রিকশামুক্ত ঢাকা: সিদ্ধান্ত যৌক্তিক কিন্তু পরিকল্পনার অভাব
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৯ জুলাই ২০১৯
যানজটে নাকাল নগরবাসীকে মুক্তি দিতে রিকশা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন৷ আর নগরবাসীকে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হাঁটার অভ্যাস গড়ার পরামর্শ দিয়েছে শহররে উত্তর সিটি করপোরেশন৷
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, পর্যায়ক্রমে ঢাকা মহানগরীকে পুরোপুরি রিকশামুক্ত করা হবে। উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে।''
৭ জুলাই থেকে কুড়িল-বাড্ডা-রামপুরা-মালিবাগ রেলগেট-খিলগাঁও রেলগেট-মানিকনগর-সায়েদাবাদ, গাবতলী-আসাদগেট-সায়েন্সল্যাব-আজিমপুর এবং সায়েন্সল্যাব- শাহবাগ পর্যন্ত রিকশা চলাচল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে দুই নগরপিতা৷
প্রতিবাদে গত দু'দিন ধরে রিকশা চালকরা বাড্ডা ও রামরপুরাসহ কয়েকটি এলাকায় সড়ক অবরোধ করেছেন। জাতীয় রিকশা ভ্যান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইনসুর আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় দেড় লাখ রিকশা চালক বেকার হয়ে যাবে। আমরা বলেছি, রিকশা বন্ধ না করে অবৈধ রিকশা উচ্ছেদ করা হোক।''
রিকশা চালকদের এই নেতা জানান, ঢাকায় ১০ লাখে মধ্যে বৈধতা আছে দুই লাখের কিছু বেশি রিকশার৷
শিক্ষার্থী, নারী ও শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য আমরা বিকল্প চিন্তা করছি: আতিকুল ইসলাম
এ প্রসঙ্গে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ''ঢাকা শহরে মোট সড়কের পরিমান ২০ হাজার কিলোমিটারের বেশি। আর দুই সিটি করপোরেশন মিলে মাত্র ২০ কিলোমিটার এলকায় রিকশা চলাচাল বন্ধ করেছি৷ ভেতরের সড়কে রিকশা চলবে। তাই রিকশাচালকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।''
রিকশা বন্ধের ঘোষণায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সাধারণ মানুষেরা৷ বিশেষ করে শিক্ষার্থী, রোগী, প্রতিবন্ধী এবং নারীরা বিরূপ এমন সিদ্ধান্তে কিছুটা ক্ষুব্ধ৷
আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘শিক্ষার্থী, নারী ও শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য আমরা বিকল্প চিন্তা করছি। আমরা স্কুল বাস চালু করব। নারীদের বাসের কথা চিন্তা করছি। আমাদের ভালো কিছু পেতে হলে কিছুটা ত্যাগ করতে হবে। ফুটপাথগুলো ঠিক করছি। হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে।'
দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘‘রিকশার বিকল্প হিসেবে এখন রাইড শেয়রিং সেবা পাঠাও , উবার আছে। আমরা সার্কুলার বাস চালু করেছি। আমরা বাস মালিক সমিতিকে বলেছি, যেখানে প্রয়োজন সেখানে পর্যাপ্ত বাস সার্ভিস নিশ্চিত করবো। প্রয়োজনে নাগরিকদের চাহিদা অনুযায়ী স্টপেজ বাড়ানো হবে। স্কুল ভ্যানগুলোকে আমরা চলাচলের অনুমতি দিচ্ছি। আর শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্যতো বাস আসে। ভালো কোনো সাজেশন থাকলে তাও আমরা গ্রহণ করবো।''
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ''আমরা ধীরে ধীরে ঢাকা শহর থেকে রিকশা তুলে দেব। ঢাকায় কোনো রিকশা থাকবেনা। এজন্য সময় লাগবে। তারই প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি।''
রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে রিকশা তুলে দেয়ার এই সিদ্ধান্তকে ‘যৌক্তিক' মনে করছেন নগর পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক৷ তবে তাঁর দাবি, এই সিদ্ধান্ত হুট করে নেয়া হয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘‘২০০৫ সাল থেকে কৌশলগত পরিকল্পনায় ছিলো প্রধান সড়ক থেকে রিকশা তুলে দেয়া। রিকশা আর বাস একই সড়কে চলবেনা। নগরবাসী ভেতরের সড়কে রিকশা ব্যবহার করে বাস স্ট্যান্ডে আসবেন। কিন্তু এরজন্য পরিকল্পনা দরকার। কোলকাতা শহরে এটা দু'বছরে করা হয়েছে। প্রচার চালানো হয়েছে । রিকশাচালকদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে।''
প্রথম পর্যায়ে রিকশার সংখ্যা কমিয়ে আনা দরকার ছিলো মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ৷ তিনি মনে করেন, নারীসহ আরো যারা বাসের পরিবর্তে রিকশা পছন্দ করেন তাদের আগে তৈরি করা উচিত৷
এদিকে, মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে মহাসড়কে ধীর গতির যান চলাচলে আলাদা লেন তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
ঢাকার রাস্তায় ‘মেয়ে’র অন্যরকম রংবাজি
নারীর অবমাননা, নির্যাতন আর ধর্ষণের বিরুদ্ধে তুলি ধরেছে ‘মেয়ে’৷ ঢাকার রাস্তায় শুরু করেছে ‘রংবাজি’৷ সেই রংবাজি ফুটে ওঠে রিকশার পেছনে লেখা নানা কথা আর তুলির আঁচড়ে আঁকা ছবিতে৷
ছবি: Meya online netwark
নারীর ‘রংবাজি’
নারীবান্ধব অনলাইন কমিউনিটি ‘মেয়ে’-র এক উদ্যোগের নাম ‘রংবাজি’৷ ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল ঢাকার এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে হাতে রং-তুলি তুলে নেয় তারা৷ রিকশার পিছনে ফুটে ওঠে সমাজে নির্যাতিত, নিপীড়িত, ধর্ষিত নারীদের মনের কথা৷ রং-তুলির ভাষায় প্রতিবাদের এই উদ্যোগেরই নাম ‘রংবাজি’৷
ছবি: Meya online netwark
‘জোর করে ভালোবাসা যায় না’
মন না পেলে নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ থেকে শুরু করে নানা ধরণের নির্যাতন চালায় এক ধরণের পুরুষ৷ তাদের জন্যই রিকশার পেছনে লিখে দেয়া হয়েছে একটি সহজ সত্যি কথা – ‘জোর করে ভালোবাসা যায় না’৷
ছবি: Meya online netwark
বউয়ের দোয়া
বাংলাদেশে ‘মায়ের দোয়া’ লেখা রিকশার অভাব নেই৷ মা নারী৷ সন্তান অথবা সন্তানতুল্যদের কাছে তিনি সবসময়ই শ্রদ্ধেয়৷ কিন্তু স্ত্রী-ও যে নারী; নারী হিসেবে, আগামী দিনের মা হিসেবে তাঁরও যে সম্মান প্রাপ্য – সে কথা অনেকেরই মনে থাকে না৷ সে কারণেই রিকশার পেছনে ‘মেয়ে’ লিখে দিয়েছে ‘বউয়ের দোয়া’৷ জীবনের শুধু মায়ের নয়, বউয়ের দোয়াও দরকারি৷
ছবি: Meya online netwark
‘ঘরের কাজ ফেলনা নয়, বাইরের কাজ খেলনা নয়’
বাংলাদেশে কর্মজীবী নারী বাড়ছে৷ কিন্তু সমাজের একটি মহল নারীর কর্মসংস্থানের বিরুদ্ধে৷ যেসব নারী ঘরের যাবতীয় কাজ করেন, তাঁরা কিন্তু কাজের স্বীকৃতি পান না৷ ঘরের কাজ যেন কোনো কাজই নয়! আসলে ঘরে এবং বাইরে নারীদের কাজের মর্যাদা দেয়ার বিষয়টি অনেক পুরুষই এখনো গুরুত্ব দেয় না৷ গৃহকর্মে সুনিপুনা এবং কর্মজীবী নারীদের হয়ে তাই সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে ‘ঘরের কাজ ফেলনা নয়, বাইরের কাজ খেলনা নয়’৷
ছবি: Meya online netwark
‘নজর সামলে রাখুন’
তথাকথিত ‘শালীন’ পোশাক পরে না, শালীনতা বজায় রেখে চলাফেরা করে না বলেই নারী ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার – এমন অদ্ভুত যুক্তির প্রবক্তা এবং অনুসারীদের প্রতি ‘মেয়ে’র পরামর্শ, ‘নজর সামলে রাখুন’৷
ছবি: Meya online netwark
‘লজ্জা ধর্ষকের, ধর্ষিতের নয়’
অন্যায়কারীরই লজ্জিত হওয়া উচিত, যিনি অন্যায়ের শিকার তাঁর আবার লজ্জা কিসের? ধর্ষণ প্রসঙ্গে সবাইকে এই কথাটা মনে করিয়ে দিতেই ‘রংবাজি’-র একটি উদ্যোগের স্লোগান, ‘লজ্জা ধর্ষকের, ধর্ষিতের নয়’৷
ছবি: Meya online netwark
অন্যায়ের প্রতিবাদে নারী-পুরুষ
সব অন্যায় রোধেই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ দরকার৷ নারীর বিরুদ্ধে সব ধরণের অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধেও তাই পুরুষদেরও নারীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ‘মেয়ে’৷
ছবি: Meya online netwark
সবাই নারীর অধিকার রক্ষায় উদ্বুদ্ধ হোক
‘মেয়ে’ নামের সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা এবং সমন্বয়কারী তৃষিয়া নাশতারান৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘রংবাজি’ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘রিকশা পেইন্টিং আমাদের ঐতিহ্য৷ এর ব্যাপক সামাজিক প্রভাব আছে৷ যাত্রীরা যখন রিকশায় চড়েন, জ্যামে বসে থাকেন, তখন রিকশা পেইন্টিং গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখেন তাঁরা৷ আমরা সেটাই কাজে লাগাতে চেয়েছি৷ আমরা চাই এই চিত্রগুলো দেখে মানুষ সচেতন হোক৷ নারীর অধিকার রক্ষায় উদ্বুদ্ধ হোক৷’’