রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আগামী বছরের ঈদ নিজ দেশে করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস৷ তবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গৃহযুদ্ধ তাদের ফেরার পথে এখন বড় বাধা৷
২০২৪ সালে রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে লড়াই তীব্র হলে কমপক্ষে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেছবি: AFP
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতমাসে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, ‘‘আল্লাহর কাছে দোয়া গরি সাম্মর বার যেন অনরা নিজর বাড়িত যাইয়ারে ঈদ গরিত পারন৷''
বাংলাদেশ গত বেশ কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে৷ তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংখ্যায় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে ২০১৭ সালে৷ সেসময় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন দেশটির রাখাইন অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল৷
রোহিঙ্গাদের এই আবাসস্থলে তখন জাতিসংঘের ভাষায় ‘টেক্সট বুক এথনিক ক্লিনজিং' ঘটেছিল৷
২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে অং সান সুচি সরকারের পতন ঘটলে দেশটির সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়৷ তারপর থেকে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর গৃহযুদ্ধ চলছে৷ ফলে, রাখাইন থেকে আরো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন৷
বাংলাদেশের কক্সবাজারের জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবির এবং ভাসান চরে বর্তমানে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছেন৷ তারা পুরোপুরি ত্রাণ সহায়তার উপর নির্ভরশীল৷
মিয়ানমারের সামরিক সরকার চলতি মাসের শুরুতে এক লাখ আশি হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী দেশে ফিরতে পারবে বলে জানিয়েছে৷ তারা ইতোমধ্যে তাদের পরিচয় যাচাই করেছে৷ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দুই দেশের মধ্যে এক সম্মেলন থেকে এই তথ্য জানানো হয়েছে৷
যাদের ফেরত নিতে চাচ্ছে মিয়ানমার তাদেরসহ আট লাখ রোহিঙ্গার নামের তালিকা বাংলাদেশ ছয় ধাপে ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশটির সরকারের কাছে পাঠিয়েছিল৷ তালিকার অন্যান্যদের পরিচয় যাচাইবাছাই চলছে বলেও জানিয়েছে মিয়ানমার৷
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যদিও এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়৷ রোহিঙ্গারা সবসময়ই নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন চেয়েছে৷ রাখাইন রাজ্য নিরাপদ বিবেচিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যাবাসন শুরুর সম্ভাবনা কম৷''
২০২৪ সালে রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে লড়াই তীব্র হলে কমপক্ষে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে৷ রাখাইনের বাসিন্দাদের জন্য আরো স্বায়ত্তশাসন চায় এএ৷ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়ার সময় সেনাবাহিনীকে রাখাইনের অন্য বাসিন্দারা সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে৷
রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধদের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ)-এর সুসজ্জিত সামরিক অংশ এএ৷
বৌদ্ধ এবং মুসলমান উভয়ের জন্য রাখাইন রাজ্যে, যেটি আরাকান হিসেবেও পরিচিত, স্বায়ত্তশাসন চায় এএ এবং ইউএলক৷
বাংলাদেশ-মিয়ানমার মানবিক করিডোর চায় জাতিসংঘ
গতমাসে বাংলাদেশ সফর করেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস৷ সেসময় তিনি এবং ড. ইউনূস রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির সফর করেন এবং এক লাখের মতো রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন৷
বাংলাদেশে এক সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস জানান যে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ত্রাণ পাঠাতে একটি মানবিক করিডোর খোলার কথা বিবেচনা করছে জাতিসংঘ৷
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করতে হবে, যাতে [রোহিঙ্গাদের] প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়৷''
জাতিসংঘের মহাসচিব এ সময় আরো বলেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপে বসা জরুরি৷
নির্বাসিত রোহিঙ্গাদের জীবন ও বাংলাদেশের উভয় সংকট
গত আট দশক ধরে নির্বাসন ও প্রত্যাবাসনের চক্রে আটকা পড়েছেন রোহিঙ্গারা৷ সবশেষ যে আশার আলো দেখা গিয়েছিল তা-ও নতুন বাস্তবতায় ফিকে হতে শুরু করেছে৷ রোহিঙ্গাদের ঘরছাড়া করার ও ঘরে ফেরানোর প্রচেষ্টার কাহিনি থাকছে ছবিঘরে...
ছবি: Mohibulla Mohib
রোহিঙ্গা কারা
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, আরাকান রাজ্যে বসবাসকারী মুসলিমরা রোয়াইঙ্গা, যাম্ভইকা, কামানচি, জেরবাদি ও দিন্নেত এই পাঁচটি জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত৷ এর মধ্যে রোয়াইঙ্গা জাতিগোষ্ঠিই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত৷ উদ্ভব নিয়ে নানা মত থাকলেও বাংলাপিডিয়া বলছে, ‘‘চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকান রাজ্যে বসতিস্থাপনকারী চট্টগ্রামি পিতার ঔরসজাত ও আরাকানি মাতার গর্ভজাত বর্ণসংকর জনগোষ্ঠীই রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গ্যা৷’’
ছবি: Zobaer Ahmed/DW
প্রথম দাঙ্গা
১৯৪০ সাল থেকে আরাকানে বৌদ্ধ মগ জনগোষ্ঠী ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শুরু হয়৷ ১৯৪২ সালে এক লাখ রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হন৷ অনেকে আরাকান ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন৷ ১৯৪৮ সালে তৎকালীন বার্মার স্বাধীনতার পর এবং ১৯৬২ সালে পুনরায় তারা নিপীড়ন, নির্যাতন ও উচ্ছেদের শিকার হন৷ এ সময় বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে আসতে বাধ্য হন তারা৷
স্বাধীন বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা
আরাকানে জাতিগত আন্দোলন দমনের জন্য মিয়ানমারের (তখন বার্মা) তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল নে-উইন (ছবিতে) ১৯৭৮ সালে ‘নাগামিন ড্রাগন অপারেশন’ নামের অভিযান চালান৷ আরাকান ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততার কারণে নির্বিচারে তাদের হত্যা করা হয়৷ অভিযানের কারণে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য হন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
প্রথম প্রত্যাবাসন
সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য বাংলাদেশের তখনকার সরকার আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আবেদন জানায়৷ জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামের চাপের মুখে নে-উইন সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরাতে সম্মত হয়৷ দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭৯ সালের ৬ অক্টোবর থেকে ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের বড় অংশ নিজ দেশে ফিরে যান৷ থেকে যান ১৫ হাজার৷ ছবিটি ২০১৮ সালের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য বানানো একটি ‘মডেল গ্রাম’৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. H. Kyaw
আবারও সংকট
মিয়ানমার সরকারের আইন ও নীতির কারণে ১৯৯১ সালে আবারও রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ঘরছাড়া হন৷ ৯০ সালের নির্বাচনে জয়ী অং সান সুচিকে বন্দি করার পর সেনাবাহিনী আবারও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জড়িত রাখাইনসহ রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে৷ রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণে ১৯৯১ সালের ২৬ জুনের মধ্যে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
দ্বিতীয় প্রত্যাবাসন
দুই দেশের সরকারের মধ্যে ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল একটি সমঝোতা চুক্তি হয়৷ সে অনুযায়ী, এই দফায় আগতদের দুই লাখ ৩১ হাজার জনকে মিয়ানমার সরকার ফিরিয়ে নেয়৷ বাকি থাকে ২২ হাজার৷ তাদের ফেরানোর অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়ন করেনি দেশটি৷ প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় তারা কক্সবাজার জেলার উখিয়া থানার কুতুপালং এবং টেকনাফ থানার নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করেন৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/K. Huda
২০১৬ সালের পর
মিয়ানমারে নির্যাতনের জেরে ২০১৬ সালের পর থেকে আবারও বড় আকারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করেন৷ বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরসিসিসি) হিসাবে ২০১৬ সালে ৮৭ হাজার এবং ২০১৭ সালের আগষ্ট থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন৷ ইউএনএইচসিআর-এর হিসাবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় নয় লাখ ৭২ হাজারে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
তিনটি ব্যর্থ উদ্যোগ
২০১৭ সালের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তিনটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল৷ ২০১৮ সালে, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে নেয়া এসব উদ্যোগের কোনোটিরই ফল মেলেনি৷ এর মধ্যে ২০১৮ সালে আট লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছিল বাংলাদেশ৷ তার প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৬৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি ফিরতি তালিকা পাঠানো হয়৷ পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১১৪০ জনকে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও পরে তা ভেস্তে যায়৷
ছবি: bdnews24.com
উদ্যোগী চীন
গত বছর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সবশেষ উদ্যোগটি শুরু হয়৷ প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গাদের একটি দল পরিস্থিতি দেখতে মিয়ানমারে যান৷ প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার জন্য চীনের বিশেষ দূত ডেং জিজুন দেশটি সফরে যান এবং রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্পে না, নিজ গ্রামে ফিরতে পারেন তার উদ্যোগ নেন৷ সেপ্টেম্বরে আলোচনার জন্য মিয়ানমারে যায় বাংলাদেশের একটি দল৷ এর অধীনে সে বছর ১২ হাজার জনকে পাঠানোর পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Qing
দুই ঝড়
এই পরিকল্পনায় প্রথম আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় হামুন৷ এরপর সম্ভাবনাটিকে আরো ফিকে করে দেয় মিয়ানমারের সামরিক জান্তাবিরোধী বিদ্রোহের নয়া ঝড়৷ ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই শুরু করে৷ আরাকান আর্মি রাখাইনে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে জান্তার ১৬০টি ঘাঁটি দখল করে৷
ছবি: Handout/Kokang Information Network/AFP
আন্তর্জাতিক বাধা
মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিবেচনায় শুরু থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাগুলো৷ সম্প্রতি নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের সাথে সাক্ষাৎ শেষে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেছেন, ‘‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য এটি ভালো সময় নয়৷’’
ছবি: AFP
‘ভারাক্রান্ত বাংলাদেশ’
সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘‘রোহিঙ্গা ডিসপ্লেসড পিপলের কারণে আমরা ভারাক্রান্ত। প্রতি বছর ৩৫ হাজার করে নতুন সন্তান জন্মগ্রহণ করে৷ এই পরিস্থিতিতে আসলে; মানবিকতার কারণে তখন আমরা রোহিঙ্গাদের স্থান দিয়েছিলাম৷ আমরা মনে করি, মিয়ানমারে পরিস্থিতি উত্তরণের মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব৷’’ রাখাইনে পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদী৷
ছবি: Arafatul Islam/DW
শিবিরে বন্দি জীবন
বাংলাদেশে সীমিত জায়গায় বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থী মানবেতর জীবন যাপন করেন৷ কিছুদিন পরপর আগুনে তাদের ঘর পোড়ে, ঝড়ে বিপদে পড়েন৷ ঘটে চলেছে সহিংসতাও৷ তাদের সন্তানেরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, নেই কর্মসংস্থানও৷ এর মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থ সহয়তার হারও চাহিদার চেয়ে ক্রমাগত কমছে৷ সর্বশেষ ২০২৩ সালে যা ৪৭ ভাগে নেমে এসেছে৷
ছবি: AFP via Getty Images
ভাসমান জীবন
ভাগ্যবদলের চেষ্টায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করছেন অনেক রোহিঙ্গা৷ ইউএনএইচসিআর-এর হিসাবে, ২০২৩ সালে সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ও বাংলাদেশের শিবির থেকে নৌকায় সাগরপথে রওনা দেন, যাদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিলেন নারী ও শিশু৷ বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান পেরুতে গিয়ে মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন ৫৬৯ জন, যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ৷ সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে তাদের আগমনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন স্থানীয়রা৷
ছবি: Chaideer Mahyuddin/AFP/Getty Images
14 ছবি1 | 14
এদিকে, ব্যাংককের বৈঠক থেকে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান নিশ্চিত করেন যে, আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপ চলছে৷
তিনি বলেন, ‘‘২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ছয়টি ব্যাচে মোট ৮ লাখ রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারকে পাঠিয়েছে৷ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা বাকি সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা যত দ্রুত সম্ভব যাচাই-বাছাই শেষ করবে৷''
‘‘রাখাইন এখনো মিয়ানমারের একটি সার্বভৌম অঞ্চল৷ আমরা আরাকান আর্মির সঙ্গেও আলোচনা করেছি৷ তাদের ঘোষিত অবস্থান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া৷ তারা এটা প্রকাশ্যে গত সেপ্টেম্বরে বলেছেন৷ আমাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় তারা এটা পুর্নব্যক্ত করেছেন,'' যোগ করেন রহমান৷
রোহিঙ্গারা কি আরাকান আর্মির দখলে থাকা রাখাইনে ফিরবেন?
জাতিগত গোষ্ঠী রোহিঙ্গা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব না পাওয়ায় দেশটিতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে ও রাষ্ট্রহীন অবস্থায় রয়েছে৷
মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্ত করা সংস্থা ফার্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি ডয়চে ভেলেকে জানান যে নাগরিকত্ব এবং সমানাধিকারের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা কম৷
তিনি বলেন, ‘‘রাখাইনের অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করা আরাকান আর্মিকে অনেক রোহিঙ্গা বিশ্বাস করেন না৷ ''
তিনি আরো বলেন, ‘‘রোহিঙ্গারা রাখাইনের আদিবাসী এবং তাদের ঘরে ফেরার সুযোগ পাওয়া উচিত৷ তবে সেখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি নাগরিকত্বের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে এবং সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মিকে তাদের ঘটিয়ে চলা অপরাধের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে৷''
সেসব না করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো উচিত হবে না বলে মনে করেন কুইনলি৷
ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা নেই সান লুইন মনে করেন যে মিয়ানমারের জান্তা সরকার সত্যিই যদি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় তাহলে তাদের আরো পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে৷ বিশেষ করে প্রকাশ্যে এই ঘোষণা দিতে হবে যে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর বিমান হামলা বা গোলা বর্ষণ করা হবে না৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা বা অন্যদের রাখাইনে পুনরায় জীবন শুরু করতে হলে আরাকান আর্মির কাছ থেকে একধরনের অনুমতি বা নথির প্রয়োজন হবে৷ পাশাপাশি মিয়ানমারের নাগরিকত্বও লাগবে৷''
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে অব্যাহত আন্তর্জাতিক তৎপরতা
এদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক তৎপরতা আরো বাড়াচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার৷ এজন্য চীনের সহায়তা চাওয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের উদ্যোগে একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনেরও প্রস্তুতি চলছে৷
কাতারের রাজধানী দোহায় বুধবার রোহিঙ্গা বিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা বলেনছবি: CA Press Wing Bangladesh
কাতারের রাজধানী দোহায় বুধবার রোহিঙ্গা বিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন শুরু করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কাতার তাদের কূটনৈতিক প্রভাব কাজে লাগাতে পারে৷ আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে, কাতার জোরালোভাবে তাদের সংহতি প্রকাশ করে এই সংকট সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে৷''
‘‘এছাড়া ওআইসি দেশগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তহবিল সংগ্রহ জোরদার ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে মত প্রকাশের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে,'' যোগ করেন তিনি৷
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্ভূত নানা সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা সংকট থেকে সরে যাচ্ছে৷''
রোহিঙ্গা শিবিরে এক ট্রান্সজেন্ডার নারীর লড়াই
কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শত বঞ্চনা, হতাশার মাঝেই সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখছেন এক ট্রান্স নারী৷ ছবিঘরে তার জীবনের গল্প...
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বিউটি পার্লারেই মুক্তির স্বাদ
২৫ বছর বয়সি তানিয়া বাংলাদেশের কক্স বাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে খুব জনপ্রিয়৷ তার কাছে চুল কাটাতে বা ফেসিয়াল করাতে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করেন বহু খদ্দের৷ সৌন্দর্য্য বাড়াতে তানিয়ার কাছে মানুষ ভিড় জমালেও তার অস্তিত্ব কিছু মানুষের অস্বস্তির কারণ৷ ‘‘রোহিঙ্গাদের জীবন কঠিন৷ আর ট্রান্স রোহিঙ্গার জীবন আরো কঠিন’’, বলেন তিনি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
শুরুর কথা
অন্য সব রোহিঙ্গার মতো তানিয়াও ২০১৭ সালে সামরিক হামলার মুখে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন৷ সেই থেকে তার দিন কাটছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির বলে পরিচিত এই ক্যাম্পে৷ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মৌংদো শহরে জন্ম নেওয়া তানিয়ার জীবন ছোটবেলা থেকেই তার লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে জটিল৷ পরিবার ত্যাগ করলে হিজড়া সমাজ তাকে আপন করে নেয়৷
ছবি: DW/D. Cupolo
টানাপোড়েনের গল্প
তানিয়ার সাথে তার পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই৷ তার ভাই-বোনদের অনেকেই ভারতে থাকেন৷ তারাও তানিয়ার সাথে যোগাযোগ করেন না৷ তানিয়া বলেন, ‘‘আমার বাবা-মা জীবিত থাকলেও তাদের কাছে আমি মৃত৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বৈষম্য, জেদ ও লড়াই
মিয়ানমারে থাকার সময়েই বিউটিশিয়ানের কাজ শেখেন তিনি, যা পরে বাংলাদেশে এসেও কাজে লাগান তানিয়া৷ আরেকজনের পার্লারে বিউটিশিয়ানের কাজ শুরু করেন তিনি৷ মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আয় হয় তার৷ বিয়ের সাজ থেকে সাধারণ চুলের ছাঁট, সব ধরনের রূপসজ্জার জন্য পার্লারের বাইরে ভিড় করেন রোহিঙ্গা থেকে বাংলাদেশি সব ধরনের খদ্দের৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
তানিয়ার ভবিষ্যতের স্বপ্ন
আরো চারজন ট্রান্স নারীকে বিউটিশিয়ানের কাজ শিখিয়েছেন তানিয়া, যাদের প্রত্যেকেই এখন বিদেশে সফলভাবে কাজ করছেন৷ তাদের পথে যেতে চান তানিয়াও৷ তিনি বলেন, ‘‘তারা সব সময় আমাকে যেতে বলে৷ আমিও যেতে চাই৷ আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমার নিজের একটা পার্লার হবে আর আমি স্বাবলম্বী হবো৷’’