ড. সি আর আবরারের মতে মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিই ছিল বাংলাদেশের কূটনৈতিক ধারাবাহিকতার প্রধান সাফল্য৷ তবে ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনাও করেছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিচার্স ইউনিট (রামরু)-র প্রধান সমন্বয়কারী ড. আবরার প্রথমেই উল্লেখ করেন যে, ২০১৬ সালের ৯ই অক্টোবরের ঘটনার পর ‘একটা বড়সংখ্যক রোহিঙ্গা' বাংলাদেশে আসেন ও আরো বড় কথা, রোহিঙ্গা ইস্যু একটি আন্তর্জাতিক সংবাদে পরিণত হয়৷
তাঁর মতে, এই ঘটনাবলীর সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল, মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীর উপর একটা বড় ধরনের চাপ৷ এক্ষেত্রে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত কমিশনের রিপোর্ট, এমনকি পোপ ফ্রান্সিসের মন্তব্যের কথাও বলেন৷ ‘‘বাংলাদেশ থেকে একটা কূটনৈতিক ধারাবাহিকতা থেকে এই সাফল্য এসেছে'', বলে তাঁর ধারণা৷
ড. সি আর আবরার
অন্যদিকে রয়েছে রোহিঙ্গাদের ঠ্যাঙার চরে পাঠানোর পরিকল্পনা, যা ‘‘অত্যন্ত ভুল কাজ হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন'' - বলেন ড. আবরার৷ ২০১৫ সালের এই পরিকল্পনা নতুন করে চালু করার কোনো প্রয়োজন ছিল না বলে তিনি মনে করেন, এক যদি না এর উদ্দেশ্য হয়, ‘‘অন্য রোহিঙ্গাদের সংকেত দেওয়া, তারা যেন এখানে না আসেন'', কেননা এখানে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন না৷
কাজেই পদ্মানদীর মাঝির হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপের মতো এই ঠ্যাঙ্গার চরের পরিকল্পনাতেও ভালো যেটুকু দেখছেন ড. আবরার, তা হলো, ‘‘প্রথমবার সরকার স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা যারা রয়েছেন, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, এই চাহিদাগুলো মেটানো প্রয়োজন৷''
৩০,০০০ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা যে ন্যূনতম সুযোগসুবিধা ভোগ করছেন, অনিবন্ধিতরাও সেটা পাবেন ও আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসমাজ তার ব্যয় বহন করবে বলে ড. আবরারের আশা৷ তবে চরম হতাশা কাটতে শুরু করেছে ও মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফেরৎ নিতে হবে বলেও তাঁর ধারণা৷ বিপুল সংখ্যক অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসমাজকে পর্যাপ্তভাবে অবহিত না করাটাই বাংলাদেশের ব্যর্থতা বলে তিনি মনে করেন৷
ভুলে যাওয়া শরণার্থীরা: বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে রোহিঙ্গারা
গত অক্টোবরে মিয়ানমারে দমনপীড়ন শুরুর পর ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন৷ মুসলিমপ্রধান দেশটিতে বর্তমানে পাঁচ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছেন৷ কুতুপালংয়ের মতো জনাকীর্ণ ক্যাম্পগুলোতে তাদের অনেকের বাস৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
মিয়ানমার থেকে পালানো
মিয়ানমারে গত অক্টোবরে নয় পুলিশ হত্যার অভিযোগ ওঠে এক রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে৷ তারপর থেকে সেদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর আবারো দমনপীড়ন শুরু হয়৷ ফলে সত্তর হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷ তারা যেসব ক্যাম্পে বসবাস করেন সেগুলোর একটি এই কুতুপালং৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
স্বনির্ভরতা দরকার
কুতুপালং ক্যাম্পের শরণার্থীরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে নিরাপদ আছে বটে, তবে জীবন সেখানে মোটেই সহজ নয়৷ সেখানে সত্যিকারের কোনো অবকাঠামো নেই, সবই শরণার্থীদের গড়া অস্থায়ী আবাস৷ তারা নিজেদের দেশ ছেড়ে এসেছেন, কেননা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ করেছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
শিশুদের খেলা নয়
আশ্রয়শিবিরটির অধিকাংশ এলাকায় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেই৷ কয়েক হাজার শরণার্থী শিশুর খেলোধুলারও কোন ব্যবস্থা নেই৷ ক্যাম্পের লেক থেকে মাটি সংগ্রহ করছে এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
কুঁড়েঘরে বসবাস
কাদা মাটি এবং সহজলভ্য অন্যান্য উপাদান দিয়ে ঘর তৈরি করে বাস করেন শরণার্থীরা, যাতে মাথার উপরে অন্তত ছাদ থাকে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস
সেই ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই সেদেশে রোহিঙ্গারা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ তাদেরকে নাগরিকত্ব এবং ভোট দেয়ার অধিকার দিচ্ছে না সরকার৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
বাংলাদেশেও বৈষম্যের শিকার?
বাংলাদেশেও বৈষম্যে শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা৷ ক্যাম্পে আর জায়গা নেই- বলে বাংলাদেশে জলপথে আশ্রয় নিতে আসা অসংখ্য রোহিঙ্গাকে তাদের নৌকাসহ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে সীমান্তরক্ষীরা৷ পাশাপাশি কক্সবাজার ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের একটি দুর্গম দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার৷ স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, দ্বীপটি বর্ষাকালে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে যায়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
নির্জন দ্বীপে সরিয়ে নেয়া
ঠ্যাঙ্গার চর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মেঘনা নদীর মোহনায় কয়েকবছর আগে জেগে ওঠা এক দ্বীপ৷ শুধুমাত্র নৌকায় করে সেখানে যাওয়া যায় এবং চরটিতে অতীতে একাধিকবার জলদস্যু হানা দিয়েছে৷ এক উন্নয়নকর্মী সম্প্রতি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে দ্বীপটিতে কর্মসংস্থানেরও তেমন কোনো সুযোগ নেই৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী স্বীকার করেছেন যে, ঠ্যাঙ্গার চরকে বসবাসের উপযোগী করতে আরো অনেক কাজ করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘দ্বীপটিতে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করার পর রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেয়া হবে৷’’ তবে সরকার অতীতে এরকম প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি৷ কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের তেমন কোন উন্নয়ন সাধন করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
ইতিহাস থেকে মোছার চেষ্টা
নিরাপদ আবাসভূমি না থাকায় রোহিঙ্গাদে ভবিষ্যত ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে৷ অন্যদিকে, মিয়ানমার তাদের অতীত মুছে ফেলতে কাজ করছে৷ দেশটির সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে যেখানে রোহিঙ্গাদের কথা একেবারেই উল্লেখ থাকবে না৷ গত ডিসেম্বরে মন্ত্রণালয়টি দাবি করেছে, মিয়ানমারের ইতিহাসে কোনো সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে কখনো রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury
9 ছবি1 | 9
তাঁর কাছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ‘‘তাদের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা''৷ পুলিশ যেন তাদের তুলে না নিয়ে যায়, বেআইনি অনুপ্রেবেশের জন্য যেন তাদের দায়ী করা না হয়৷ এরপর তাদের বাসস্থান, খাদ্য, শিশুদের জন্য পুষ্টি, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি নিশ্চিত করা উচিত এবং সেটা সম্ভব না হলে, নিজেদের জীবিকা অর্জনের সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ড. সি আর আবরার৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷