1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘রোহিঙ্গাদের জীবন ভয়াবহ কষ্টের'

৩০ অক্টোবর ২০১৭

আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কেয়ার-এর হয়ে বাংলাদেশের একটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ঘুরে এলেন জেনিফার বোস৷ প্রায় ৬০ হাজার সহায়-সম্বলহীন মানুষের জন্য পানীয় আর খাদ্য নিয়ে সেখানে যান তিনি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন সেসব কথা৷

ছবি: Reuters/A. Abidi

ডয়চে ভেলে: সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বরাবর একটি শরণার্থী শিবিরে বেশ ক'টা দিন কাটিয়ে এসেছেন আপনি৷ সেখানকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একেবারে সামনা-সামনি দেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ সেই অভিজ্ঞতার কথা যদি আমাদের একটু বলেন...

জেনিফার বোস: আমি কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশে ছিলাম, কক্সবাজারের একটিশরণার্থী ক্যাম্পে৷ সেখানকার অবস্থা সত্যিই ভয়াবহ৷ ক্যাম্পে তিল ধারণের জায়গা নেই, মানুষ একেবারে গাদাগাদি করে আছে সেখানে৷ মিয়ানমার থেকে কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে তাঁরা সেখানে পৌঁছেছেন, একেবারে সহায়-সম্বলহীন৷ বলতে পারেন পরনের কাপড়টুকু ছাড়া তাঁদের আর আজ কিছুই নেই৷ আতঙ্ক আর ভয়ে এখনো যেন কাঁপছেন তাঁরা৷

জীবনধারণের জন্য তাঁদের আজ কিছুই আর অবশিষ্ট নেইছবি: Reuters/H. McKay

আমি এমন নারীকে সেখানে দেখেছি, যাঁরা ধর্ষণ অথবা শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন মিয়ানমারে থাকতে, আসার পথে অথবা এখানে এসে৷ হ্যাঁ, এমন হাজারো নারী সেখানে আছেন, যাঁরা শরণার্থী ক্যাম্পেও নিরাপদ নন৷ এমন অসংখ্য শিশুদের দেখেছি, যারা এখনও না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে৷ আমাকে এই অপুষ্টিতে ভোগা হতদরিদ্র, রুগ্ন সব বাচ্চাদের দেখতে হয়েছে৷ ভয়াবহ সেসব দৃশ্য৷ ‘কেয়ার' সেখানে কাজ করছে, সাহায্য করছে এসব বাচ্চা-নারীদের মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দিতে৷ আমরা প্রায় ৬০ হাজার মানুষের অন্নসংস্থান করতে পেরেছি৷ কিন্তু এখনও যে হাজার হাজার মানুষ অভুক্ত থেকে গেছে৷ জীবনধারণের জন্য তাঁদের আজ কিছুই আর অবশিষ্ট নেই...৷

‘কেয়ার' প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে খাদ্য দিতে পেরেছ, এটা খুবই ভালো কথা৷ কিন্তু এর মধ্যে প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন৷ এত মানুষের খাদ্যসংস্থান করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়৷ তো আপনারা কি অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সঙ্গে একযোগে কাজ করার কথা ভাবছেন?

‘এমন হাজারো নারী সেখানে আছেন, যাঁরা শরণার্থী ক্যাম্পেও নিরাপদ নন’

This browser does not support the audio element.

বিশ্বে এটাই সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বেড়ে ওঠা শরণার্থী সংকট৷ যে কোনো দেশের পক্ষেই ছয় লক্ষ মানুষের খাদ্য ও বাসস্থানের সংস্থান করা কঠিন, বিশেষ করে এত অল্প সময়ে৷ কেয়ার-এর পক্ষেও এক্ষেত্রে একা কিছু করা সম্ভব নয়৷ এর জন্য আরো অনেক বেশি অর্থায়নের প্রয়োজন৷ আর তাই শুধু সাহায্য সংস্থাগুলি নয়, সকলের, বিশ্বের প্রতিটা মানুষের সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে৷ আমরা চেষ্টা করছি যত বেশি সম্ভব ‘ফান্ড' জোগাড় করতে৷ আমরা কিছুতেই পিছ পা হবো না, এ চেষ্টা চালিয়েই যাবো৷ আমি যে নিজের চোখে দেখেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেই শেষ পর্যন্ত কত মানুষ খাওয়ার পান না৷ একটা সময় খাওয়ার শেষ হয়ে যায় আর  তাঁরা ক্ষুধার্তই থেকে যান৷ এ দৃশ্য চোখে দেখা যে কতখানি কষ্টের, তা আমি আপনাকে কথায় বোঝাতে পারবো না৷

আপনি বলছিলেন যে সেখানে প্রচুর নারী এবং শিশুকে আপনি দেখেছেন৷ সংবাদমাধ্যমেও আমরা পড়েছি যে, এ মুহূর্তে সেখানে অসংখ্য গর্ভবতী নারী সেখানে রয়েছেন – অনেকে ধর্ষণের পরে গর্ভবতী হয়েছেন, অনেকে আগেই ছিলেন৷ এঁদের কথা যদি আপনি একটু বলেন...

ক্যাম্পে নারী এবং শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ৷ বেশিরভাগ শিশুই পুষ্টিহীনতায় ভুগছে৷ এই সংখ্যা খুব কম করেও ৭০ হাজার হবে৷ বেশিরভাগ নারীই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার৷ এঁদের মধ্যে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, যিনি গণধর্ষণের শিকার৷ তাঁকে প্রায় ২০ জন মিলে একটি ঘরে বন্ধ করে ধর্ষণ করে, তিন দিন ধরে৷ এরপর কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হন তিনি৷ তবে আজও ভয়ে গুটিয়ে আছেন তিনি৷ আমি মনে করি, এঁদের জন্য শুধু খাওয়ার, বাসস্থান বা ডাক্তার নয়, মানসিক চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা প্রয়োজন৷

এরকম একটা জায়গায়, যেখানে হাজারে হাজারে মানুষ জড়ো হচ্ছেন, সেখানে হয়ত নারীদের সন্মান বাঁচানো খুবই কঠিন৷ তাঁদের জন্য যথাযথভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা অতন্ত শক্ত কাজ৷ এ অবস্থায় কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন নারীরা?

খুব খারাপ তাঁদের অবস্থা৷ ক্যাম্পে পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থা নেই৷ এর অর্থ হলো, সাধারণত মুক্ত জায়গাতেই প্রয়োজনীয় কাজটি সারতে হয় মানুষকে৷ পুরুষরা কোনোরকমে সেটা করলেও, নারীদের জন্য কাজটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়৷ স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা লজ্জা পান৷ ফলত তাঁবুর মধ্যেই তাঁরা পায়খানা-পেচ্ছাপ করেন, সেখানেই তাঁদের স্নানের কাজও সারতে হয়৷ অথবা বাইরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন রাত হওয়া পর্যন্ত৷ এতে করে রোগ সংক্রমণ বাড়ে৷ তার ওপর ক্যাম্পগুলোর পানি দূষিত হওয়ায় বাড়ে কলেরার উপক্রমও৷ যার প্রভাব সবচেয়ে আগে পড়ে পুষ্টিহীনতায় ভোগা বাচ্চাগুলোর ওপর৷

এই যে অনেক মানুষ গাদাগাদি করে ক্যাম্পে থাকছেন, তা তাঁবুগুলো দেখতে কেমন? ঠিক কীভাবে, কতজন মানুষ একটি তাঁবুতে থাকছেন?

এগুলোকে ঠিক তাঁবু বলা যায় কিনা, জানি না৷ কতগুলো প্লাস্টিকের চাদর বাঁশের ওপর বিছিয়ে দিয়ে মাথা ঢাকার জায়গা তৈরি করা হচ্ছে মাত্র৷ এগুলোতে তিল ধারণেরও জায়গা নেই৷ অনেক মানুষ এগুলোতে একসঙ্গে থাকেন৷ খুব বেশি দিন এভাবে এই তাঁবুগুলোতে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়৷ অনেকে তো ক্যাম্পে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু আজও তাঁদের কোনো তাঁবু জোটেনি৷ কীভাবে এগুলো তৈরি করতে হয়, সেটাও অনেকের জানা নেই৷ একে-অন্যকে সাহায্য করেই এঁরা বেঁচে আছেন৷ কিন্তু এ অবস্থা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে না৷ আন্তর্জাতিক সমাজকে তাই এগিয়ে আসতে হবে, যাতে এই মানুষগুলো অন্তত বিপদমুক্ত অবস্থায় মানুষের মতো বাঁচতে পারে৷

সাধারণত মুক্ত জায়গাতেই প্রয়োজনীয় কাজটি সারতে হয়ছবি: Reuters/A. Abidi

কোনো জায়গায় যদি সংস্থান কম হয়, মানে খাওয়ার কম থাকে, বাসস্থানের অভাব থাকে, তবে সেখানে অপরাধও বাড়তে থাকে৷ মানুষ তখন একটুর জন্য কাড়াকাড়ি, মারামারি শুরু করে দেয়৷ এই ক্যাম্পগুলোর যা অবস্থা, তাতে সেখানেও কি অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে?

অপরাধপ্রবণতা, ‘ক্রাইম' বেড়ে চলেছে৷ মানুষ একে-অপরকে এখনও সাহায্য করছে, তবে তাঁরা নিজেদের নিয়ে, যা একটু-আধটু সম্বল তাঁদের আছে, সেটা রক্ষা করবে তা ভেবে তাঁরা অত্যন্ত ভীত৷ টয়লেটের মতো সাধারণ বিষয় নিয়ে এর মধ্যেই নানা ঝামেলা হয়েছে৷ কোনো একটি টয়লেট অপেক্ষাকৃত খালি বা পরিষ্কার থাকলে সেটা নিয়ে মারামারি পর্যন্ত হয়েছে৷ এমন ছোটখাট ঘটনা শরণার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করছে খুব সহজেই৷ এ অবস্থায় কেয়ার-এর মতো সংস্থার গুরুত্ব অনেক, যারা এ অঞ্চলে ‘সিস্টেম্যাটিক' উপায়ে কাজ করবে৷ দেখবে, যাতে কেউ বেশি বা কেউ কম সাহায্য না পায়৷ দেখবে যাতে সাহায্য সকলের কাছে সমানভাবে পৌঁছায়৷

সংবাদপত্রে বা মিডিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলির যে ছবি আমরা দেখি, তাতে দেখা যায়, শরণার্থীদের অধিকাংশই নারী৷ এটা কেন? পুরুষদের কেন দেখা যায় না?

বহু পুরুষ রোহিঙ্গাই বাংলাদেশ পর্যন্ত আসতে পারেননিছবি: CARE/J. Bose

না, পুরুষরাও আছেন৷ তাঁরা একাধিক পরিবারের দেখাশোনা করেন৷ কিন্তু পুরুষরা সংখ্যায় অনেক কম৷ এর একটি কারণ, বহু পুরুষ রোহিঙ্গাই বাংলাদেশ পর্যন্ত আসতে পারেননি৷ অনেককে মিয়ানমারেই মেরে ফেলা হয়েছে, অনেককে পথে৷ তাই বহু নারীকে কোলের সন্তানদের নিয়ে একাই এত দূরের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে৷ বাংলাদেশ পর্যন্ত আসতে পারেননি বহু মায়ের ছেলে, বহু নারীর স্বামী, স্বজনরা৷

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ কিন্তু রোহিঙ্গাদের যে স্রোত বাংলাদেশের দিকে আসছে, সেটা সামলানো তো শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারত-মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশগুলিরও দায়িত্ব৷ আপনার কী মনে হয়, আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশকে এই চাপমুক্ত করার জন্য কী করা যেতে পারে?

বাংলাদেশের ওপরে সত্যিই এ মুহূর্তে অনেক চাপ৷ মাত্র এক মাসের মধ্যে প্রায় আধা মিলিয়ন মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন৷ যে কোনো দেশের জন্যই এই চাপ সামলোনো কঠিন হতো৷ আর বাংলাদেশ তো অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক গরিব দেশ৷ তাদের ক্ষমতাও কম৷ এরপরেও কিন্তু বাংলাদেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করেনি৷

ছোট্ট একটা জায়গায় অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষ এখন বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেছবি: Reuters/H. McKay

বরং শরণার্থীদের তারা স্বাগতই জানিয়েছে৷ এখন আমাদের এসব শরণার্থীর নিরাপত্তা, বেচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তাগুলো নিশ্চিত করতে হবে৷ ছোট্ট একটা জায়গায় অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষ এখন বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে৷ এর থেকে এঁদের মুক্তি পাওয়া সত্যিই প্রয়োজন৷ প্রয়োজন স্বল্পমেয়াদী নয়, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার, যাতে করে এঁরাও একটি সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারে৷ তারপর পূরণ করতে পারে সেই স্বপ্ন৷ মিয়ানমারে থাকাকালীনও তাঁদের দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবনধারণ করতে হয়েছিল, এখনও তাই করতে হচ্ছে৷ তাঁরা যেন একটি ক্যাম্প থেকে অন্য একটি শরণার্থী ক্যাম্পে এসে পৌঁছেছে৷ সেখানেও কেউ তাঁদের পাশে ছিল না, আজও সত্যিকার অর্থে কেউ নেই৷

আপনি তো এঁদের অনেকেই সঙ্গেই কথা বলেছেন, সময় কাটিয়েছেন...৷ আচ্ছা, এঁরা কি বাংলাদেশেই থাকতে চান, নাকি ফিরে যেতে চান স্বদেশে?

কয়েকজন বাংলাদেশে থাকতে চান, আবার কেউ কেউ ফিরে যেতে চান মিয়ানমারে৷ কিন্তু তাঁদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বা প্রশ্নটা হলো দু'বেলা সন্তানের মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার, মাথার ওপর ছাদ, রাতের ঘুম আর নিরাপত্তার৷ কোথায় নয়, জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাটাই তাঁদের কাছে আজ সবচেয়ে বড়৷

সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো? লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ