চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় ঢাকার বারডেম হাসপাতালের চিকিৎসকদের দুই দিনের কর্মবিরতি এবং রোগীদের দুর্ভোগের পর নানামুখী অসংখ্য প্রতিক্রিয়া এসেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যেমন, ব্লগ ও ফেসবুকে৷
বিজ্ঞাপন
ধর্মঘট ও চিকিৎসকদের আচরণ নিয়ে সমালোচনা যেমন এসেছে, তেমনি কেবল অভিযোগ বা ধারণার ভিত্তিতে হাসপাতালে হামলার ঘটনারও নিন্দা এসেছে৷ এক্ষেত্রে আস্থার সংকট তৈরি হচ্ছে কিনা, উঠেছে সে প্রশ্নও৷
১৩ এপ্রিল রাতে এক রোগীর মৃত্যুর পর তাঁর স্বজনরা বারডেম হাসপাতাল ভাঙচুর করেন এবং তিন চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে৷ এর প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকাল থেকে ধর্মঘটে যান চিকিৎসকরা৷ হামলাকারী হিসেবে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে চিহ্নিত করে তাঁর শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ, মানববন্ধনও করেন৷
পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মানবতা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
এই পরিস্থিতিতে হাসাপতালের জরুরি বিভাগ, আইসিইউ ও সিসিইউ ছাড়া অন্য সব সেবা এবং রোগী ভর্তি বন্ধ থাকে৷ পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে বুধবার চিকিৎসকদের কর্মবিরতির অবসান ঘটে৷
তাঁর ভাষায়, ‘‘কখনো রাজনৈতিক কারণ, কখনোবা রোগীদের স্বজনকর্তৃক ডাক্তারদের লাঞ্ছিত কিংবা মারধরের ঘটনায় ডাক্তাররা কর্মবিরতি পালন করছেন৷ রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে ডাক্তারদের এড়িয়ে যাওয়া উচিত৷ দল বা মতের সমর্থন করা দোষের নয়, তবে তাতে যদি চিকিৎসাধীন রোগীদের জীবনহানীর আশঙ্কা সৃষ্টি হয় কিংবা রোগীদের নিয়ে স্বজনরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে, তবে ডাক্তারদের প্রতি রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা আস্থা হারাবে৷''
চিকিৎসকরা যাতে কর্মবিরতিতে না যান, সেজন্য সরকারকে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আরো আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাজু৷
ফেসবুকে রাগিব হাসান লিখেছেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারের কিছুই করার থাকে না, অনেক ক্ষেত্রে থাকে৷ ডাক্তাররা যদি অবহেলা করেন, সেটা অবশ্যই কঠোর শাস্তির যোগ্য৷ কিন্তু আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোনো ডাক্তারই রোগীদের মেরে ফেলার জন্য কাজ করেন না৷ অন্য অনেক পেশার চাইতে ডাক্তারি অনেক কঠিন একটা পেশা, কারণ, মানুষের জীবন নিয়ে তাঁদের কাজ৷''
তাঁর মতে, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ অনেক কম বলে সবাই ধরে নেন, অনেক কিছু হয়তো ‘এমনি এমনি' হয়ে যায়৷
‘‘কী প্রচণ্ড কম রিসোর্স নিয়ে ডাক্তারেরা কাজ করেন, তা হয়ত মানুষ জানে না৷ অনেক ক্ষেত্রে ‘অবহেলা'-র কারণ চিকিৎসা ব্যবস্থার সমস্যা, জনবলের অভাব, সেটার রাগটা চোখের সামনে যে ডাক্তার আছেন, তাঁর উপরে ঝাড়াটা কি ঠিক? উল্টো দিকে বলতে গেলে এটাও বলতে হবে, চিকিৎসকদের জবাবদিহিতা, মালপ্রাকটিসের মামলা হবার ব্যবস্থা – এসব থাকলে তাঁরাও সতর্ক থাকবেন কাজে৷''
এই লেখার প্রতিক্রিয়ায় মুরাদ খান লিখেছেন, এদেশের সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন ‘অচিকিৎসকরা'৷