‘পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি'৷ কাব্য, শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম – প্রায় সব ক্ষেত্রেই রুটি বা পাউরুটির উল্লেখ পাওয়া যায়৷ রুটির ইতিহাস ও প্রভাব নিয়ে আস্ত একটা মিউজিয়াম রয়েছে অস্ট্রিয়ায়, যার স্থাপত্যশৈলিও নজর কাড়ার মতো৷
বিজ্ঞাপন
ঘুরে আসুন পাউরুটি-মিউজিয়াম থেকে
03:48
এ যেন স্বপ্নের এক বাড়ি৷ অস্ট্রিয়ার লিনৎস শহরের উপকণ্ঠে আস্টেন-এর ‘পানেউম' মিউজিয়াম ভবনটি যেন ভবিষ্যৎ থেকে উঠে এসেছে৷ প্রায় ১,০০০ বর্গ মিটার জুড়ে শুধু একটি বিষয় ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে – পাউরুটি৷ পেটার আউগেনডপলার তাঁর বেকিং কোম্পানির দৌলতে গোটা বিশ্বে কোটি কোটি ইউরো আয় করছেন৷ পাউরুটির জন্য এমন এক স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা ছিল তাঁরই স্বপ্ন৷ তিনি বলেন, ‘‘যে মুহূর্তে কিছুই ছিল না, তখন রুটিই ছিল সম্বল, তা সে যতই খারাপ হোক না কেন৷ সেটা খেয়ে বেঁচে থাকার উপায় ছিল৷ পাউরুটি না থাকলেই লোকে বুঝতো, আর কিছুই নেই৷ এটাই রুটির বৈশিষ্ট্য৷''
সাধের এই মিউজিয়ামের জন্য তিনি এক অসাধারণ ভবন গড়তে চেয়েছিলেন৷ ভিয়েনার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্থপতি সংস্থা কোয়প হিমেলবাউ মিউজিয়ামের নক্সা তৈরি করে৷ ভবনটির আকার-আয়তন সম্পর্কে ভল্ফ ডে প্রিক্স-এর নিজস্ব এক আইডিয়া ছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘ভবনটির আকৃতি নিয়ে নিত্য নতুন ব্যাখ্যা শুনলে খুব খুশি হই৷ কেউ বলে রুটির ডেলা অথবা কেকের ছাঁচ৷ অবশ্যই ভুল ধারণা, কারণ আমি শুধু মেঘের জাহাজের কথা ভেবেই ভবনটি তৈরি করেছি৷''
পাউরুটির দেশ জার্মানি
বিভিন্ন রকমের শস্য দানা দিয়ে নানা স্বাদের, নানা নামে রুটি খেতে যেমন মজা তেমনি স্বাস্থ্যকরও বটে৷রুটি যে শুধু সকালের নাস্তায়ই থাকে তা নয়৷ জার্মানরা পাউরুটি দিয়ে রাতের খাবারও সারেন৷
ছবি: Fotolia/cirquedesprit
পাউরুটির বৈচিত্র্য
সম্ভবত জার্মানিই একমাত্র দেশ, যেখানে প্রায় তিনশো রকমের পাউরুটি রয়েছে৷ রয়েছে প্রায় ১,২০০ রকমের মিষ্টি বা নোনতা বিস্কুট৷ জার্মানদের প্রিয় খাবার বিভিন্ন ধরনের পাউরুটি৷ তবে রুটির জন্ম কিন্তু মিশরে, তিন হাজার বছর আগে৷
ছবি: Fotolia/Ludwig Berchtold
দানা মিশ্রিত পাউরুটি
বিভিন্ন রকমের শস্য দানা দিয়ে নানা স্বাদের, নানা নামে রুটি খেতে যেমন মজা তেমনি স্বাস্থ্যকরও বটে৷ গম বা আটার রুটিতে মেশানো হয় ভুট্টা, গম, তিল, যব জাতীয় বিভিন্ন দানা৷ তাছাড়াও সূর্যমুখী ফুলের বীজ, বিভিন্ন কুমড়ার বীজের পাউরুটিগুলো খেতে খুবই স্বাদ৷ রুটিতে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে দেওয়া গাজরের টুকরা বেশ রসালো স্বাদের৷
ছবি: Axel Warnstedt
নানা উপলক্ষ্যে রুটি
জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, ভালোবাসা, নববর্ষ – এ সব উপলক্ষ্যে বানানো হয়ে থাকে স্পেশাল পাউরুটি৷ যদিও এসবের প্রচলন আজকাল আগের মতো তেমনটা নেই৷
ছবি: Fotolia/tolism
জার্মানরা দু’বেলায়ই পাউরুটি খায়
দেশে রুটি যে শুধু সকালের নাস্তায়ই থাকে তা নয়৷ জার্মানরা পাউরুটি দিয়ে রাতের খাবারও সারেন৷ তবে নাস্তার রুটি আর রাতের খাবারের রুটির মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে৷ সকালে বেকারিতে রুটি কিনতে গেলে তাজা রুটির গন্ধ আর স্বাদ নিঃসন্দেহে খিদে বাড়িয়ে দেয়৷
ছবি: Fotolia/Grecaud Paul
সবার প্রিয় ব্র্যোটশেন
ব্র্যোটশেন – গোল বা ডিম্বাকৃতির পাউরুটি৷ আর এই রুটি ছাড়া সকালের নাস্তা জার্মানরা ভাবতেই পারেন না৷ একটি ব্র্যোটশেন মাঝখানে কেটে দু’ভাগ করে, ভেতরে মাখন, পনির, জেলি বা এ ধরনের কিছু লাগিয়ে খেতে সত্যিই দারুণ মজা৷ ব্র্যোটশেন এতোটাই প্রিয় যে, জার্মানিতে রোববারে সবকিছুই বন্ধ থাকলেও কিছু এলাকায় শুধুমাত্র ব্র্যোটশেন বিক্রির জন্য বেকারি খোলা রাখা হয়৷
ছবি: Fotolia/st-fotograf
জার্মান পাউরুটি দারুণ মজা
জার্মান রুটির প্রশংসা চারিদিকে৷ নিজের দেশে বেকারি খোলার পরিকল্পনা থেকে জার্মানিতে পাউরুটি বানানোর ট্রেনিং নিতে আসেন অনেকেই৷ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছে ক্যাথরিন, চীন থেকে চিওচাং লাম এবং দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছে এলোমালাই গোপাল৷ ওদের সবারই এককথা, ‘‘জার্মান পাউরুটি দারুণ মজা’’!
ছবি: picture-alliance/dpa
ভাতের পরিবর্তে রুটি
এশিয়ার দেশগুলোতে ভাত খাওয়ার প্রচলনই বেশি তবে দিন দিন তা বদলে যাচ্ছে৷ জাপানে গত ৩০ বছর ধরে ভাতের জায়গা দখল করছে রুটি৷ তবে তা শুধু শহরগুলোতে, গ্রামে আগের মতোই ভাত খাওয়া হয়৷ একথা বাংলাদেশ বা ভারতের ক্ষেত্রেও কিছুটা প্রযোজ্য৷
ছবি: Fotolia/ExQuisine
জার্মানিকে বলা হয় পাউরুটির দেশ
পাউরুটি তৈরির সময় বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয় এতে পুরো খাদ্যগুণ বজায় থাকে কিনা৷ এখানে সাদা রুটি খুবই কম দেখা যায়৷ সাদা টোস্ট পাউরুটি জার্মানিসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়৷ তবে জার্মানিতে সাদা অর্থাৎ শুধু ময়দায় টোস্ট নয়, এখানে তৈরি করা হয় বিভিন্ন দানাসহ টোস্ট রুটি যা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পাউরুটি বানানোর কারিগর থেকে ফুটবলার
জার্মানির সুবিখ্যাত ফুটবলার এবং সাবেক জাতীয় দলের কোচ ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমান পেশায় একজন ‘বেকার’ অর্থাৎ তিনি পাঁউরুটি বানানো শিখেছেন৷ তবে কখনো রুটি বানিয়েছেন কিনা, তা বলা যায়না৷
ছবি: Getty Images
ছোট থেকে বড়, সবাই পাউরুটি খায়
ছোটবেলা থেকে পাউরুটি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে জার্মানদের৷ বাড়ি থেকে বের হবার সময় যার যা ইচ্ছে, অর্থাৎ সালাদ, পনির, মাছ, মাংসের স্লাইস পছন্দমতো পাউরুটির ভেতরে ঢুকিয়ে সুন্দর করে স্যান্ডউইচ বানিয়ে সাথে নিয়ে নেয়৷ স্যান্ডউইচ তাজা রাখার জন্য আলাদা বক্সও রয়েছে৷
ছবি: Fotolia/Quade
দেশের কথা মনে পড়ে
জার্মানরা নানা দেশ ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, সে কথা অনেকেরই জানা৷ ছুটি থেকে ফিরে এলে বহু জার্মানকেই বলতে শোনা যায়, ছুটি উপভোগ করলেও দেশি পাউরুটি তারা মিস করেছে বিদেশে, বিশেষ করে সকালের নাস্তায়৷ আর বিদেশিরা জার্মানিতে এসে জার্মান পাউরুটির বৈচিত্র্য দেখে, খেয়ে আনন্দিত হয়৷
ছবি: Fotolia/cirquedesprit
11 ছবি1 | 11
কোয়প হিমেলবাউ সংস্থা তার উদ্ভাবনী নক্সার জন্য গোটা বিশ্বেই পরিচিত৷ ফ্রাংকফুর্ট শহরে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদর দপ্তর থেকে শুরু করে মিউনিখ শহরের বিএমডাব্লিউ ওয়ার্ল্ড, অথবা ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরে বিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ব মিউজিয়াম ভবনও তাদেরই সৃষ্টি৷
গোটা ভবনটিকে সংগ্রাহকের ব্যক্তিগত প্রদর্শনীর মঞ্চ করে তোলাই ছিল লক্ষ্য৷ প্রদর্শনীর বস্তুগুলিকে শুধু কাচের কেসের আড়ালে রাখা হয়নি, দেওয়াল ও সিলিং-এও কিছু বস্তু শোভা পাচ্ছে৷ ঘরের মাঝে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দর্শকরা চার তলার উপর মিউজিয়ামের মূল কাঠের কামরায় পৌঁছতে পারেন৷ পেটার আউগেনডপলার নিজেই বেশ কয়েক বছর ধরে প্রায় ১,২০০ বস্তু সংগ্রহ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা দর্শকদের দেখাতে চাই, পাউরুটি কীভাবে বিগত ছয় থেকে আট হাজার বছর ধরে মানবজাতির ইতিহাসের উপর প্রভাব রেখেছে৷ শুধু খাদ্য নয় – কৃষি, শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্মসহ মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রেই রুটির ভূমিকা রয়েছে৷''
প্রায় ৯,০০০ বছর প্রাচীন ‘গ্রেন স্ল্যাব' বা শস্যের ফলকের মাধ্যমে মিউজিয়ামে রুটির আদি যুগও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্যে রুটিকে কীভাবে সম্মান দেখানো হয়েছে, মিউজিয়ামে তারও দৃষ্টান্ত দেখা যায় – যেমন দক্ষিণ অ্যামেরিকা বা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায়৷ শিল্পের ক্ষেত্রেও রুটি তৈরির প্রক্রিয়া কীভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তারও স্বাদ পাওয়া যায়৷