সিরিয়া সরকার নাকি আবার রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এমনটা করলে বাশার আল আসাদ ও তাঁর বাহিনীকে বড় মূল্য দিতে হবে বলে হুমকি দিলো ট্রাম্প প্রশাসন৷
বিজ্ঞাপন
গত ৪ঠা এপ্রিল সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র হামলার আগে যেমন প্রস্তুতি চোখে পড়েছিল, এখনও সেরকম আভাস পাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন৷ বিরোধী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব প্রদেশে খান শেখউন শহরে সেই হামলায় কমপক্ষে ৮৭ জন নিহত হয়েছিল৷ তবে আসাদ সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে৷ প্রেসিডেন্ট আসাদ স্বয়ং এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এপ্রিল মাসের এই হামলার অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা৷
সেবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ার বিমানবাহিনীর শায়রাত নামের এক ঘাঁটির উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ উল্লেখ্য, সিরিয়ায় প্রায় ৬ বছরের সংঘর্ষে এই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করে৷
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র শন স্পাইসার সোমবার বলেন, আসাদ প্রশাসনের সম্ভাব্য হামলায় বেসামরিক মানুষ, এমনকি শিশুদেরও প্রাণহানি ঘটতে পারে৷ তবে এ সংক্রান্ত গোপন তথ্য বা অ্যামেরিকার পালটা পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি৷ স্পাইসার আরও বলেন, সিরিয়া ও ইরাকে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে মার্কিন প্রশাসন সিরিয়ায় সক্রিয় রয়েছে৷ মার্কিন নেতৃত্বে কোয়ালিশন বাহিনী রাকা শহর থেকে আইএস-কে উৎখাত করতে অভিযান চালাচ্ছে৷
কিছু সূত্র অনুযায়ী, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলির ধারণা, আসাদ প্রশাসন সম্ভবত সদ্য তৈরি রাসায়নিক অস্ত্র ইনস্পেক্টরদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে৷ সামরিক স্থাপনায় অস্বাভাবিক গতিবিধির কারণে আসন্ন হামলার আশঙ্কা দানা বাঁধছে৷ মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস বলেছেন, সিরিয়ার হাতে কিছু রাসায়নিক অস্ত্র এসেছে – এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ এমনকি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাগুলিও মনে করে, আসাদ প্রশাসনের হাতে কয়েক টন রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে৷
জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হেলি এক টুইট বার্তায় আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, সিরিয়ার জনগণের উপর আরও হামলা হলে শুধু আসাদ নয়, তাদের মদতকারী রাশিয়া ও ইরানকেও দায়ী করা হবে৷
মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ২০১১ সালের সেই আরব বসন্তের জেরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়৷ গত ছয় বছরে সেই সংঘাতের বিস্তৃতি অনেক বেড়েছে, যোগ হয়েছে নতুন মিত্র, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো শত্রুতা৷
আসাদের প্রতি অনুগতরা
সিরিয়ার সেনাবাহিনী, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ান আরব আর্মি (এসএএ) হিসেবে পরিচিত, ২০১১ সালের শরতে তারা বড় এক জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়৷ সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করে আসাদ বিরোধী ‘অ্যান্টি-আসাদ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷ তবে এসএএকে ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সসহ আসাদপন্থি বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ সমর্থন দিচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/V. Sharifulin
মডারেট দল
আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ সহিংস রূপ নিলে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়৷ জিহাদি নয়, এমন বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে মিলে তারা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে লড়াই করছে৷ উদ্দেশ্য হচ্ছে, সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক পথে সরকার গঠন করা৷ তবে বেশ কয়েকটি লড়াইয়ে হারার পর সেই দলের অনেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে চলে যায়৷
ছবি: Reuters
সন্ত্রাসের নতুন রূপ
সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সে দেশ এবং ইরাকের একটা বড় অংশ দখল করে নিজেদের তথাকথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস)’৷ নিজের কালো পতাকাতলে ইসলামের উগ্রতম রূপ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসংখ্য মানুষকে অত্যাচর এবং হত্যা করেছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷ রাকা শহরে গোষ্ঠীটি শক্ত অবস্থান গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এক পুরনো জিহাদ
তবে আইএসই সিরিয়ায় অবস্থান নেয়া একমাত্র জঙ্গি গোষ্ঠী নয়৷ আল-কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত আল-নুসরা ফ্রন্টসহ আরো কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী সিরিয়ায় লড়ছে৷ আল-নুসরা ফ্রন্ট নিজেদের মধ্যে লড়াই ছাড়াও আসাদ এবং মডারেট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে৷ সম্প্রতি জঙ্গি গোষ্ঠীটি সমমনা আরো কয়েকটি গোষ্ঠীকে নিয়ে জোট গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Nusra Front on Twitter
আসাদের এক শক্তিশালী মিত্র
প্রেসিডেন্ট আসাদের শক্তিশালী মিত্র ক্রেমলিন৷ সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে কয়েকবছর ধরে রসদ সরবরাহের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়া সংঘাতে যোগ দেয় রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী৷ তবে রাশিয়ার বিমান হামলায় অনেক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে মাঝেমাঝেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়ে মস্কো৷
ছবি: picture-alliance/AP/Russian Defense Ministry
অনাগ্রহী পশ্চিম
আসাদের সমালোচনা এবং নীরবে মডারেট বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন জানালেও তাদের হয়ে আসাদের বিরুদ্ধে লড়তে পদাতিক বাহিনী পাঠাতে আগ্রহী নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো ন্যাটোভুক্ত দেশ৷ তবে ২০১৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রায় ষাটটি দেশের মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক জোট সে দেশে ইসলামিক স্টেট এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর আস্তানায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images/John Macdougall
সীমান্তে নিরাপত্তা
সিরিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলো নিজেদের সীমান্ত রক্ষার স্বার্থেই এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে৷ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী জোটে থাকা তুরস্কও আসাদবিরোধী জোটকে সহায়তা করছে৷ তবে কুর্দি যোদ্ধাদের মার্কিনিদের সহায়তা নিয়ে সে দেশের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে তুরস্কের, কেননা কুর্দরা নিজেদের রাষ্ট্র চায়, যা তুরস্ক সমর্থন করে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/S. Suna
প্রক্সি ওয়ার
সিরিয়ার সংঘাতে কার্যত এক প্রক্সি লড়াইও চলছে, যেখানে একদিকে রয়েছে রাশিয়া এবং ইরান, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক৷ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায় ইরান৷ ফলে রাশিয়ার পাশাপাশি সে দেশও কৌশলগত সহায়তা, সামরিক প্রশিক্ষণ, এবং পদাতিক সেনা দিয়ে দামেস্ককে সহায়তা করছে৷
ছবি: Atta Kenare/AFP/Getty Images
যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই
ছয় বছর হয়ে গেলেও সিরিয়ায় বহুমুখী লড়াই বন্ধের কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না৷ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তৈরি বিভিন্ন শান্তি চুক্তি করা হলেও তা তেমন একটা সফল হয়নি৷ ফলে প্রতিদিন সে দেশে নানা হামলায় মারা যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে শিশু, নারীসহ অনেক বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন৷