করোনা সংকটের ফলে বিপর্যস্ত রেস্তোঁরাগুলির সহায়তায় এগিয়ে এসেছে ব্রিটেনের সরকার৷ সপ্তাহে তিন দিন প্রায় অর্ধেক দামে বাইরে খাবার সুযোগ করে দিতে এক কর্মসূচি চালু করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
করোনা সংকটের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে শিল্প ও বাণিজ্য জগতের অসংখ্য ক্ষেত্র৷ এমন অনিশ্চয়তার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চরম বেকারত্বের আশঙ্কা বাড়ছে৷ বিভিন্ন দেশের সরকার ভর্তুকি ও অন্যান্য পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্রেতা ও ভোক্তাদের আরও ব্যয় করতে উৎসাহ দিচ্ছে৷ ব্রিটেনের সরকারের এমনই এক উদ্যোগ বেশ নজর কাড়ার মতো৷
হোটেল-রেস্তারাঁয় মানুষকে ফিরিয়ে আনতে ব্রিটেনের সরকার ‘ইট টু হেল্প আউট’ কর্মসূচি চালু করেছে৷ এর আওতায় প্রায় অর্ধেক দামে খাদ্য ও পানীয় পাওয়া যাচ্ছে৷ গত সোমবার প্রথমবার সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ঠিক কত মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়৷
তবে সরকারি এই কর্মসূচির ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রাখা হয়েছে৷ আপাতত ৩রা আগস্ট থেকে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত এর মেয়াদ স্থির করা হয়েছে৷ এর আওতায় প্রতি সোমবার, মঙ্গলবার ও বুধবার রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে সর্বোচ্চ ১০ পাউন্ডের ছাড় পাওয়া যাবে৷ যতবার খুশি মানুষ বাইরে খেতে যেতে পারেন৷ নির্দিষ্ট দিনগুলিতে প্রতি বার এই ছাড় পাওয়া যাবে৷ তবে সস্তায় মদ্যপানের সুযোগ কিন্তু থাকছে না৷ অর্থাৎ ছাড় পেতে হলে পানীয় হিসেবে মদের বিকল্প বেছে নিতে হবে৷ ‘সার্ভিস চার্জ’ বা পরিষেবা সংক্রান্ত মাসুলের ক্ষেত্রেও ছাড় পাওয়া যাবে না৷
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব
এরইমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমেছে ব্যাপকভাবে৷ দেখা দিয়েছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়ার শঙ্কা৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
রপ্তানি ধস
লকডাউনের কারণে ইউরোপ ও অ্যামেরিকায় ব্যবসা বাণিজ্য, মানুষের কেনাকাটা কার্যত বন্ধ৷ এসব দেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাই বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে, কয়েকশো কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল করেছে৷ এর প্রভাবে এপ্রিলে রপ্তানি আয় নেমে এসেছে মাত্র ৫২ কোটি ডলারে, যা আগের বছরে একই মাসের চেয়ে ৮২.৮৫% কম৷ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসেব বলছে চলতি বছর সারা বিশ্বেই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ৩২% পর্যন্ত কমতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yu Fangping
প্রবাসী আয়ে টান
এপ্রিলে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর পরিমাণ ছিল ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ ভাগ কমেছে৷ প্রবাসী আয়ের সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে৷ জ্বালানি তেলের দাম কমায় তাদের অর্থনীতি বিপর্যয়ে পড়েছে৷ সেইসব দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা৷ এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স গত বছরের চেয়ে ২২ শতাংশ কমে যাবে, বলছে বিশ্বব্যাংক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/R. Abd
চাকুরির অনিশ্চয়তা
দেশের ভিতরে যে লকডাউন পরিস্থিতি চলছে তার কারণেও বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও সেবাখাতগুলোর কার্যক্রম প্রায় বন্ধ৷ এসব প্রতিষ্ঠানে যারা চাকুরি করছেন, যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছেন তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকছে৷ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক চীনে করোনার প্রকোপ শুরুর পর বলেছিল, বাংলাদেশের প্রায় নয় লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে৷ তবে এখন তৈরি পোশাক খাতেই অনেক শ্রমিকের চাকুরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
খাদ্য নিরাপত্তা
গত বছরের মে থেকে চলতি বছরের এপ্রিল, এই সময়ে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩.৫৩ লাখ মেট্রিক টন৷ নতুন বছরে তা ১০ লাখ মেট্রিক টন বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএ৷ সরকারের খাদ্য গুদামে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে৷ বোরো মৌসুমে আরো ২০ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করবে সরকার৷ সেক্ষেত্রে খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার আশংকা তেমন নেই৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের হাতে খাদ্য কেনার টাকা থাকবে কিনা৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
দারিদ্র্য বাড়ছে
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সোয়া তিন কোটির বেশি৷ এর বাইরে গত দেড় যুগে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন৷ উপার্জন না থাকলে দ্রুতই তারা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন৷ ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক জরিপেও দেখা গেছে করোনার প্রভাবে দেশের নিম্নবিত্তের আয় ৭৫ ভাগ কমে গেছে, হতদরিদ্র বা যাদের দৈনিক আয় ১৬০ টাকার কম এমন মানুষের সংখ্যা ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সরকারের প্রণোদনা
অর্থনীতি বাঁচাতে বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের সরকারও আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যার আকার ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ এর বড় একটি অংশ দেয়া হবে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প আর কৃষি খাতে ঋণ হিসেবে৷ পাশাপাশি লক-ডাউনের কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের ব্যাংক হিসাব তৈরি করে এককালীন নগদ অর্থ প্রদানের কথা বলা হয়েছে৷ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোরও৷
ছবি: Reuters/A. Rahman
টাকার সন্ধান
বাজেটের ঘাটতি মেটাতে এরিমধ্যে ব্যাংক থেকে সারাবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ করে ফেলেছে সরকার৷ নতুন ঋণ নেয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে৷ বিভিন্ন খাতের ব্যয় কমিয়েও অর্থ সংস্থানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷ সবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেতে পারে৷ তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, এমন আশঙ্কায় টাকা ছাপানোর পক্ষে নন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ৷
ছবি: DW
মন্দার শঙ্কা
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে মহামন্দার আশংকা করছেন অর্থনীতিবিদরা৷ এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও৷ এরইমধ্যে চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি৷ মন্দার ধাক্কা বাংলাদেশ কতটা সামলাতে পারবে তা বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি নির্ভর করছে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার উপরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
গোটা দেশজুড়ে প্রায় ৭২,০০০ ক্যাফে, বার, রেস্তোরাঁ, পাব, ক্যান্টিনসহ খাবার সরবরাহকারী সংস্থা সরকারের এই কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে৷ এই উদ্যোগের ব্যয়ের অঙ্ক প্রায় ৫০ কোটি পাউন্ড ছুঁতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনক এ কথা জানিয়েছেন৷
শুধু আর্থিক ছাড়ের টানে কত মানুষ ঘর ছেড়ে রেস্তোরাঁয় বসে খাবার সাহস পাবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে৷ বর্তমানে ব্রিটেনে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে অনেক মানুষই বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া প্রকাশ্যে বের হচ্ছেন না৷ ২৩ বছর বয়সি ম্যাট হ্যাডলি সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, প্রায় অর্ধেক দামে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট খাবার সুযোগ পেলেও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এড়িয়ে চলা তাঁর কাছে অত্যন্ত জরুরি৷ তাঁর মতে ভারসাম্য খুঁজতে গেলে শেষ পর্যন্ত ৫০ শতাংশ ছাড়ের তুলনায় সুস্থ থাকার বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দিতে হয়৷
ম্যাটের মতো ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এমন ঝুঁকি নিতে না চাইলে এই কর্মসূচির সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে৷