1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আরো প্রাণঘাতী হয়েছে নারীর প্রতি বাড়ির ভেতরের সহিংসতা

২২ আগস্ট ২০২৫

চলতি বছরে বাংলাদেশে পারিবারিক নারী নির্যাতনের উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯/৯৯৯, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও সরকারি জরিপসহ একাধিক সূত্রে।

Symbolfoto zum Thema sexueller Missbrauch bei Kindern
ছবি: Rafael Ben-Ari/Chameleons Eye/Newscom World/IMAGO

ঘরের ভেতরের এই সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং আইন, নীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সূত্রের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বেড়েছে। সামাজিক চাপ, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং আইন প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে এবং নানা প্রশ্রয়ে অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

পরিসংখ্যানে নির্যাতনের চিত্র

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানুয়ারি–জুলাই ২০২৫ সময়ে অন্তত ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে; নিহত হয়েছেন ৩২২ জন নারী, যার মধ্যে অন্তত ১১৩ জনকে হত্যার অভিযোগ সরাসরি স্বামীর বিরুদ্ধে। হিসাব বলছে, যেখানে মামলা হয়েছে ৬৪টি আর বাকি ৬৯টি হত্যায় মামলার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

প্রতিষ্ঠানটির পরিসংখ্যান বলছে, স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতনের পর মৃত্যুর চিত্রও ভয়াবহ। জুলাই মাস পর্যন্ত ৪২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান। মামলা হয়েছে ১৮টি, আর এখানেও ২৪টি ঘটনায় মামলার তথ্য নেই।

আরো দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৭ জন নারী। এর মধ্যে মামলা করেছেন ৬ জন এবং মামলার তথ্য নেই ১১টি ঘটনায়। একইভাবে স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭ জন। মামলা হয়েছে ৪টিতে, বাকি ৩টি ঘটনায় মামলা হয়নি।

নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে ৩৩ জন নারীকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। আর নির্যাতিত হয়েছেন ১৭ জন। হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪টি, আর মামলার তথ্য নেই ১৮টিতে। নির্যাতনের ঘটনায় মামলা করেছেন ৭ জন, পাশাপাশি ১০ জন নারী মামলা করেননি।

এছাড়া জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন নির্যাতনের শিকার ১১৪ জন নারী। সব মিলিয়ে মামলা হয়েছে ১৫০টি, মামলা হয়নি ২১৪টি ঘটনায়। অর্থাৎ, নির্যাতন বাড়লেও এ অপরাধের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা তুলনামূলক কম।

অন্যদিকে আসক-এর ২০২৪ সালের জানুয়ারি–জুন পর্যায়ের (অর্থাৎ গত বছরের প্রথম ছয় মাস) তুলনামূলক চিত্রও গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়কালে আসক-এর প্রকাশিত পরিসংখ্যানে পারিবারিক সহিংসতার ২৬৯টি ঘটনা ধরা পড়ে। সেখানে স্বামীর হাতে খুন ৮৪ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯৪ জন। অর্থাৎ, চলতি বছরের একই সময়কালে (এবং জুলাই যুক্ত হলে) ঘটনার যেমন সংখ্যা বেড়েছে, তেমনি মৃত্যুর সংখ্যাও লাফিয়ে বেড়েছে। এক অর্থে বাড়ির ভেতরের সহিংসতা আরো প্রাণঘাতী হয়েছে।

পারিবারিক সহিংসতার শেকড় এবং বিস্তার

18:51

This browser does not support the video element.

শুধু সংখ্যানির্ভরতার বাইরে, জাতীয় হেল্পলাইনগুলোর চিত্রও শঙ্কার। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১০৯ নম্বরে জানুয়ারি–জুলাই ২০২৫ সময়ে শারীরিক নির্যাতন সংক্রান্ত ২৯,১৬১টি এবং মানসিক নির্যাতন সংক্রান্ত ১৯,৫৮৪টি কল রেকর্ড হয়েছে—যদিও ১০৯ ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স' আলাদা ক্যাটাগরি হিসেবে আলাদা করে না। পুলিশের ৯৯৯ নম্বরে একই সময়ে স্বামীর সহিংসতা অভিযোগ করে ৯,০০০-এর বেশি কল এসেছে।

দেশের অন্যতম প্রাচীন নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মাসওয়ারি (জুলাই ২০২৫) নির্যাতন-চিত্র দেখায়, মাসজুড়ে নারী ও কিশোরীর ওপর সহিংসতার অভিযোগের সংখ্যা কয়েক শততে পৌঁছেছে—যা চলতি বছরের ‘উচ্চমাত্রার' ধারাবাহিকতাকেই ইঙ্গিত করে। সংগঠনের এই মাসিক চার্ট মাঠপর্যায়ে সংগৃহীত মামলার ধরন, বয়সভিত্তিক বণ্টন ও সহিংসতার প্রকৃতি (শারীরিক, মানসিক, যৌন, অর্থনৈতিক ইত্যাদি) আলাদা করে তুলে ধরে। জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশে বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১,৫৫৫ জন নারী ও কন্যা। পারিবারিক নির্যাতনের শিকারহয়েছেন ২২ জন নারী। আর হত্যা করা হয়েছে ৩২০ জন নারীকে। পাশাপাশি শুধুমাত্র জুলাই মাসেই বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৩৫ জন নারী ও কন্যা।

ভুক্তভোগীর কণ্ঠ

মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন মনি (নাম গোপন রাখা হলো)। বিয়ের সাত বছর পরেও স্বামীর নির্যাতনের শিকার হন এই নারী। অনেক সময়ে সন্তানদের সামনেই চড়-থাপ্পড় দেন আর নিজের মনের মতো কিছু না হলেই চলে গালাগালি।

এই নারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিয়ের পর যহন জামাই মারতো, গালাগালি করতো, সবাই কইতো—ব্যাডা মাইনষ্যের রক্ত গরম। ও একটু মারবোই। নতুন নতুন বিয়া হইছে, কষ্ট পাইতাম। কিন্তু এহনো স্বামীর একই অবস্থা।”

"আমি পড়ালেখা করি নাই, স্বামী মারলে কই যামু? কিন্তু যেসব আপাগো, স্যারগো বাড়িতে কাজ করি, হেগো অনেকের বাড়িত একই অবস্থা দেহি। তখন খুব খারাপ লাগে। ভাবি, একজন মানুষ কেন আরেকজনরে গায়ে হাত দিবো, গালাগালি করবো।”

‘ পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব অন্যতম কারণ’: আবু আহমেদ ফয়জুল কবির

This browser does not support the audio element.

এক সময়ে নেশা করতেন নুরজাহানের (নাম গোপন রাখা হলো) স্বামী। স্নাতকোত্তর করা নুরজাহানের স্বামী এখন নেশা থেকে বেরিয়ে ব্যবসা করছেন। সংসারের কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রীর মতামতের তেমন গুরুত্ব দেন না তিনি।

ডয়চে ভেলেকে নুরজাহান বলেন, "সংসারের একটি বিষয়ে তার মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি কথা বলতে গেলে তাদের সামনেই চড়-থাপ্পড় দেয় আর গালাগালি করেন। এই ঘটনার পরে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। যাদের সামনে এমন ঘটনা ঘটলো, তারাও ছিল নিশ্চুপ। নিজের পরিবারকে বলায় তারা বলল, নিজের ঘরের কথা ঘরে থাকাই ভালো।”

কেন বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা?

বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যায় যে বিষয়গুলো বারবার উঠে আসে, সেগুলো হলো, পারিবারিক–সামাজিক পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, ন্যায়বিচারের পথে প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা ও ভীতি, আইনের প্রয়োগের অভাব, পুলিশ, প্রশাসনের অবহেলা এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়া। আর অপরাধীরা এ দুর্বলতাগুলোরই বারবার সুযোগ নিচ্ছে। এ কারণে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা গত সাত মাসে মারাত্নক উদ্বেগের অবস্থায় চলে গেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন,

" গত কয়েক মাসের যে ভয়াবহ চিত্র দেখা যাচ্ছে, তার পিছনে অনেকগুলো কারণ থাকলেও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব অন্যতম বলা চলা। বর্তমান সময়ে এই চর্চাগুলো এতটাই বেড়েছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা শাস্তি পায় না। ফলে, তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সরকার কেন নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে পারছে না- তার মূল কারণই এগুলো। ”

জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে নারী ও কন্যা নির্যাতনের আরো ভয়াবহ চিত্র এসেছে নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বিশ্লেষণে। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম মনে করেন, সমাজে কোনো অস্থিরতা বা দুরবস্থা দেখা দিলে তার প্রথম শিকার হন নারীরা এবং তারই সত্যতা মিলছে এই পরিসংখ্যানে।

‘পরিসংখ্যানে যা দেখা যাচ্ছে তা অল্পই বলবো, বাকিটা থেকে যাচ্ছে অজানা’: ফওজিয়া মোসলেম

This browser does not support the audio element.

সারা দেশে যা ঘটছে, তার ভয়াবহতা অল্পই সামনে আসছে উল্লেখ করে এই নারী অধিকার কর্মী বলেন, "গত বছর থেকেই সামাজের প্রতিটি জায়গায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হয়েছে। এখনো যে ভালো অবস্থানে আছে তা বলা যাচ্ছে না। ফলে অপরাধীরা সুযোগ এবং প্রশয় পাচ্ছে আর বাড়ছে নারী ও কন্যা নির্যাতন। পরিসংখ্যানে যা দেখা যাচ্ছে তা অল্পই বলবো, বাকিটা থেকে যাচ্ছে অজানা।”

এ ধরনের হেনস্থা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যর্থতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, " গত বছরে সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নারীদের রাস্তাঘাটে হেনস্থা, মব তৈরি করে নির্যাতন করা হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনার পরে দেখলাম সরকারও কিছু বললেন না আর যারা গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাও কিছু বললেন না। ফলে নারী-বিদ্বেষ একটা গ্রহণযোগ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। এভাবে করে নারী-বিদ্বেষকে একটা ‘নিরাপত্তা' দেওয়া হলো, যা বর্তমান পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।”

আইন আছে, প্রয়োগে ‘দুরবস্থা'

বাংলাদেশে পারিবারিক নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা একাধিক আইনের সহায়তা নিতে পারেন।এর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০। এই আইনে নারী ও শিশু উভয়ই সুরক্ষার আওতায় আসে। ভুক্তভোগী আদালতের মাধ্যমে সুরক্ষা আদেশ, বাসস্থানে থাকার অধিকার, ভরণপোষণ ও ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন।

পারিবারিক সহিংসতা আইন অনুযায়ী, পরিবারের মধ্যে নারী বা শিশুর ওপর শারীরিক, মানসিক, যৌন অথবা আর্থিক ক্ষতি করলে তা পারিবারিক সহিংসতা হিসেবে গণ্য হবে। আইনে বলা হয়েছে, শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে আঘাত, বলপ্রয়োগ বা জীবনের ক্ষতি; মানসিক নির্যাতনের মধ্যে মৌখিক অপমান, ভয়-ভীতি ও হয়রানি; যৌন নির্যাতনের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত বা জোরপূর্বক যৌন আচরণ; আর্থিক নির্যাতনের মধ্যে আইনগত প্রাপ্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা, প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য না দেওয়া কিংবা ভুক্তভোগীর সম্পত্তি অনুমতি ছাড়া হস্তান্তরের মতো কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত।

এছাড়া রয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩), যা শারীরিক, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, অঙ্গহানি, এমনকি হত্যার চেষ্টার মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই আইনে কঠোর শাস্তি, যেমন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে।

এই আইনগুলো ক্ষতিপূরণ, আশ্রয় ইত্যাদি নিশ্চিতে অগ্রগামী হলেও বাস্তবে আইন প্রয়োগে বড় শূন্যতা থেকে যাচ্ছে। এ কথা বহুবার উঠে এসেছে অধিকারকর্মীদের বক্তব্যে ও গবেষণা–প্রতিবেদনে। ব্র্যাকের ২০২৪ সালে প্রকাশিত ‘পাবলিক প্রসিকিউশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ: দ্য ইস্যুজ অব জাস্টিস ফর ভায়োলেন্স অ্যাগেইন্সট উইমেন অ্যান্ড গার্লস' বা ‘বাংলাদেশে সরকারি প্রসিকিউশন ব্যবস্থা: নারী ও কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতার ন্যায়বিচারের সংকট' গবেষণায় দেখা গেছে, অভিযোগ দায়েরের পর প্রসিকিউশন ধাপে ধাপে ক্রমশ ভেঙে পড়ে—যাতে সাক্ষী সুরক্ষা, কেস-ব্যাকলগ, বারবার আদালতে হাজিরা সংক্রান্ত খরচ-ঝক্কি এবং তথ্য প্রাপ্তির জটিলতা অন্যতম প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার এড়াতে চায়, এবং এর ফলে পুলিশ, প্রশাসনের নিষ্ক্রয় থাকা ও অপরাধীদের বেপরোয়া হওয়ায় সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করে৷ অভিযোগ তুলতে না পারা নারী শেষ পর্যন্ত 'চুপ' হয়ে যায়।

রিপোর্টে আরো দেখানো হয়েছে যে, প্রায় ৩৮৪টি ট্রাইব্যুনাল মামলা বিশ্লেষণ করে, তদন্ত-প্রসিকিউশন ও বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক সময় লাগা এবং কার্যক্রমের দুর্বলতা দেখা গেছে; যেমন তদন্তে গড় সময় ছিল প্রায় ১৯৩ দিন, অনুসন্ধানেও বাকি সময়; এছাড়া মুহূর্তিক সাক্ষী সুরক্ষা, তদন্তের গুণগতমান, এবং কোর্ট ফি ও হাজিরার ঝক্কি—এসব কারণে ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়। একই সাথে বড় এক সমস্যা হিসেবে রয়েছে সাক্ষী নিরাপত্তা না থাকা, জটিল তথ্য সংগ্রহ, তদন্তের অনীহা।

সংখ্যা শুধু ট্র্যাজেডি না, নীতির ফাঁকও দেখায়

বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান নিছক একটি ট্র্যাজেডির চিত্র নয়, বরং নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর গভীর ফাঁকও তুলে ধরে। বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা গেছে, গত কয়েক মাসে স্বামীর সহিংসতার কারণে পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ হাজার হাজার নারী কল করেছেন। এটি কেবল ব্যক্তিগত দুর্ভোগের প্রতিফলন নয়, বরং এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা যে যথেষ্ট কার্যকর নয়, তারও প্রমাণ। সরকার জাতীয় হেল্প লাইন, কাউন্সেলিং সেন্টার, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল এবং বিভিন্ন আইনি সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও বাস্তবতায় প্রশ্ন থেকে যায়—এসব উদ্যোগ কতটা কার্যকরভাবে ভুক্তভোগী নারীর কাছে পৌঁছাচ্ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, "জাতীয় হেল্প লাইন ১০৯ নম্বর চালু থাকলেও অনেক নারী এখনো সচেতন নন, কিংবা সামাজিক লজ্জা-ভয়, পারিবারিক চাপ ও গ্রামীণ অঞ্চলের সীমাবদ্ধতার কারণেও এই সুবিধা নিতে পারছেন না। কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসন সুবিধাও পর্যাপ্ত নয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেবাগুলো নগরভিত্তিক। ফলে প্রান্তিক ও গ্রামীণ এলাকার নারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।”

"আইনি সুবিধার প্রতিবন্ধকতার জন্য প্রতিকার পাওয়ার জন্য নারীকে থানায় গিয়ে মামলা করতে হয়। যেখানে আছে পুলিশি অবহেলা, সামাজিক প্রভাব ও ক্ষমতাবানদের চাপ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনসহ বিদ্যমান আইনগুলো যথেষ্ট হলেও সঠিক প্রয়োগ না থাকায় কাঙ্ক্ষিত সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না।”

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেমও বলেন, "নারী নির্যাতন দমনে নতুন আইনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ, দেশে যথেষ্ট নারী সেন্সেটিভ বা নারীবান্ধব আইন আছে। কিন্তু আইনগুলোর প্রয়োগ নেই, বাস্তবায়ন নেই। তাই উদ্যোগটি সেখানে থাকা উচিত ছিল, কিন্তু মানুষের আস্থা পাওয়ার জন্য আইনগুলোতে নানা পরিবর্তন ও সংস্কার আনা হলো। এতে করে কিন্তু তেমন সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। আর এই বিচারব্যবস্থা থেকে যে নারী ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, আমরা সেটাই দেখতে পেলাম।”

অপরাধ ও ক্ষমতা একই সঙ্গে মিশে আছে - উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, " যিনি ক্ষমতাসীন তিনিই অপরাধ করছেন এবং যিনি ক্ষমতাসীন হতে চাচ্ছেন তিনিও অপরাধচক্রের মধ্যে থেকে অপরাধ করছেন। এই চক্র না ভাঙতে পারা এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি কিন্তু একটি বড় কারণ।”

নারীআন্দোলন কখনই ধর্মের বিরুদ্ধে নয় বলে মন্তব্য করেন ডা. ফওজিয়া মোসলেম। " যখনই নারী অধিকারের কথা বলা হয়, তখনই নানাভাবে ধর্মকে নারীর প্রতিপক্ষ করে রাখা হয়। মূলত নারী অধিকার খর্ব করতেই একে মুখোমুখি করার চেষ্টা করা হয়। নারী-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে তাই সোচ্চার হতে হবে, প্রতিরোধের চেষ্টা করতে হবে। তবেই পরিবর্তন সম্ভব।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ