের এরকম একাধিক ঘটনায় তাঁরা আইনি প্রতিরোধের রাস্তা নিয়েছেন৷ কিন্তু সবই আটকে আছে বিচারব্যবস্থার চিরাচরিত দীর্ঘসূত্রিতায়৷
আর ফেলানী খাতুনদের মতো অসংখ্য মানুষের, অগণিত পরিবারের যে সমস্যা? যারা সীমান্ত বোঝে না, বোঝে শুধু পেটের খিদে, জীবিকার খোঁজ? অপরাধ করতে ভালোবাসে বলে যারা অনুপ্রবেশ করে না, জীবিকার তাগিদে যারা চলে আসে এক দেশ থেকে অন্য দেশে এবং প্রতিদিন নিগৃহীত হয়, শোষিত, অত্যাচারিত হয়, আর তার পর এভাবেই হয়ত একদিন বেঘোরে মারা যায়? তাদের এই মৌলিক সমস্যাটার সমাধানের কি কোনো চেষ্টা হচ্ছে? কিরীটি রায় জানালেন, প্রায় প্রতিমাসেই সীমান্তে এ ধরনের অত্যাচারের ঘটনা ঘটছে এবং তাঁরা প্রতিবাদ করছেন৷ কিন্তু প্রতিবাদই সার, বিচার মিলছে না৷
ফেলানীর বাবা নূর ইসলামের গলাতেও সেই একই হতাশা৷ তাঁর মেয়েটাকে ওভাবে গুলি করে মেরে ফেলা হলো, অথচ একটা ন্যায়বিচার হল না৷ পাঁচ বছর আগের ঘটনা, তবু মেয়ের কথা বলতে গিয়ে এখনও কান্নায় ধরে আসে তাঁর গলা৷ প্রশ্ন করেন, বলুন, আমি কেন বিচার পাব না? আমার মেয়েটা কেন বিচার পাবে না? শুনতে শুনতে মনে হয়, সত্যি কি সম্ভব ছিল না কন্যাহারা এক পিতার প্রতি সামান্যতম সহানুভূতি দেখানো? মানুষ বড় হয় কীসে? তার মহত্বে৷ একটা দেশ বিরাটত্ব প্রমাণ করতে পারে কীসে? মহানুভবতায়, ন্যায়নিষ্ঠতায়৷ তা হলে ফেলানীরা বিচার পায় না কেন? কেনই বা নিরন্ন মানুষের চুপসে যাওয়া পেটে লাথি কষায় ফৌজি বুট?
সত্যিই তো, ফেলানীরা বিচার পায় না কেন? আমরা আপনার মতামত জানতে চাই...