রুশ প্রভাব নিয়ে সতর্ক জার্মানি
৩০ মার্চ ২০২৪এই পরিস্থিতিতে ‘হাইব্রিড যুদ্ধের' বিষয়টি আলোচনায় এসেছে৷ ‘হাইব্রিড যুদ্ধ' কী এবং কীভাবে এর মোকাবিলা সম্ভব?
জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজারের মতে জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য সাইবার আক্রমণ, প্রচারণা এবং অন্যান্য কৌশল ব্যবহার করছে রাশিয়া।
মধ্য-বামপন্থি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য ন্যান্সি ফেজার জুডডয়চে সাইটুং পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘এইসব বিপদ একটি নতুন স্তরে পৌঁছে গেছে।”
আগামি জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং সেপ্টেম্বরে তিনটি আঞ্চলিক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে জার্মানি। এমন সময়েই জার্মান জনগণকে সতর্ক করে দিলেন ফেজার৷
ভোটের আগে রাশিয়া ক্রেমলিনপন্থি দলগুলোর সমর্থন জোগাড় করার চেষ্টা করতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে। এমন একটি দল হতে পারে, ডানপন্থি পপুলিস্ট দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি - এএফডি।
জার্মানি বেশ কিছুদিন ধরেই রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রভাব বিস্তারের মূল লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের সমর্থন হ্রাস করা।
মস্কোতে জার্মানির সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং জার্মানির বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএনডি-এর সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট ব়্যুডিগার ফন ফ্রিটশ বলেছেন, ‘‘এখন দৃঢ় সংকল্প এবং শক্তি দেখানো এবং অন্য পক্ষ কীভাবে কাজ করছে তা প্রকাশ করার সময়।’’
হাইব্রিড যুদ্ধ কি?
‘হাইব্রিড যুদ্ধ' শব্দবন্ধটি একটি জটিল কৌশল বোঝায়। সামরিক কৌশলের সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানো এবং প্রোপাগান্ডাও রয়েছে এর মধ্যে। এটি অবশ্য নতুন কোনো কৌশল নয়। বহু শতাব্দী ধরে বিদেশে জনমত প্রভাবিত করতে এই ধরনের নানা উপায় ব্যবহার করে আসছে বিভিন্ন দেশ।
কিন্তু গত দুই দশক ধরে, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের উত্থানের ফলে এই হাইব্রিড যুদ্ধ এখন অনলাইনেও জায়গা করে নিয়েছে। ‘হ্যাক-অ্যান্ড-লিক' অপারেশনের অংশ হিসাবে হ্যাকাররা সংবেদনশীল বা গোপনীয় তথ্য চুরি করে কৌশলে সেটা জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করে। নির্বাচনে ব্যবহৃত যন্ত্র এবং সফটওয়্যারসহ করতেও সাইবার আক্রমণ করা হয়। পাশাপাশি বানোয়াট বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর জন্যও ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে।
ফন ফ্রিটশ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এখন গোয়েন্দাদের জন্য ডিজিটাল বিশ্ব স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতো ঘটনায় পরিণত হয়েছে।’’
এই যুদ্ধ কীভাবে কাজ করে?
হাইব্রিড যুদ্ধকে অনেকে ‘ছায়া যুদ্ধ' এর একটি রূপ হিসাবে বর্ণনা করেন। এই যুদ্ধ জনসাধারণের দৃষ্টির বাইরে ঘটে এবং কখনই এই যুদ্ধের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় না।
হামবুর্গ-ভিত্তিক ক্যোরবার ফাউন্ডেশনের রাশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লেসলি শ্যুবেল ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘হাইব্রিড যুদ্ধের ধারণাটি হচ্ছে, এটি যে ঘটছে তা আপনি খেয়ালই করবেন না।’’
জানুয়ারিতে জার্মান সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ একটি সমন্বিত রাশিয়ান প্রোপাগান্ডামূলক কর্মকাণ্ড উন্মোচন করার কথা জানিয়েছিল। এই প্রোপাগান্ডা বন্ধ করার আগেই বিভিন্ন ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১০ লাখেরও বেশি বার্তা ছড়ানো হয়েছে। এইসব বার্তায় যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেনকে দেয়া সাহায্য স্থানীয় নাগরিকদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, এমন মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে জার্মান সমাজে বিভাজন ও ক্ষোভ সৃষ্টি করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণমাধ্যমের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করা।
শ্যুবেল বলেন, ‘‘সন্দেহ তৈরি করতে এরই মধ্যে সফল হয়েছে রাশিয়া।’’
‘টরাস কথোপকথন' ফাঁসের প্রভাব
হাইব্রিড যুদ্ধের বেশিরভাগই অপ্রকাশ্যে থাকলেও কিছু অপারেশন ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রকাশ করা হয়।
একই ঘটনা ঘটেছে কে কেন্দ্র করে। মার্চের শুরুতে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী আরটি জার্মান সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি গোপন কথোপকথন প্রকাশ করে। ‘টরাস লিক' নামে পরিচিত এই কথোপকথন জার্মান সামরিক বাহিনীকে বেশ বিব্রত করে এবং এ নিয়ে একটি কূটনৈতিক জটিলতাও তৈরি হয়।
বার্লিন-ভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেনট্রুম লিবেরালে মডার্নের রাশিয়া প্রোগ্রামের প্রধান মারিয়া সানিকোভা-ফ্রাংক বলেন, ‘‘এই ঘটনাটিকে পুটিন নিজের দেশেও কাজে লাগিয়েছেন।’’
ফাঁস হওয়া কথোপকথনে জার্মান সামরিক কর্মকর্তাদের ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক করতে শোনা গেছে। রুশ মিডিয়া এরপর দাবি করেছে যে জার্মানির সেনাবাহিনী রাশিয়ান অঞ্চলে আক্রমণ করার জন্য পরিকল্পনা করছে।
সানিকোভা-ফ্রাংক ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘[পুটিন] যে ভাবমূর্তি তৈরি করতে চান তা হলো, জার্মানি এবং পশ্চিমারা রাশিয়াকে হুমকি দিচ্ছে। তিনি খুব এই প্রচার করতে সফল হয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি আলেক্সি নাভালনির মৃত্যু এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া থেকেও সফলভাবে সবার মনোযোগ সরাতে পেরেছেন।’’
রাশিয়ায় পুটিনের প্রতিপক্ষদের মধ্য়ে সবচেয়ে স্পষ্টভাষী ছিলেন নাভালনি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ৪৭ বছর বয়সী এই রুশ রাজনীতিবিদ রাশিয়ার কারাগারে মারা যান। পয়লা মার্চ তাকে সমাহিত করা হয় এবং একই দিনে জার্মানির এই গোপন সামরিক কথোপকথন প্রকাশ করা হয়।
কীভাবে এই যুদ্ধ মোকাবিলা করা যায়?
হাইব্রিড যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশগুলোকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, ভোট প্রযুক্তি সাইবার আক্রমণ থেকে পর্যাপ্তভাবে সুরক্ষিত।
‘টরাস কথোপকথন' ফাঁস থেকে বোঝা গেছে যে সমাজের সকল ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি কতটা প্রয়োজনীয়।
নাগরিকদের বিভ্রান্তিমূলক কৌশল সম্পর্কে সচেতন করে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনলাইনে বিভিন্ন তথ্য প্রতারণা এবং প্ররোচিত করার জন্য কিভাবে ব্যবহার করা হয়, সেটিও সবাইকে জানানো জরুরি বলে মনে করেন তারা।
সানিকোভা-ফ্রাংক মনে করেন, ‘‘এই প্রচারের প্রক্রিয়াগুলো প্রকাশ করাটা গুরুত্বপূর্ণ - এটি কীভাবে কাজ করে, কীভাবে এটি আমাদের প্রভাবিত করে, কীভাবে এটি আমাদের মতামতকে প্রভাবিত করে।’’
ইয়ানোশ ডেলকার/এডিকে