বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম বলে ‘যৌতুক' শব্দটির সাথে আমার পরিচয় জন্মলগ্ন থেকে৷ আর বিষয়টি ‘কী‘ তা বুঝেছি এর অর্থ বোঝার ক্ষমতা যখন থেকে হয়েছে তখন থেকেই৷ তবে যৌতুক যে আসলে কী সেই উপলব্ধি হয় অনেক পরে, চারপাশ দেখে৷
বিজ্ঞাপন
চারপাশের কথা বলছি এই কারণে যে, যৌতুকের যে কত ধরন আর কত রকম হতে পারে এই যৌতুক, চারপাশে না তাকালে তা বোঝা যাবে না৷ এ সত্যিই দেখার মতো এক জিনিস! আর সেই যৌতুক দিতে না পারার পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে সে আলোচনায় না হয় আজ না-ই বা গেলাম৷
যৌতুক দিতে না পারার পরিণতির কথা যখন ভাবি তখনই নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হয়৷ কারণ এই গ্লানির ঘানি আমাকে টানতে হচ্ছে না৷ এরপরেও প্রায়ই ভাবি সেইসব পরিবারের কথা, যাদের শ্বাস ভারি হচ্ছে প্রতিনিয়ত কেবল এই একটি কারণে৷
যেসব দেশে যৌতুক আইনত নিষিদ্ধ, তবে...
বিশ্বের অনেক দেশে যৌতুক দেয়া বা নেয়া আইনত নিষিদ্ধ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও এই চর্চা অব্যাহত রয়েছে৷ চলুন এরকম কয়েকটি দেশের কথা জেনে নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Vennemann
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে যৌতুক দেয়া বা নেয়া নিষিদ্ধ৷ তবে মাঝেমাঝেই দেশটিতে যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীর উপর নির্মম নির্যাতন বা যৌতুক চাওয়ায় স্বামীর কারাবাসের খবর শোনা যায়৷ কখনো কখনো স্বামীর পরিবারের যৌতুকের চাহিদা মেটাতে না পেরে নারীদের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/ANN/courtesy of Maheen Khan
ভারত
ভারতে ১৯৬১ সালে যৌতুক প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়৷ কিন্তু তারপরেও যৌতুক প্রথা অব্যাহত রয়েছে৷ বিয়ের সময় হিন্দু নারীদের পরিবারের তরফ থেকে অনেক উপহার দেয়া হয় নবদম্পতিকে৷ এই চর্চা হিন্দু সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত রয়েছে৷ দেশটিতে প্রতি ঘণ্টায় একজন নারী যৌতুক সংক্রান্ত কারণে মৃত্যুবরণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/epa/D. Solanki
পাকিস্তান
যৌতুক অবৈধ করতে পাঁচটি আলাদা আলাদা আইন করেছে করেছে পাকিস্তান৷ প্রথম আইনটি করা হয়েছিল ১৯৬৪ সালে, আর সর্বশেষটি ২০০৮ সালে৷ তা সত্ত্বেও যৌতুক প্রথা থামানো যায়নি৷ যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীর গায়ে এসিড নিক্ষেপের ঘটনাও দেশটিতে বিরল নয়৷
ছবি: picture-alliance/AA/M. Bilal
নেপাল
নেপালে যৌতুক নিষিদ্ধ হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি৷ সামাজিক প্রথা এবং চর্চা অ্যাক্টের আওতায় ২০০৯ সালে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে দেশটিতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/epa/N. Shrestha
কেনিয়া
যে কোনো ধরনের যৌতুক দেয়া বা নেয়া কেনিয়াতে নিষিদ্ধ হয়েছে ২০১২ সালে৷ দেশটিতে পুরুষদের যৌতুক দিতে হয়৷ আর সেই যৌতুক কী হবে তা নির্ধারণে রীতিমত দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনাও হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/epa/D. Kurokawa
গ্রিস
যৌতুক প্রথা গ্রিসে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৮৩ সালে৷ ইউরোপের দেশটির পাহাড়ি অঞ্চলে অতীতে যৌতুক দেয়া ছাড়া মেয়েদের বিয়ে দেয়া একরকম অসম্ভব ব্যাপার ছিল৷ তবে এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে৷
পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনের আওতায় চলতি বছরের মে মাসে অস্ট্রেলিয়ায় যৌতুক বাতিল করা হয়েছে৷ ২০১৪ সালে সেদেশে বসবাসরত এক ভারতীয় নারী যৌতুক দিতে না পারায় নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন৷ সেই ঘটনার পর দেশটিতে অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে যৌতুকের দেয়া বা নেয়া চলতে না পারে সেদিকে কড়া নজর দেয়া হয়৷
ছবি: Rido - Fotolia.com
7 ছবি1 | 7
আমার বিয়ের কাহিনির খানিকটা সঙ্গত কারণেই এখানে বলতে হচ্ছে৷ মোটামুটি বিনা নোটিশে আমার বিয়ে হয়৷ কথা ছিল আংটি বদলের৷ পরে বিয়ে৷ তবে ঘটনাচক্রে আংটি বদলের দিনই হয়ে যায় বিয়ে৷ সেদিন থেকেই শুরু স্বামীর ঘর করা৷ এরপর আবারও কথা হয় বিয়ের অনুষ্ঠানের (যখন সাধারণত লেনদেন বিষয় আসে)৷ পরে সেটাও হয়নি৷ বিয়ের দিনে আমার স্বামী ও তাঁর পরিবার আমর জন্য শাড়ি, গহনা এনেছিলেন৷ অন্যদিকে আংটি বদলের জন্য আমার পরিবারও তাঁর জন্য আংটি আর পোশাক এনে রেখেছিল৷ সেগুলো পরেই আমাদের বিয়ে হয়৷ পরে অবশ্য আমি উত্তরাধিকার সূত্রে আমার মায়ের কিছু গহনা আর ‘এক্সক্লুসিভ' কয়েকটা শাড়ি পাই৷
এ তো গেলো আমার বিয়ে৷ আমার আগের দু'বোনের বিয়েও বেশ অনাড়ম্বরপূর্ণভাবেই হয়৷ ফলে প্রায় আমার মতোই ঘটনা ঘটেছিল তাঁদের বেলাতেও৷ আবার আমার ভাইয়ের বিয়ের বেলাতেও তাই৷ যে মেয়েটিকে আমরা ঘরের বউ করে এনেছিলাম, তাঁর জন্য বিয়ের পোশাক আর গহনা কেনা হয়েছিল৷ মা তাঁর নিজের গহনা পরিয়েই ছেলের বউকে ঘরে তুলেছিলেন৷
কিন্তু আমার বিয়ের আগে ও পরে এই লেনদেন, ‘আধুনিক সভ্য সমাজে' যা ‘গিফট' বলে পরিচিত কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘মেয়েকে সাজিয়ে দেয়া' বিষয়ক ধ্যানধারণার চর্চা দেখতে দেখতে আমি প্রায় তেঁতো হয়ে গেছি৷
খুব মনে পড়ছে, আমার এক বন্ধুর বিয়ের কথা৷ তাঁর শিক্ষিত-ধনী বাবা-মা বিয়ের সময় মনের মাধুরী মিশিয়ে মেয়েকে সাজিয়ে দিচ্ছিলেন৷ একটা পর্যায়ে আমি বন্ধুকে বলেই বসলাম, ‘‘এ সব কী হচ্ছে!'' বন্ধু নিরুত্তর৷
সইতে না পেরে বন্ধুর মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘আপনারা এ সব কী করছেন? কেন করছেন?''
ঝটপট তাঁর জবাব, ‘‘না, না ছেলেপক্ষ কিছু চায়নি তো৷ আমরা নিজে থেকেই দিচ্ছি৷''
বললাম, ‘‘কেন?''
‘‘সে কি! আমার তো আদরের একটা মেয়ে, ওকে সাজিয়ে দেবো না ?'' – এই ছিল তাঁর জবাব৷
শেষমেষ এই সাজিয়ে দেয়া কেবল শাড়ি-গহনাতে থেমে থাকলে হতো৷ সেটি গিয়ে ঠেকলো বিছানা, বালিশ, তোষক...এ সবে৷ এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম আরও অনেকবার, বহুবার৷
শুধু বন্ধুমহলে নয়, দেখলাম পরিবারের গণ্ডিতেও৷ এক আত্মীয়ার কথা মনে পড়লে প্রতিবার আমি কষ্টে নীল হয়ে যাই৷ একরাশ বেদনা গ্রাস করে আমাকে৷
কেবল মেয়ের গায়ের রং অনুজ্জ্বল বলে, মেয়ের শিক্ষা-দীক্ষা সব ভুলে সেই পরিবার মানসিকভাবে রীতিমতো প্রস্তুত ছিলেন মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দিতে৷ বিয়ের পাত্রও জুটেছিল সেরকমই! বিয়ের পর পাত্রের বাবা নাকি একবার মেয়ের বাসার শোকেসে সাজানো কাঁচের বাসন-কোসনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,‘‘এইরকম একটা ডিনার সেট আমার বাসায় পাঠিয়েন৷''
প্রতি সপ্তাহে বউয়ের বাড়ি থেকে খাবার রান্না করে পাঠানোও নাকি তাঁদের এলাকার রেওয়াজ বলে দাবি করতেন তাঁরা৷ ফলের মৌসুমে ফল, শীতের মৌসুমে পিঠা, ক'দিন পর পর দাওয়াত দেয়া, ছেলের বাড়িতে কোনো আত্মীয় আসলে আবারও উপহারসহ দাওয়াত দেয়া আর বছরে দু'টি ঈদ তো আছেই৷ ফর্দ কেবল লম্বাই হতে থাকে৷ হাঁপাতে থাকে সেই পরিবার৷
এ এক অসহনীয় দৃশ্য!
বলে রাখা ভালো, এই ঘটনা আমার আর আমার বাবা-মায়ের মাথায় তীব্রভাবে নাড়া দেয়৷ আমিও নড়েচড়ে বসি৷ কিছুতেই এই ঘটনা যেন আমার সাথে ঘটতে না পারে৷
আমাকে অবশ্য আলাদা করে কিছুই করতে হয়নি৷ আমার শ্বশুরবাড়ি গ্রামে হওয়া সত্ত্বেও সেই গ্রামের লোকজন নাকি আগে থেকেই যৌতুকপ্রথা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছেন৷ ফলে কোনো সময়ই তাঁদের আচরণে এ ধরনের কিছু প্রকাশ পায়নি৷ বরং যৌতুক নিয়ে ঘৃণাই দেখেছি সবার চোখে৷ আমি জানি না, এই বোধ কবে, কখন বাংলাদেশের সব ঘরে, সব গ্রামে, প্রতিটি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যাবে৷
আসলে এটা কেবল শিক্ষা দিয়ে নয়, বোধ আর চেতনা নিয়ে বদলাতে হবে৷ একবার ভাবতে হবে, যে মেয়েটির সঙ্গে এমন করা হচ্ছে সে যদি আমার নিজের মেয়ে হতো? যে পরিবারটির সঙ্গে এমন করছি, সেটা যদি আমার কোনো নিকটাত্মীয়ের পরিবার হতো তাহলে কেমন লাগতো? আমার মেয়ে, আমার বোন বা আমার আত্মীয়দের যে কোনো একজনের সাথেও কিন্তু এমনটা ঘটতে পারে৷ এই চিন্তা না হলে বোধহয় যৌতুকের বিরুদ্ধে, পণপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব না৷
আর আমার সেই আত্মীয়ার জন্য নিরন্তর চাওয়া, ‘শক্তি সঞ্চয় করে রুখে দাঁড়ান আজই৷'
লাভ ম্যারেজ বা প্রেম করে বিয়ে কেন করবেন
সম্মন্ধ করে বিয়ে ভালো নাকি প্রেমের বিয়েতেই বেশি সুখ? এ নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে৷ তবে আজকের যুগে বিয়ে করার আগে হবু স্বামী বা স্ত্রী কেন পূর্ব পরিচিত হওয়া দরকার বা প্রেম করে বিয়ে করার সুবিধাগুলো কী জেনে নিন৷
ছবি: Fotolia/Maridav
পছন্দ বা ভালো লাগা
বিয়ে শুধু দু’টি মানুষের মধ্যে নয়, দু’টি পরিবারের মধ্যেও নতুন সম্পর্কের সূচনা করে৷ তাই নব দম্পতির অনেকটা সময় চলে যায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হতে৷ নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের খবর নেয়ার তেমন সুযোগ পান না তাঁরা৷ ফলে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতে পারে৷ কিন্তু বিয়ের আগে প্রেম বা বন্ধুত্ব থাকলে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে কম, দাম্পত্যজীবনও হয় মধুময়৷ আর পরবর্তীতে উপহার নির্বাচনেও অসুবিধা হয় না৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/McPHOTO
একে অপরের প্রতি বিশ্বাস
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূল ভিত হলো বিশ্বাস৷ বিশ্বাস ছাড়া কখনো সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়৷ আর বিয়ের আগে, অর্থাৎ মন দেয়া-নেয়ার সময় একে-অপরের প্রতি বিশ্বাসের প্রমাণ দেওয়া বা পাওয়ারও যথেষ্ট সুযোগ থাকে৷ সুযোগ থাকে অন্যজনের ভালো লাগা-মন্দ লাগা, চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানারও৷
ছবি: AV/Fotolia
ভুল-ক্রুটি বা দূর্বলতা
প্রতিটি মানুষই ভুল করে৷ প্রত্যেকের মধ্যেই থাকে নানা ক্রুটি বা দূর্বলতা৷ কিন্তু বিয়ের পরে, হঠাৎ করে এ সব জানার পর অনেক দম্পতির মধ্যেই হতাশার জন্ম নেয়৷ কেউ-ই ‘পারফেক্ট’ নয় – কথাটা যেমন ঠিক, তেমনই বিয়ের আগে এ সমস্ত কথা জানা থাকলে একে-অপরের ক্রুটিগুলো মেনে নেওয়া সহজ হয় বৈকি!
ছবি: Fotolia/ArTo
ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই
আজকের যুগের বিয়ের পর অনেক দম্পতির ভেতর তাদের পুরনো প্রেম নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে৷ কিন্তু প্রেম করে বিয়ে করলে এর কোনো সুযোগ থাকে না৷ বরং স্বামী-স্ত্রীর বুন্ধদের মধ্যে অনেকেই পূর্ব পরিচিত বা ‘কমন ফ্রেন্ড’ হওয়ায় আধুনিক জীবনযাপন আরো সহজ হয়৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
পারিবারিক কলহ এড়াতে...
বিয়ের পর দুই পরিবারের মধ্যে যৌতুকের মতো নানা কারণে যে কলহ বা ভুল বোঝাবুঝি হয়, তা এড়ানো সম্ভব যদি আগে থেকেই ছেলে-মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব বা প্রেম থাকে৷ কারণ প্রেম করে বিয়ে হলে পরিবারের বড়রা সাধারণত এ সব ব্যাপারে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন৷
ছবি: Fotolia/Sven_Vietense
বিশেষজ্ঞের মত
জার্মানি বা ইউরোপের দেশগুলোতে সাধারণত ভালোভাবে পরিচয়ের পরই মানুষ বিয়ে করে বা অনেকে না করেও একসাথে বসবাস করে৷ তবে বিয়ের আগে একে-অপরের পছন্দ-অপছন্দ, সখ, ইচ্ছে – এ সব খুব ভালো করে জেনে নিয়ে তবেই সারা জীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা বিয়ের মতো বড় সিদ্ধান্তটি নেওয়া উচিত বলে মনে করেন জার্মানির পারিবারিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ব্যার্নহার্ড ভল্ফ৷
ছবি: Fotolia/Maridav
6 ছবি1 | 6
এ বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷